উন্মাদনা: এমনই ছিল দলবদলের উদ্দীপনা। গাড়িতে করে ইস্টবেঙ্গলে সই করতে যাচ্ছেন কৃশানু-বিকাশ। ফাইল চিত্র
ইস্টবেঙ্গলের জন্মশতবর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে আমার বন্ধু ‘ভারতের মারাদোনা’-র কথা বারবার মনে পড়ছে। সেই সময়ে কৃশানু দে-কে ওই নামেই ডাকতেন ফুটবলপ্রেমীরা।
ইরান থেকে মজিদ বাসকারকে আনার চেষ্টা হচ্ছে। কৃশানু বেঁচে থাকলে ক্লাবকে বলতাম, মজিদের পাশে রন্টুকেও সম্মান দিতে। কৃশানুকে তো রন্টু নামেই সবাই ডাকত। চুনী গোস্বামী, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসীদাস বলরামদের খেলা আমি দেখিনি। ‘পঞ্চপাণ্ডব’দেরও নয়। তার পরবর্তী সময়ে আমার চোখে মজিদ নয়, ভারতে সেরা ফুটবলারের নাম কৃশানু। স্বদেশী এবং বিদেশি মিলিয়েই বলছি। শুধু শিল্পী ফুটবলার বলেই নয়, পায়ের জাদুর জন্যও নয়, মানুষ হিসেবেও ও ছিল সকলের চেয়ে আলাদা। সেরার সেরা।
আমার সঙ্গে কৃশানুর জুটি বাঁধা সেই ১৯৮২-তে। মোহনবাগানে সই করেছিলাম একসঙ্গে। পোর্ট ট্রাস্ট থেকে রন্টু এসেছিল সবুজ-মেরুনে। আর আমি এসেছিলাম সালকিয়া ফ্রেন্ডস থেকে। আমার চেয়ে বয়সে দু’বছরের ছোট ছিল ও। রন্টুর বাড়ি ছিল দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায়, আমার হাওড়ার বলুহাটিতে। ও ছিল বাঙাল, আর আমি ঘটি। খেলতে খেলতেই কীভাবে যেন একাত্মতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৩-১৪ বছর অটুট ছিল সেই জুটি।
এর পিছনে আমাদের তখনকার মোহনবাগান কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ছিল প্রচুর। মোহনবাগানে প্রদীপদা কোচ থাকার সময় আমি, রন্টু আর বাবু মানির মধ্যে একটা ত্রি-কোণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমি আর মানি, দুই উইং দিয়ে বল তুলতাম আর রন্টু গোল করত। কখনও রন্টু বল বাড়াত আর আমি গোল করতাম। ১৯৮২ থেকে ৮৪, মোহনবাগানে খেলার সময়ই আমরা একসঙ্গে একই কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিই। ফলে একাত্মতা আরও বেড়ে যায়। ক্লাবে অনুশীলনের পর চাকরি—আমাদের জুটিকে আরও পোক্ত করে তুলেছিল।
সফর: বাইরে খেলতে যাচ্ছেন। বিমানবন্দরে সপরিবার কৃশানু-বিকাশ।
একসঙ্গে দিনের ১৪-১৫ ঘণ্টা থাকা, খাওয়া, অফিস করা, ঘোরা ফেরার প্রভাব তো মাঠে পড়বেই। পড়লও। মোহনবাগানের হয়ে সফল হওয়ার পর নাটকীয় ভাবে আমাদের সই করিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন কর্তারা। আমাদের মধ্যে একাত্মতা এতটাই ছিল যে, আমরা তিনবার তিনটি অফিসে চাকরি করেছি এবং ছেড়েছিও একসঙ্গে। দলবদলও করেছি একই সঙ্গে। ওর অকাল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যা ছিল অটুট। প্রত্যেক বার দলবদলে আমাদের সই করানোর জন্য রোমাঞ্চকর সমস্ত ঘটনা ঘটত। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের কর্তাদের হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের লুকিয়ে থাকতে হত নানা জায়গায়। কখনও আমার বাড়ি বা কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে, কখনও বা রন্টুর বাড়িতে। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক এত ভাল ছিল যে, স্ত্রী-রাও জড়িয়ে পড়তেন এই দলবদলের যুদ্ধে। এখনকার মতো সেই সময় টোকেন সিস্টেম বা চুক্তি পত্রই শেষ কথা বলত না। যে ক্লাব কর্তারা আমাদের দখলে নিতেন, তাঁরাই নিয়ে গিয়ে সেই ক্লাবে সই করাতেন।
