sports

ছাদে গা ঘামিয়ে, দেওয়ালে বল ছুড়ে চলুক অনুশীলন

খেলোয়াড়েরা ঘরবন্দি হলে অনেক সমস্যা। চর্চার অভাবে দক্ষতায় ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু বন্ধ ঘরেও হয় অনুশীলন।

Advertisement

সৌমেশ্বর মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ০০:৫১
Share:

সক্রিয়: ঝাড়গ্রামে ঘরেই চলছে শ্যাডো প্র্যাকটিস। নিজস্ব চিত্র

মহেশ ভূপতি তখন সেরা সময়ে। কোনও এক ইভেন্টে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতা মানেই আপ্যায়নে রসগোল্লা। কিন্তু ভূপতি একটি রসগোল্লাও মুখে দেননি। শত অনুরোধ সত্ত্বেও। কারণ তিনি অনুশীলনে বেঁধে দেওয়া খাদ্যবিধি মেনে চলছিলেন। ক্রীড়াবিদদের খেলার দক্ষতার সঙ্গে ফিটনেস ভীষণই জরুরি বিষয়। বিশেষ করে খেলা যখন বন্ধ থাকে তখন একই সঙ্গে ফিটনেস এবং খেলার কৌশলের ধার বজায় রাখতে হয়।

Advertisement

হঠাৎ স্তব্ধ সময়ে সাধারণ মানুষের সমস্যা। ক্রীড়াবিদদের সমস্যাও কম নয়। কারণ ফিটনেসের উপরেই খেলোয়াড় জীবনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। নোভেল করোনাভাইরাসের জেরে লকডাউন চলছে। ফলে খেলোয়াড়েরা সকলেই ঘরবন্দি। ফিটনেস নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। জেলার বিভিন্ন খেলার কোচেরা জানাচ্ছেন, সংশয়ের কিছু নেই। ঘরে বসেই নিজেকে ফিট রাখা যাবে।
ফুটবল খেলেন শালবনির দীপক, অনুপ, রঞ্জিতেরা। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পরে সমস্ত খেলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে প্রাক্তন ফুটবলার তথা প্রশিক্ষক অমিয় ভট্টচার্য জানালেন কী ভাবে মাঠে না এসেও খেলোয়াড়েরা ফিট থাকবেন। অমিয়বাবু বলেন, ‘‘এটা একটা ছন্দপতন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের নির্দেশ মান্য করা উচিত। খেলোয়াড়েরা বাড়িতে থাকলে সাধারণ মানুষের কাছেও ঘরে থাকার বার্তা যাবে।’’ তিনি জানান, এই সময় খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে শরীরচর্চা করা উচিত। বাড়ির সামনের ছোট জায়গা বা ছাদে প্রথমে স্কিপিং করে গা ঘামিয়ে নেওয়া উচিত। তার পর ফ্রি-হ্যান্ড এক্সাসাইজ, ফিজিক্যাল ফিটনেস ট্রেনিং করা উচিত। করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও প্রতিদিন ঘাম ঝরানো উচিত। খেলোয়াড়দের খাওয়া নিয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অমিয়বাবু। তিনি জানান, লকডাউনের জন্য এখন সব খাবার পাওয়া মুশকিল। তবে ভাত, ডাল, শাক-আনাজের সঙ্গে মাছ, দুধ ও ফল খাওয়া দরকার। প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের আরেক ফুটবল প্রশিক্ষক অচিন্ত্য হ্যান্ডেল জানিয়েছে, বাড়ির মধ্যে চার ফুট জায়গা পেলেই অনেক কিছু করা যাবে। তিনিও জানিয়েছেন, স্কিপিং করা খুবই প্রয়োজন। এরপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘স্পট রান’ দেওয়া, ‘শাটল রান’ দেওয়া, ফ্রি হ্যান্ড করা, সিট আপ, ডন, পেটের ব্যায়াম করা, আর্চ করা, বিভিন্ন যোগাসন করা খুবই প্রয়োজন। এছাড়া স্পোর্টস মেডিসিনের নিয়ম মেনে চলা দরকার। তিনি জানান, এখন সাবধানে খেতে হবে। খুব বেশি খাবার খাওয়া যাবে না। পরিমাণ মতো জল খেতে হবে।

