অভিমানী সবুজ তোতা। ছবি: ব্যারেটোর ফেসবুক পেজ থেকে
হোসে রামিরেজ ব্যারেটো। এমন এক নাম যা ময়দানের সমস্ত ক্লাবের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। বাগানের ‘সবুজ তোতা’ একসময়ে ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে আপন করে নিয়েছিল কলকাতার ফুটবল জনতাও। তিনি খেলতে নামলেই ময়দানে গান হত, ‘শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ব্যারেটোই ভরসা’।সবুজ-মেরুন জনতার মনে তিনি এখনও রয়ে গেলেও, কর্তারা কি ভুলে গেলেন তাঁকে? বুধবার ফেসবুকে একটি পোস্টে পাওয়া গেল অভিমানী সবুজ-তোতাকে।
২৯ জুলাই মোহনবাগান দিবস উদযাপন করা হল মোহনবাগানে। সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদারের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু, দেখা যায়নি সবুজ-তোতাকে। খবরের ভিতরের খবর হল, ডাকাই হয়নি ব্যারেটোকে। সেই কথাই তিনি জানিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্রাজিলীয় তারকা লেখেন, ‘‘অবসরের পর মোহনবাগান আমাকে কোনও অনুষ্ঠানে আর আমন্ত্রণ জানায়নি। দুঃখ হয়েছে ঠিকই। তবে আমি মোহনবাগান ক্লাবকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ক্লাবের হয়ে আমার গোল সংখ্যা এবং দলের হয়ে আমার অবদান যেন ভোলা না হয়।’’
এই লেখার সঙ্গে তিনি একটি ছবিও পোস্ট করেন, যাতে দেখা যাচ্ছে সেই বিখ্যাত ১০ নম্বর মোহনবাগান জার্সি পরে গোলের পর দু’ হাত তুলে ঈশ্বরকে আকাশে খুঁজছেন। ব্যারেটোর এই ছবি আজও মনে রেখেছেন মোহনবাগান সমর্থকরা।
দু’ দফায় মোহনবাগানে খেলেন ব্যারেটো। ১৯৯৯ সালে প্রথম গঙ্গাপারের ক্লাবে যোগ দেন তিনি। ২০০৪ সালে ক্লাব ছেড়ে চলে গেলেও ফিরে আসেন ২০০৬ সালে। বহু দল তাঁকে পাওয়ার জন্য ঝাঁপালেও, মোহনবাগান ছেড়ে যাননি তিনি। সবুজ-মেরুন জার্সি পরে ৩৭১টি ম্যাচে তিনি করেছেন ২২৮ টি গোল। একক দক্ষতায় মোহনবাগানকে জিতিয়েছেন বহু কঠিন ম্যাচ। কলকাতা লিগ, জাতীয় লিগ, ফেডারেশন কাপের মতো বহু ট্রফি মোহনবাগান ঘরে তুলেছে তাঁর সময়ে। মোহনবাগান সমর্থকরা তাঁকে ‘কলকাতার যিশু’ শিরোপা দিয়েছিলেন। দলের প্রতি দায়বদ্ধতা তিনি প্রমাণ করেছেন বার বার। ইস্টবেঙ্গলকে ৫-৩ হারানো ম্যাচের শেষে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ড্রেসিং রুমে ঢুকেছিলেন ব্যারেটো। তাঁর সতীর্থ মার্কোস পেরেরার চোখের নীচ থেকে রক্ত ঝরছে। সেই সময়ের ক্লাব-সচিব অঞ্জন মিত্র বাগানের সাজ ঘরে ঢুকেই ব্যারেটোর গাল টিপে দিয়েছিলেন। সমর্থকদের ভালবাসার দাম কী ভাবে দিতে হয়, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। শেষ ম্যাচের আগে ব্যারেটো বলে গিয়েছিলেন, ‘‘চিরকাল হৃদয়ে থাকবে মোহনবাগান।’’ শেষ ম্যাচেও গোল করেছিলেন তিনি। কিন্তু, আজ তাঁর এই পোস্ট বুঝিয়ে দিয়েছে সেই দায়বদ্ধতার কথা মনে রাখেনি ক্লাব।
মোহনবাগান প্রেসিডেন্ট গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে, তিনি ব্যারেটোর এই পোস্টের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যান। বর্ষীয়ান কর্তা বলেন, “ব্যারেটোর অবদান কখনওই আমরা ভুলতে পারি না। ওঁর অভিমান আমরা অবশ্যই ভুলিয়ে দেব। বড় অনুষ্ঠান হলে অনেক সময় ভুল হতেই পারে। তা কখনওই মনে রাখা উচিত নয়। ব্যারেটো আমাদের ঘরের ছেলে, ওকে আমরা কখনওই ভুলতে পারি না। হয়তো আমাদের তরফ থেকে ভুলত্রুটি হয়ে গিয়েছে, আমি এ ব্যাপারে অবশ্যই খোঁজ নেব।”
আরও পড়ুন: জনপ্রিয়তায় ফুটবলারদেরও পাল্লা দিতেন কোচ পিকে
আরও পড়ুন: দু’প্রধানের অনুশীলনে ঝামেলা
প্রাক্তন ফুটবলারকে ভুলে যাওয়া, এই ঘটনা নতুন নয়। কলকাতার দু’ প্রধানেই এরকম ঘটনা ঘটেছে বহু বার। ১০০ বছরের অনুষ্ঠানে ইস্টবেঙ্গল না ডাকায় মনোকষ্টে ভুগছেন বহু প্রাক্তন ফুটবলার। সবুজ-মেরুন-এর আইকন গোষ্ঠ পাল-এর পরিবার মোহনবাগান দিবসে বহুদিন ডাক পান না। ২৯ জুলাই গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাদদেশে অনশনে বসেছিলেন গোষ্ঠ পালের ছেলে নীরাংশু পাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করছে, সমর্থকদের ভালবাসা, আন্তরিকতা ফুটবলাররা পেলেও কর্তারা সম্মান জানাতে ভুলে যাচ্ছেন।
ব্যারেটোর পোস্টেও দেখা যাচ্ছে সমর্থকদের বাঁধ ভাঙা আবেগ। উপচে পড়ছে তাঁর প্রতি ভালবাসা। যে আবেগ, যে ভালবাসা খেলার সময়ে পেয়েছিলেন ব্রাজিলীয়-তারকা, সেই ভালবাসার কিছুটাও যদি কর্তারা দেখাতেন, তা হলে হয়তো এ ভাবে কষ্ট পেতে হত না সবুজ-তোতাকে।