ইডেনে মনোজের ব্যাটে বড় রানের আশায় বঙ্গক্রিকেট। ছবি সৌজন্য মনোজ তিওয়ারির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
ফেলে আসা দিন কখনও স্রেফ স্মৃতি হয়েই থেমে থাকে না। বরং জ্বলন্ত মশাল হয়ে ওঠে। জোগায় উদ্দীপনার ফুলকি। ২০০৭ জানুয়ারির ইডেন তেমনই হয়ে উঠছে মনোজ তিওয়ারির কাছে।
মাঝে কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর। তবু সে বার ইডেনের রঞ্জি সেমিফাইনাল এখনও টাটকা। এবং এই মুহূর্তে তা হয়ে উঠছে রীতিমতো প্রাসঙ্গিক। ইডেনে সেমিফাইনালে কর্নাটককে ছয় উইকেটে হারিয়েই তো ফাইনালের টিকিট পেয়েছিল দীপ দাশগুপ্তের বাংলা। আর চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ-জেতানো ইনিংস খেলেছিলেন মনোজ। ৩০৭ রান তাড়া করতে নেমে অপরাজিত ছিলেন ১৫১ রানে।
ইডেনে শনিবার থেকে ফের রঞ্জির সেমিফাইনাল। ফের মুখোমুখি বাংলা-কর্নাটক। লোকেশ রাহুল, মণীশ পাণ্ডে, করুণ নায়ারদের হেভিওয়েট দলের বিরুদ্ধে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি সম্ভব? মনোজের পাল্টা প্রশ্ন, “কেন নয়? আমরা সেমিফাইনাল বলে ভাবছি না। এটাকে স্রেফ আরও একটা ম্যাচ হিসেবেই দেখছি। ঘরের মাঠে কোনও বাড়তি চাপ সঙ্গে নিচ্ছি না। কারণ, যদি আমরা এটা ভাবি যে বিপক্ষে বড় বড় সব নাম রয়েছে, ওরা কী সব পারফরম্যান্স করে এসেছে, তা হলে মুশকিল। সে ক্ষেত্রে তখনই ব্যাকফুটে চলে যাব। আমরা তাই খোলা মনে নামছি।”
কটকে ওড়িশার বিরুদ্ধে ম্যাচ চলাকালীনই সেমিফাইনালের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল বাংলা শিবির। ইডেনে কর্নাটকের বিরুদ্ধে খেলতে হবে জানার পর শিবিরের আবহ কেমন ছিল? মনোজ শোনালেন, “সামনে কর্নাটক জেনেই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। বলি, চল ভাই, সামনে বড় টিম এসেছে, ভাল খেলা হবে। আমরা তাই সেমিফাইনালের অপেক্ষায় দিন গুনছি তখন থেকে। যা প্রমাণ করে যে, ছেলেরা ভাল দলের বিরুদ্ধে নিজেদের চেনানোর জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। আমরা কিন্তু কর্নাটককে খেলতে হবে বলে চিন্তায় আছি, এমন নয়। বরং ছটফট করছি মাঠে নামার জন্য। আর এটা সবারই মুখের কথা। দলে ইতিবাচক মানসিকতা রয়েছে, তাগিদ রয়েছে। যা ভাল লক্ষণ। বিপক্ষে যে-ই থাক, আমরা ভয় পাচ্ছি না। পিছিয়ে থাকছি না। বরং টক্করের জন্য তৈরি।”
আরও পড়ুন: ওয়েলিংটনে হার বিরাট-পৃথ্বীদের যে দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল
