ফিনিশার ধোনির শেষ ম্যাচে জেতাতে না পারার আক্ষেপ ধরা পড়েছিল কোচের কাছে। ছবি: রয়টার্স।
স্তম্ভিত! হতবাক! শকিং!
ছাত্রের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত জোরদার ঝটকা হয়েই বেজেছে চঞ্চল ভট্টাচার্যের কাছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির প্রথম কোচ ভাবতেই পারেননি, স্বাধীনতা দিবসের সন্ধেয় এমন যন্ত্রণা পেতে হবে। আর সেটাও কিনা প্রিয় ছাত্রের কাছে থেকেই।
শনিবার রাতে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি সাফ বললেন, “ধোনির ক্রিকেট সফর অসাধারণ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা খুব খারাপ। আমি ভেবেছিলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার পরই ও অবসর নেবে। কিন্তু, এত দেরি হয়ে গেল বিশ্বকাপের। যদি এই অক্টোবরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হত... যাই হোক, আমার কাছে ধোনির সিদ্ধান্ত এক কথায় শকিং। মনটা খারাপ হয়ে গেল।”
এর আগেও ধোনির সিদ্ধান্ত এ ভাবেই চমকে গিয়েছিল তাঁকে। শুধু ছেলেবেলার কোচ কেন, আচমকা টেস্টের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া, টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানো, একদিনের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া— ক্রিকেটবিশ্বকেই অবাক করে দিতে ভালবাসেন মাহি। শনিবারের ঘোষণাও সেই তালিকায় যোগ হল। কোচের কথায়, “ও যখন এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়, সেগুলো তো কাউকে বলে না। ওর যা ডিসিশন, সেগুলো পুরোপুরি নিজের। টেস্ট বলুন, একদিনের ক্রিকেট বলুন, ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়।” নিজের অবুঝ মনকেই যেন বোঝাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন: করোনাতেই কি কাড়ল ধোনির স্টাম্প, চর্চা শুরু ক্রিকেটমহলে
স্মৃতির সরণি বেয়ে পিছু হাঁটছেন তিনি। ফিরে গেলেন মুছে যাওয়া দিনগুলোয়। বললেন, “ছোট থেকেই দেখছি, ও চাইত না কেউ ওর দিকে আঙুল তোলে। ওকে নিয়ে কথা হচ্ছে, এটা পছন্দ করত না কখনও। হয়তো বিশ্বকাপের দলে নেওয়া হত না, বা অন্য কোনও ম্যাচের দলে রাখা হত না। এগুলো নিশ্চয়ই ভেবেছে ও। সেই কারণেই মনে হয় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছে।” অর্থাৎ, কারওর দয়ায় খেলব না। ধোনির এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছোটবেলারই।
তবে ‘ক্যাপ্টেন ধোনি’ ব্র্যান্ডের জন্মই হয়েছে বড়বেলায়, দাবি থাকল কোচের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে জোগিন্দার শর্মাকে শেষ ওভার দেওয়া বা ২০১১ বিশ্বকাপে রান তাড়ার সময় যুবরাজ সিংহের আগে ব্যাট করতে নামার মতো কিছু ধোনির কিছু সিদ্ধান্ত থেকে গিয়েছে দৃষ্টান্ত হিসেবে। যার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কোচ যদিও মনে করেন অধিনায়ক হিসেবে এহেন শাণিত ক্রিকেটমস্তিষ্কের পরিচয় ছোটবেলায় মেলেনি। তাঁর মতে, “২০০৭ সালে যখন ক্যাপ্টেন্সি পেল, তার পর থেকে ওর নেতৃত্ব ক্ষমতা খুলে গেল। ক্রিকেট মস্তিষ্ক অবাক করতে থাকল সবাইকে।”
ব্যাটসম্যান ধোনি আবার পরের দিকে পাল্টে ফেলেছিলেন খেলার ধরন। শুরুর দিনগুলোর ধুমধাড়াক্কা নয়, জোর দিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত থেকে ম্যাচ বের করে আনাতে। কমিয়ে দিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক শটের সংখ্যা। চঞ্চল ভট্টাচার্য যদিও অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁর যুক্তি, “প্রতিদিন তো আর রবিবার নয়। একটা প্লেয়ারের সবদিন সমান যায় না। ব্যাটসম্যান বা বোলার, সবারই ম্যাচের মধ্যে কিছুটা সময় বিশ্রাম মেলে। কিন্তু একজন কিপারের কখনও রেস্ট মেলে না। