স্মরণীয়: ১৯৬৬ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ট্রফি হাতে জ্যাক চার্লটন।
ইংল্যান্ডের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক কারা? বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবলপ্রেমী নায়কের আসনে বসাবেন ববি মুর, গর্ডন ব্যাঙ্কস, জেফ হার্স্ট, ববি চার্লটনকে। কিন্তু ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের বিশ্বেসেরা হওয়ার নেপথ্যে আরও এক জন ছিলেন— জ্যাক চার্লটন। ববি চার্লটনের দাদা। ডিফেন্ডার জ্যাকের জন্যই পুরো বিশ্বকাপে মাত্র তিনটি গোল খেয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু কখনও ববি মুর-ববি চার্লটনদের ছায়া থেকে বেরোতে পারেননি।
জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৩৫টি ম্যাচ খেললেও আমি ইংল্যান্ড ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার মনে করি জ্যাককে। ষাটের দশকে ওঁর মতো আধুনিক ডিফেন্ডার বিশ্বফুটবলে খুব বেশি ছিল না। রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি সেটপিসের সময় বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে উঠে গিয়ে গোল করতে পারতেন।
শনিবার ৮৫ বছর বয়সে বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের রক্ষণের অন্যতম স্তম্ভের মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকেই অনেক পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। জ্যাকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তবে ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রাক্তন সতীর্থ টেরি কুপারের কোচিংয়ে দীর্ঘ দিন খেলেছি আমি। খেলা ছাড়ার পরে সহকারী হিসেবেও কাজ করেছি। টেরির কাছেই জ্যাকের নানা চমকপ্রদ কাহিনি শুনেছি।
প্রায় ছ’ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার জ্যাক এমনিতে খুব শান্ত স্বভাবের ছিলেন। কথা কম বলতেন। কিন্তু মাঠে নামলেই আশ্চর্যজনক ভাবে বদলে যেতেন। বিপক্ষের ফুটবলারদের জন্য কোনও মায়া-দয়া থাকত না। টেরির কাছেই শুনেছি, পাশ দিয়ে কেউ বল নিয়ে চলে যাবে, মানতেই পারতেন না জ্যাক। সেই সময় ফুটবলে এত কড়াকড়ি ছিল না। তাই শরীরকে কাজে লাগিয়ে আটকাতেন বিপক্ষের ফুটবলারদের। তবে কেউ তাঁকে ইংল্যান্ডের সেরা ডিফেন্ডার বললে খুব অসন্তুষ্ট হতেন। বলতেন, ‘‘আমার খেলা নিখুঁত নয়। অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চেষ্টা করি পরিশ্রম দিয়ে খামতি পূরণ করার।’’
জ্যাক ও ববি চার্লটনের জন্ম যেখানে, সেই অ্যাশিংটন হল খনি অঞ্চল। এই কারণেই হয়তো কাঠিণ্য ও আগ্রাসী মানসিকতা ছিল দুই ভাইয়ের চরিত্রে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কখনও হার মানতেন না তাঁরা। টেরি বলতেন, ‘‘লিডস ইউনাইটেডে জ্যাকের সঙ্গে খেলার সময় একদিকে যেমন নিশ্চিন্তে থাকতাম, পাশাপাশি ভয়ও করত। ওর ট্যাকলে কত ফুটবলার যে আহত হয়ে মাঠ ছেড়েছে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। অথচ কখনওই মাথা গরম করত না জ্যাকি। ঠান্ডা মাথায় এমন ট্যাকল করত যে, আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকত না ফুটবলারদের।’’
১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। তা সত্ত্বেও আমার জীবনে ওঁর প্রভাব কখনও অস্বীকার করতে পারব না। এই কারণেই হয়তো সারা জীবন ফরোয়ার্ডে খেলা সত্ত্বেও কোচিং শুরু করার পরে আমার প্রথম লক্ষ্য থাকত রক্ষণ মজবুত করা। এটা হয়েছিল টেরির কাছে নিয়মিত কিংবদন্তি ডিফেন্ডারের কাহিনি শুনে। লিডস ইউনাইটেডে খেলার সময় টিম মিটিংয়ে সতীর্থদের জ্যাক বলতেন, রক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাদের। আমি আর টেরি তো আছি। তোমরা গোল করার চেষ্টা করো। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সময়ও একই কথা বলতেন ভাই ববিকে। এর ফলে মিডফিল্ডার ও ফরোয়ার্ডরা চাপমুক্ত থাকতে পারতেন।
জ্যাকের জন্যই সারা বিশ্ব চিনেছে লিডস ইউনাইটেডকে। প্রায় সাড়ে সাতশো ম্যাচ খেলেছেন ক্লাবের হয়ে। লিডসকে প্রথম ডিভিশন লিগ ও এফএ কাপে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। আয়ারল্যান্ড ফুটবলে বসন্ত আনার নেপথ্যেও জ্যাক। ওঁর কোচিংয়েই ১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল আয়ারল্যান্ড। ১৯৯৪ সালে ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব ডাবলিন’ পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করে আয়ারল্যান্ড।
তবে একটা আক্ষেপ কখনও ভুলতে পারেননি জ্যাক। পশ্চিম জার্মানিকে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড ৪-২ হারালেও দু’গোল খাওয়ার যন্ত্রণা সারা জীবন কাঁটার মতো বিঁধে ছিল জ্যাকের মনে।