মোহনবাগানে আমার জার্সির নম্বর ছিল সাত। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেলা ভাল লাগত বলে ওঁর জার্সির নম্বরটা নিয়েছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, কৃশানু পরত চব্বিশ নম্বর জার্সি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে এসে কৃশানু বেছে নিয়েছিল আট নম্বর জার্সি। সাত আর আট/জেতাবে কৃশানু-বিকাশ—এই স্লোগানই তখন প্রতিনিয়ত শোনা যেত ইস্টবেঙ্গলের গ্যালারিতে। আমাদের জুটির সাফল্য সবথেকে বেশি লাল-হলুদ জার্সিতেই। ওই ছয় বছর অদৃশ্য একটা তার যেন জুড়ে থাকত দু’জনের মধ্যে। ম্যাচে ও বল পেলেই আমি ঠিক বুঝতে পারতাম কোথায় পাস দেবে। আবার আমি বল পেলে ও বুঝতে পারত কোথায় দাঁড়াতে হবে। সবাই বলত ইশারায় না কি চলত সব। সেটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে একটি চমকপ্রদ ঘটনায়। সে বার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে কলকাতা লিগে খেলা পড়েছিল মহমেডান স্পোর্টিংয়ের। মহমেডানে তখন চিমা ওকোরি খেলছে। সবে আমরা মোহনবাগান ছেড়ে লাল-হলুদ জার্সি পরেছি। ভাল খেলার জন্য আমি আর রন্টু তৈরি হয়ে মাঠে এসেছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চিমাকে হারাতেই হবে। কিন্তু মাঠে গিয়ে শুনলাম, কৃশানুর নাম প্রথম একাদশে রাখেননি প্রদীপদা। কৃশানু কান্নায় ভেঙে পডেছিল সে দিন। ওকে ও ভাবে কখনও ফুঁপিয়ে উঠতে দেখিনি। প্রথমার্ধে চিমা গোল করে গেল। বিরতিতে ইস্টবেঙ্গল পিছিয়ে। জামশিদ পেনাল্টি মিস করল। গ্যালারি থেকে সমর্থকেরা চিৎকার শুরু করে দিলেন, কৃশানুকে মাঠে নামাতেই হবে। বাধ্য হয়েই কৃশানুকে নামালেন প্রদীপদা। তারপর শুরু হল সেই ঝড়। একার পায়ের জাদুতে ২-১ গোলে কৃশানুই জিতিয়ে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। প্রথম গোলটা আমাকে পাস বাড়াল রন্টু। অন্যটা দেবাশিস রায়কে। খেলার শেষে রিজার্ভ বেঞ্চে না গিয়ে টানেল দিয়ে সোজা ড্রেসিংরুমে চলে গিয়েছিল ও। বন্ধুকে কখনও এমন রাগতে দেখিনি। দেখিনি ক্ষোভ জানাতে। এরপর ইস্টবেঙ্গলে আমরা দু’জনে মিলে ফুল ফুটিয়েছি। দু’জন বলা ভুল। আমি বলতাম, তুই অফিসার আর আমি কেরানি। তোর প্রতিভার সঙ্গে আমার তুলনা করিস না। এটা শুনে কৃশানু বলেছিল, প্রকৃত বন্ধুত্বের কোনও রং হয় না। তুলনা হয় না। দু’জনে দু’জনকে সমান ভাবলেই বন্ধুত্ব হয়।
শতবর্ষ ঘিরে ইস্টবেঙ্গল সেজে উঠছে নতুন আঙ্গিকে। আর আমি? আমার বন্ধুই তো পাশে নেই! সব কিছু কেমন যেন শূন্য আর অসম্পূর্ণ লাগে।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)