উচ্ছ্বাস: বিমানবন্দরে পতাকা উড়িয়ে স্বাগত ভক্তদের (বাঁ দিকে)। হোটেলে হাল্কা মেজাজে কিংবদন্তি। টুইটার, নিজস্ব চিত্র
তিন দশকে কলকাতা বদলে গিয়েছে। তিনি নিজেও বদলে গিয়েছেন। একমাথা ঝাঁকড়া চুল এখন আর নেই। রোদে পুড়ে গায়ের রং তামাটে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা ও আবেগের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি, মজিদ বাসকর। ভারতীয় ফুটবলের বাদশা। ফুটবলপ্রেমীদের ভালবাসার হাত থেকে বাঁচতে পুলিশের গাড়িতে বিমানবন্দর ছাড়লেন!
ইস্টবেঙ্গলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইরানের খোরামশায়ার থেকে শনিবার যখন কলকাতায় নামলেন মজিদ, তখন গভীর রাত। ভেবেছিলেন, দ্রুত হোটেলে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু অভিবাসন কাউন্টারে যাওয়ার পরেই ভুল ভাঙল বাদশার। সবাই নিজস্বী তুলতে চান। মজিদ তখন জানেন না, বিমানবন্দরের বাইরে কী অবস্থা। রাত আড়াইটের সময় যে মজিদ কলকাতায় নামবেন, তা দুপুর থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। রাত ১টা থেকেই বিমানবন্দরে আসতে শুরু করে দিয়েছিলেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই মজিদের খেলা দেখেননি। পূর্বসূরিদের কাছে শুনেই বাদশার ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। মজিদ তো শুধু ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ফুটবলার নন, আবেগের নামও। রূপকথার নায়কের মতো যাঁর আবির্ভাব ও প্রস্থান। তিন দশকেরও বেশি সময় পরে ফুটবল বাদশার প্রত্যাবর্তনে আবেগের বিস্ফোরণ তো ঘটবেই।
ভোর প্রায় ৪টে নাগাদ তিন জন আত্মীয়কে নিয়ে মজিদ বিমানবন্দরের গেটের বাইরে বেরিয়েই চমকে গেলেন। লাল-হলুদ সমর্থকদের কেউ কেউ শুয়ে পড়লেন পায়ে। অনেকেই মজিদের গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপালেন। সকলেই অন্তত এক বার ছুঁতে চান বাদশাকে। মজিদ...মজিদ...জয়ধ্বনি তো শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আশির দশকে কলকাতা ফুটবলের উন্মাদনার সাক্ষী মজিদও হতবাক। নিরাপত্তারক্ষীরা অনেক চেষ্টা করেও কিংবদন্তি ফুটবলারকে ভিড়ের মধ্য থেকে বার করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ফের বিমানবন্দরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ভেবেছিলেন, একটু পরে হতাশ হয়ে লাল-হলুদ সমর্থকেরা ফিরে যাবেন। তার পরেই মজিদকে বার করা হবে।
ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীদের। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা হতাশ হওয়া তো দূরের কথা, দ্বিগুণ উৎসাহে প্রিয় তারকার জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ভোর ৪.৩০ নাগাদ বাধ্য হয়ে অন্য গেট দিয়ে মজিদকে বার করে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় হোটেলে। রবিবার দুপুরে হোটেলে নিজের ঘরে বসে অভিভূত বাদশা বললেন, ‘‘রাত আড়াইটের সময় আমাকে দেখার জন্য বিমানবন্দরে কেউ আসবে বলে ভাবিনি। জানতাম, আমাকে যাঁর হোটেলে নিয়ে যাওয়ার কথা, তিনি শুধু আসবেন। কিন্তু গেটের বাইরে পা-দিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। এত সমর্থক শুধু আমাকে স্বাগত জানাতে এসেছেন! ওঁদের এই আবেগ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আশির দশকে। তখনও একই রকম উন্মাদনা ছিল। এত বছর পরেও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আবেগ এতটুকু কমেনি।’’
শুধু কলকাতা নয়, বাংলার খাদ্যের প্রতিও ভালবাসা কমেনি মজিদের। প্রিয় শহরে ফিরে মজে গিয়েছেন বাঙালি খাদ্যে। ঘুম থেকে উঠে হোটেলের রেস্তরাঁয় খেলেন বাঙালি খাবারই। প্রিয় বন্ধু জামশিদ নাসিরি দেখা করতে এসেছেন শুনে দ্রুত খাওয়া শেষ করে চলে এলেন নিজের ঘরে।
আশির দশকে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসঙ্গে পথ চলা শুরু করেছিলেন দু’জনে। কলকাতা ময়দানে অভিষেকও একসঙ্গে। যদিও অকালেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মজিদ-জামশিদ যুগলবন্দি। তার পরে মজিদ ফিরে গিয়েছিলেন ইরানে। জামশিদ পাকাপাকি ভাবে থেকে গিয়েছেন কলকাতাতেই। মাঝেমধ্যেই ইরান গিয়েছেন জামশিদ। কিন্তু দেখা হয়েছিল মাত্র এক বার। রবিবার সকাল থেকে জামশিদও তাই উত্তেজিত। বলছিলেন, ‘‘কলকাতা থেকে যখন চলে গিয়েছিল মজিদ, বিমানবন্দরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আবার দেখা হবে। গত কয়েক বছরে মনে হত, কলকাতায় মনে হয় মজিদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘মজিদ যখন কলকাতায় ছিল, তখন আমরা একসঙ্গে থাকতাম। দল বদলের পরে ও থাকত মহমেডান মেসে। আমি থাকতাম পার্ক সার্কাসে। তবে রোজই আমাদের দেখা হত।’’
এত দিন পরে দেখা হওয়ায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না দুই বন্ধুই। ঘরে ঢুকতেই জামশিদকে জড়িয়ে ধরলেন মজিদ। নিজের হাতে প্রিয় বন্ধুর কাপে চা ঢেলে দিলেন। স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন ফিরে গেলেন ইরানে শৈশবের দিনগুলোয়। কখনও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে কলকাতা ময়দানে। এর মধ্যেই জামশিদের স্ত্রী ফোনে মজিদকে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে মজিদ যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে।
বিমানযাত্রার ক্লান্তিতে রবিবার বিশ্রাম নিয়েছেন মজিদ। আজ, সোমবার বিকেলে প্রিয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যাবেন তিনি। ১২ নম্বর লেখা লাল-হলুদ জার্সি পরে মাঠেও নামার পরিকল্পনা রয়েছে। মঙ্গলবার মূল অনুষ্ঠান নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। শতবর্ষে জীবিত ইস্টবেঙ্গলের সব অধিনায়ককে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এ ছাড়াও সম্মানিত করা হবে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার ও নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে। আকর্ষণের কেন্দ্রে অবশ্য থাকবেন মজিদই।