Advertisement

পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার ফুটবল প্রশিক্ষক অমিয় মাজি বললেন, ‘‘হঠাৎ করেই মাঠে আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই আমাকে ফোন করে নানা বিষয় জানতে চাইছেন। অভিভাবকদের বলেছি, ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করতে হবে। বাড়িতে বল থাকলে বাড়ির সামনে একটু প্র্যাকটিস করতে পারে। খাবার যেন সহজপাচ্য হয়। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পাতিলেবু, কমলালেবু, আঙুর, আমলকি খেলে ভাল হয়। এছাড়া ক্যাপসিকাম, ব্রকোলি, আদা, রসুন, হলুদ খাওয়া ভাল। লেটুস শাক, গ্রিন টি, ডিম সিদ্ধ ও চিকেন খেতে পারে। প্রতিদিন একটি করে কলা খেলে ভাল হয়।’’

জেলার অনেক ছেলে মেয়ে সারা বছর অ্যাথলেটিক্স অনুশীলন করেন। লকডাউনে তাঁদেরও মাঠে আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রশিক্ষক সুব্রত পান অ্যাথলিটদের বাড়ির সামনে বা ছাদে স্কিপিং করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার পর স্টেয়ারিং ট্রেনিং, স্ট্রেচিং, প্ল্যাঙ্ক, সিট আপ, পেটের ব্যায়াম-সহ খালি হাতে ব্যায়াম করতে বলছেন। জিমবল বা মেডিসিন বল নিয়ে অনুশীলন করতে পারে। বাড়িতে ডাম্বেল বা বারবেল থাকলে অনুশীলন করতে পারবেন। এছাড়া তিনি খেলোয়াড়দের হালকা ঝোল ভাত খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সঙ্গে প্রোটিন জাতীয় খাবার ও ফল খাওয়ার কথা জানিয়েছেন। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘মে বা জুন মাসে রাজ্য অ্যাথলেটিক্স মিট হওয়ার কথা ছিল। তাই ছেলে মেয়েদের ৬০-৬৫ শতাংশ চাপ দিয়ে অনুশীলন করাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়তে পারে খেলোয়াড়রা। তাই তাঁদের নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত।’’ মেদিনীপুরের আরেক প্রশিক্ষক স্বদেশ পান ছাদে ওয়াকিং, জগিং করার পর শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যায়াম করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন। একটু ওজন নিয়ে জাম্পিং করা যেতে পারে। স্ট্রেচিং ও চিন আপ করতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, অনেকেই বাড়ির সামনে জাম্প দেওয়ার পিট বানিয়েছেন। তাতে লাফ দেওয়ার কাজ করা যেতে পারে। খাওয়ার বিষেয় তিনি ছোটদের প্রতিদিন ডিম, মাছ বা মাংস যে কোনও একটি খাবার দিতে বলছেন। সারাদিনে কম পরিমাণে পাঁচবার খাওয়ার কথা বলছেন। সঙ্গে লেবু খেতে হবে। জল পান করা দরকার। ভাত, ডাল, শাক আনাজের সঙ্গে টক খেলে ভাল হয়। টিফিনে রুটি, ছাতু বা মুড়ি ছোলা খেতে বলছেন তিনি।