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানকে ওয়ানডে ফরম্যাটে মাঠে থাকার সময় তিনশো বলে ওঠা-নামা করতে হয়। সেটার জন্য কতটা ফিটনেসের দরকার, ভাবুন একবার। একবার অস্ট্রেলিয়ার একটা জার্নালিস্টকে ও বলেছিল, আমি কি ফিট নই নাকি, আপনি কী মনে করেন, বলুন তো। আমার তো মনে হয়, ধোনি এখনও যতটা ফিট আছে, অতটা ফিট ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে কেউ নয়। আরামসে খেলতে পারত ও। সেদিন আকাশ চোপড়াও তো এটাই বলল। বলেছিল যে যতদিন ফিট থাকবে, ধোনি খেলতে পারে।”
ইংল্যান্ডে গত বছরের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারের যন্ত্রণা ছাত্রের মধ্যে টের পেয়েছিলেন তিনি। যা ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধোনির শেষ উপস্থিতি। ম্য়াঞ্চেস্টারে সেই ম্যাচে ২৪০ রানের জয়ের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৭১ রানে পাঁচ উইকেট পড়ার পর নেমেছিলেন ধোনি। কিছুক্ষণ পরেই স্কোরবোর্ড দেখায় ৯২ রানে ছয় উইকেট। এর পর রবীন্দ্র জাডেজার সঙ্গে সপ্তম উইকেটের জুটিতে ১১৬ রান যোগ করে জয়ের আশা জাগিয়েছিলেন ধোনি। কিন্তু দলীয় ২০৮ রানে ফেরেন জাডেজা। তার পরই রান আউট হন ধোনি। ফিনিশার ধোনি কেরিয়ারের শেষ ম্যাচে জেতাতে পারেননি দলকে।
চঞ্চল বাবু বললেন, “পরে আমাকে বলেছিল যে যদি জাড্ডু আউট না হত, আমি ম্যাচ জিতিয়ে দিতাম। ও তো এমনিতে চুপচাপ থাকে। কী ভাবছে বুঝতে দেয় না। কিন্তু, প্রত্যেক মানুষেরই তো একটা ভাল লাগা, খারাপ লাগা থাকে। সেটা থাকবেই। আবেগ থেকেই যায়। তা প্রকাশ করুক বা না-করুক, থাকে। ধোনির সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই হার থেকে কষ্ট পেয়েছে। কে বলতে পারে, যদি ও ভাবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যেতে না-হত, তা হলে হয়তো অবসরের এই সিদ্ধান্তে আসতই না। অন্যরকম থাকত পরিস্থিতি। এতদিন পরে অবসর নিল এখন। যদি বিশ্বকাপ জিতত, হয়তো তখনই অবসর নিয়ে নিত।”
আরও পড়ুন: ‘তোমার অবদান অসীম’, টুইটারে জয়-ধোনি সচিন-সৌরভ-কোহালিদের
ক্রিকেটমহলে কারও কারও মনে হচ্ছে যে এই একবছর অপেক্ষা করার কোনও মানেই ছিল না। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওই পরাজয়ের পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো উচিত ছিল ধোনির। কোচের যদিও মনে হয়েছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার তীব্র আকাঙ্খাকেই ধোনিকে খেলা ছাড়তে দেয়নি। তাঁর কথায়, “ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে চেয়েছিল মারাত্মক ভাবে। আমিও ভেবেছিলাম ও খেলবেই। তবে ওর সঙ্গে এর মধ্যে কথা হয়নি। রাঁচীতে এলে ও ফোন বন্ধ করে রাখে। আর করোনার সময় ওর বাড়ির দরজা বন্ধ থাকত। কাউকে ভিতরে আসার অনুমতি দিত না।”
কিন্তু এর পর যখনই দেখা হবে, আপনি কী বলবেন? নিজের মতামত জানাবেন কি যে এই সিদ্ধান্তটা মানতে পারছেন না? কোচের গলা ভেসে এল, “ওকে বোঝানো যাবে না। উল্টে আমাকেই বুঝিয়ে দেবে। বলবে, স্যার আপ তো হামে জানতেই হ্যায়। আপসে আচ্ছা মুঝো কৌন জানে?”
ছাত্রের কোন বৈশিষ্ট সবচেয়ে ভাল লাগে? চঞ্চলবাবুর উত্তর, “ডিসিপ্লিন। এটাই ওকে এত মহান করে তুলেছে।” অবসরের সিদ্ধান্ত আইপিএলে কোনও প্রভাব ফেলবে না তো? বিশেষ করে এখন তো সবার ফোকাসে আরও বেশি করে তাকবেন এমএস ধোনি? মানছেন না কোচ। বললেন, “না, না। আরও ফ্রি হয়ে খেলবে। একদম চাপমুক্ত মনে খেলবে। ভাল খেলবে।” চেন্নাই সুপার কিংসের হলুদ জার্সিতে পুরনো ধোনিকেই যেন দেখছেন কোচ।
তফাত হল, হলদে জার্সির ধোনিই এখন ভক্তদের সান্ত্বনা। নীল জার্সির ক্যাপ্টেন কুল ঢুকে পড়েছেন প্রাক্তনদের কক্ষপথে!