মনোজ পরিষ্কার করে দিলেন যে, ভয়ডরহীন এই মানসিকতাকে আত্মতুষ্টির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। কারণ, বিপক্ষকে যথেষ্টই সমীহ করছে বাংলা। দিচ্ছে গুরুত্ব। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের কথায়, “কর্নাটককে অবশ্যই সম্মান করছি আমরা। ওদের দল, ক্রিকেটারদের সম্মান করছি। ওদের পারফরম্যান্স মাথায় রাখছি। তবে এটাও জানি যে, ক্রিকেট ব্যাট-বলের খেলা। ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে একটা বলই ড্রেসিংরুমে ফেরত পাঠানোর পক্ষে যথেষ্ট। বোলারদের তবু একটা স্পেলে মার খেলে পরের স্পেল থেকে যায়। কামব্যাকের সুযোগ থাকে। অবশ্য বোলাররা যেমন বল করছে, আমরা একটা দল হিসেবে যেমন খেলছি, তাতে কর্নাটককে লড়াইয়ে ফেলার বিশ্বাস রয়েছে।”
২০০৬-০৭ মরসুমে শেষ বার রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল বাংলা। তার আগের বছরও দীপ দাশগুপ্তের দল উঠেছিল ফাইনালে। লখনউ ও মুম্বইয়ে হওয়া ফাইনালে পর পর দু’বছর হতাশা সঙ্গী হয়েছিল বাংলার। এবং সেই দুই ফাইনালেই খেলেছিলেন মনোজ। শেষ বার বাংলার ফাইনালে ওঠার নেপথ্যে সেমিফাইনালে মনোজের ইনিংস বড় ভূমিকা নিয়েছিল। মনোজের কেরিয়ারে এটা হতে চলেছে রঞ্জির চতুর্থ সেমিফাইনাল।
তবে নিজের কথা মাথায় রাখছেন না একেবারেই। বললেন, “আমি এটাকে আরও একটা ম্যাচ হিসেবেই নেব। যদিও সবাই জানে এই ম্যাচটা আসলে কী। এখানে পারফরম্যান্স করলে তা সবার চোখেও পড়বে। ম্যাচটা লাইভ হবে বলেও শুনছি। আর এটা বড় ম্যাচ হতে চলেছে। কেএল রাহুল খেলবে যখন তখন গুরুত্বও বাড়বে। তবে এটা নিয়ে এখন আর মাথায় কিছু আসে না। নিজের সেরাটা দেওয়া, দলের জয়ে অবদান রাখার ব্যাপারই মাথায় থাকে।”
ঠিক যেমন ঘটেছিল ১৩ বছর আগের ইডেনে? মনোজের গলায় হাসি, “ইডেনে কর্নাটকের বিরুদ্ধে শেষ সেমিফাইনালে ১৫১ রানের ইনিংস এখনও স্মৃতিতে টাটকা। তিনশোর বেশি রান তাড়া করছিলাম জেতার জন্য। হ্যাঁ, সেটাও মাথায় রয়েছে। সেই মরসুমেই ইডেনে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ২১০ রান করেছিলাম। ইডেনে আর একটা বড় ইনিংস পেলে মন্দ হয় না।” এই মরসুমে রঞ্জিতে ছন্দেও রয়েছেন তিনি। হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে কল্যাণীতে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে নটআউট ছিলেন। পাটিয়ালায় পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ঘূর্ণি উইকেটে দুই ইনিংসেই নির্ভরতা দিয়েছিলেন দলকে। কটকে কোয়ার্টার ফাইনালে যদিও রান আসেনি। তবে তার পরও ৫৯.১৮ গড়ে ৬৫১ রান রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
আরও পড়ুন: পায়ে সমস্যা, ক্রাইস্টচার্চে পৃথ্বীর খেলা নিয়ে সংশয়
মনোজের অবশ্য নিছক সংখ্যা দিয়ে মাপায় ঘোর আপত্তি। বললেন, “গেমপ্ল্যান বেটার হয়েছে। প্রত্যেক বছরই চেষ্টা করি উন্নতির। এ বারও তা করেছি। তারই প্রতিফলন ঘটছে। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা এসেছে। তা প্রয়োগ করতেও পারছি। যখন ব্যাটিং করতে যাচ্ছি, তখন মনসংযোগও বাড়াচ্ছি। ফোকাসটা বেটার হয়েছে। গেমপ্ল্যানের কথা বলব। অনেক সময় গেমপ্ল্যান ঠিক না থাকলে বড় শট মারতে গিয়ে বা বাজে শটে আউট হতে হয়। সেটা একটা-দুটো ম্যাচ ছাড়া এ বার হচ্ছে না। অধিকাংশ সময়েই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দাঁড়িয়েছি, রান করেছি। তিনশোর আগের রানগুলো হয়তো বড় ছিল না, কিন্তু তা দলের পক্ষে খুব জরুরি ছিল। দলের বিপদে সেই রানগুলো এসেছে। যে পিচে খেলতে হয়েছিল, তাতে কম রান হলেও ওই ইনিংসগুলো তৃপ্তি দিয়েছে। জানতাম, ভাল উইকেট পেলে ওই ইনিংসগুলো অনেক বেশি রানে পৌঁছত।”
গেমপ্ল্যানিং মানে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন? মনোজের ব্যাখ্যা, “কোন বোলারকে কী ভাবে খেলব, সেটাই প্ল্যানিং। ব্যাট করতে যাওয়ার আগে থেকেই গভীর ভাবে ঢুকে পড়ি ম্যাচে। লক্ষ্য করতে থাকি, কে কেমন বল করছে, কতটা কার্যকর হচ্ছে, কেমন ফিল্ডিং সাজিয়ে বল করছে, কোথায় বল রাখছে। বাইরে থেকে যেটুকু মাথায় তোলার ব্যাপার থাকে, সেটা তুলে নিই। তার পর পিচে গিয়ে সেখানের বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। গেমপ্ল্যানের মধ্যে এই সবই পড়ে। এ বার প্ল্যানটাকে ব্যাট হাতে মেলে ধরার ব্যাপার থাকে।”
অনেকের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব থেকে অব্যাহতি হয়ে ওঠে আশীর্বাদ। সচিন তেন্ডুলকরের ক্ষেত্রে যেমন নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়ার পর এসেছিল শারজায় মরুঝড়ের মতো ইনিংস। মনোজের ক্ষেত্রেও কি এটা তেমনই হয়ে উঠছে? জবাব এল, “ক্যাপ্টেন যখন ছিলাম, তখনও সাড়ে ছয়শোর বেশি রান করেছি। আমার কাছে নেতৃত্ব মোটেই চাপ নয়। বরং উপভোগই করে এসেছি। তবে হ্যাঁ, এখন বাড়তি কাজগুলো করতে হয়। টিম মিটিং থেকে শুরু করে কে খেলবে, সেই আলোচনায় বসার মতো ব্যাপারগুলো থেকে এখন ছাড় রয়েছে। বাড়তি সময় পাওয়া যাচ্ছে। নিজের ব্যাটিংয়ে মন দিতে পারছি বেশি করে।”
এই মনোজ তিওয়ারি কি আগের চেয়ে অনেক শান্ত? আর সেটায় কি ছেলের প্রভাব? অস্বীকার করলেন না মনোজ। বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ছেলে আমাকে শান্ত করেছে। ছেলে-বউ-পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে সময় কেটে যায় দিব্যি। মানসিক ভাবে শান্তিতে রয়েছি। অন্য কিছু নিয়ে ভাবি না বাড়িতে ফিরে।” কিন্তু, টিভি-ইন্টারনেটে যখন নানা দলের ঘোষণা চোখে পড়ে, তখনও কি বিষণ্ণ হয়ে ওঠে না মন? মনোজের সোজাসাপ্টা উত্তর, “না, এখন আর মাথায় রাখি না। ওই বয়স পেরিয়ে এসেছি। এখন আর যন্ত্রণাগুলোকে আঁকড়ে থাকি না। জানি, এতে নিজেরই ক্ষতি। যখন আশা থাকে, তখন সুযোগ না পেলে একটু খারাপ লাগে। তার পর তা চলেও যায়। রেখে তো লাভও নেই। মনটা অন্যদিকে দিই তখন। ছেলের সঙ্গে খেলতে শুরু করে দিই।”
অর্থাৎ, যন্ত্রণা ভোলার মাধ্যম পেয়ে গিয়েছেন মনোজ। আর বাইশ গজে রাগ মেটানোর মঞ্চও তো হাতের সামনে মজুত!
ছবি সৌজন্য মনোজ তিওয়ারির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