জেলার ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষকেরা ক্রিকেটারদের বাড়িতে থেকে অনুশীলনের পরামর্শ দিয়েছেন। মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট প্রশিক্ষক সুমিত দাস জানান, ছাদে হাঁটা, স্পট জগিং করে সিঁড়িতে ওঠা নামা করতে পারেন। এর পর ফিজিক্যাল ফিটনেসের ব্যায়াম করতে হবে। সিট আপ, পুশ আপ ও স্কিপিং করা যেতে পারে। ব্যটসম্যান ও বোলারদের শ্যাডো প্র্যাকটিস করতে হবে। বিভিন্ন শট শ্যাডো করতে হবে। বোলারদের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বল লোডিং করতে হবে। মাটিতে শুয়ে বল উপরের দিকে ছুড়ে দেখতে হবে সিম ঠিক আসছে কিনা। ফিল্ডিংয়ের জন্য দেওয়ালে বল ছুড়ে ক্যাচ প্র্যাকটিস করতে হবে। বাড়ির কাউকে নিয়ে ক্যাচ প্র্যাকটিস করা যেতে পারে। খড়্গপুরের প্রশিক্ষক পার্থ দাশগুপ্ত জানান, এই সময় খেলোয়াড়দের ফিজিক্যাল ফিটনেস ঠিক রাখা দরকার। বাড়িতে পিটি করতে হবে। বিভিন্ন ইন্ডোর গেমস খেলে মানসিক চাপ মুক্ত হতে হবে। পার্থবাবু বলেন, ‘‘অনেক অভিভাবকই ছেলেদের খাওয়া নিয়ে ফোন করেছিলেন। জানিয়েছি, ছেলেদের এই মুহূর্তে তেল ও মশলা জাতীয় খাবার দেবেন না। প্রোটিন জাতীয় খাবারের সঙ্গে দুধ ও ফল দিলে ভাল হয়।’’

পূর্ব মেদিনীপুরের ইউথ ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির সম্পাদক তথা প্রশিক্ষক বিপ্লব চক্রবর্তী জানান, জেলার বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি বিভাগের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। তার মাধ্যমেই পরামর্শ দেওয়া চলছে। ছেলেদের অনুশীলনের ভিডিয়ো ছবি গ্রুপে পাঠাতে বলা হয়েছে। বিপ্লববাবু জানান, প্রতিটি বিভাগে খেলোয়াড়দের ওজনের ভিত্তিতে আলাদা অনুশীলনের চার্ট দেওয়া হয়েছে। বড়দের অনুশীলনের ‘টার্গেট’ দেওয়া হয়েছে। ফিজিক্যাল ফিটনেসের পর ব্যাটিংয়ের শ্যাডো প্র্যাকটিস করতে বলা হয়েছে। প্রতিটি শট কমপক্ষে ১০০ বার প্র্যাকটিস করতে বলা হয়েছে। বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘শ্যাডো প্র্যাকটিস না থাকলে দু’মাস পরে ব্যাট করতে পারবে না। একজন বোলারের হাত থেকে বল ডেলিভারির পর পয়েন্ট ছয় সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাটসম্যানকে খেলতে হয়। শ্যাডো প্র্যাকটিস না থাকলে অটোমোশন আসবে না। ব্যাটসম্যান একটি শট ১২ হাজার শ্যাডো করলে অটোমোশন আসে। বোলাররাও অনুশীলন করবে। বেশি ফিটনেস প্রয়োজন কিপারদের। তাদের পায়ের জোর বাড়াতে হবে।’’

বিপ্লব বলছেন, ‘‘২০-২৫ দিন খুব ভাল না খেলে কেউ মরে যাবে না। লকডাউন মানা উচিত। বেশির ভাগ বাড়িতেই দুধ ও ডিম থাকে। এই ক’দিন ছেলেরা বাড়ির সাধারণ খাবার খাবে। ছোলা, বাদাম-সহ বাড়ির খাবার খেয়ে সুস্থ থাকতে হবে।’’ খড়্গপুরের প্রশিক্ষক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁদেরও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ফিটনেস ও শ্যাডো প্র্যাকটিসের নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমার এখানে অনেক ছেলেই সিএবি-র বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলে। তাই এখন তাঁদের বাড়িতে অনুশীলনে জোর দিতে সাধারণ খাবার খেতে বলা হয়েছে।’’

ফিটনেস মন্ত্র জপ করলে ঘরের আগল খোলার পর খেলার ধার স্বাভাবিক থাকবে। মত প্রশিক্ষকদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement