নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার ভাবনা

ধোনি নিয়ে সিদ্ধান্তের লগ্ন উপস্থিত, নজর পন্থেই

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ধোনি নিজে এখনও দলকে কিছু জানাননি। ২০১৪-র ডিসেম্বরে মেলবোর্নে টেস্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিংরুমে এসে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর টেস্ট খেলতে চান না। সতীর্থেরা বিস্মিত হয়ে যান সেই সিদ্ধান্তে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

লন্ডন শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৯ ০৪:২৯
Share:

বদল: ধোনির ব্যাটন তুলে নিতে চলেছেন ঋষভই। ফাইল চিত্র

রবিবার লর্ডসের ফাইনাল চলাকালীন টুইটারে এক শিল্পীর আঁকা একটি ছবি খুব জনপ্রিয় হল। যাকে ওয়াংখেড়ের সেই ২ এপ্রিল, ২০১১-র ঐতিহাসিক বিজয়োৎসবের দৃশ্যের রিমেক বলা যেতে পারে।

Advertisement

আট বছর আগে ওয়াংখেড়েতে ছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। বিশ্বকাপ জেতার পরে তাঁকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন বিরাট কোহালিরা। আর তেরঙ্গা হাতে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ঘরের মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন সচিন। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালীন সংগ্রহশালায় ঢুকে রয়েছে সেই ছবি।

রবিবারের ছবিতে শিল্পী সচিনের জায়গায় কোহালির কাঁধে বসিয়ে দিয়েছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে। নীচে লেখা, সব স্বপ্ন সত্যি হতে হতেও সত্যি হয় না। সারমর্ম: লর্ডসে এই ছবি দিয়েই দারুণ ভাবে শেষ হতে পারত কোহালিদের অভিযান। তা না হওয়ায় এখনও চলছে বিলাপ।

Advertisement

ছবিটা সত্যি হল না ঠিকই, কিন্তু ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে নিয়ে বিশ্বকাপ মিটে যাওয়ার পরে সব চেয়ে বেশি কাটাছেঁড়া হতে থাকলে অবাক হওয়ার থাকবে না। আগামী কয়েক দিন ভারতীয় ক্রিকেট মহল আলোড়িত হতে পারে এই প্রশ্ন নিয়ে যে, নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ক্রন্দনরত ধোনির প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তটাই ভারতের জার্সিতে ধোনির শেষ দৃশ্য হয়ে থাকল কি না?

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ধোনি নিজে এখনও দলকে কিছু জানাননি। ২০১৪-র ডিসেম্বরে মেলবোর্নে টেস্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিংরুমে এসে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর টেস্ট খেলতে চান না। সতীর্থেরা বিস্মিত হয়ে যান সেই সিদ্ধান্তে। তত দিনে তাঁর টেস্ট ফর্ম এবং অধিনায়কত্বের রেকর্ড দু’টোই মারাত্মক ভাবে পড়ে গিয়েছে। উত্তরসূরি হিসেবে কোহালিও যে তৈরি, সেটাও বুঝতে পারছিলেন ধোনি।

কিন্তু ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে নিউজ়িল্যান্ডের কাছে হারের পরে মেলবোর্নের মতো কিছু বলেননি ধোনি। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, ড্রেসিংরুমে সে দিন বক্তব্য রাখেন হেড কোচ রবি শাস্ত্রী এবং অধিনায়ক বিরাট কোহালি। প্রাক্তন অধিনায়ক এবং দলের সব চেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারকে যেমন কেউ বক্তব্য রাখতে বলেননি, তেমনই তিনি নিজেও কিছু বলার উদ্যোগ নেননি।

ধোনির এই নীরবতা নিয়েই আপাতত ওয়াকিবহাল মহলে জল্পনা চলছে। প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের পাশে কেউ কেউ দাঁড়ালেও গরিষ্ঠ অংশের বিশ্লেষণ, তিনি আর আগের মতো ম্যাচউইনার নন। প্রচুর বল নষ্ট করছেন। স্ট্রাইক রেট পড়ে গিয়েছে মারাত্মক ভাবে। বড় স্ট্রোকও সে ভাবে আর নিতে পারছেন না। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে হাফ সেঞ্চুরি করলেও ৭২ বল খেলে সেই রান করেছেন। গোটা ইনিংসে মাত্র একটা বাউন্ডারি এবং একটা ওভার বাউন্ডারি। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রভাবশালী মহলেও কেউ কেউ এই যুক্তি ফেলে দিতে পারছেন না যে, সে দিন ধোনি যদি দু’তিনটে বাউন্ডারিও মেরে দিতে পারতেন, তা হলে শেষের চার ওভারে গিয়ে অতটা চাপ তৈরি হত না। এঁদের এক জনের কথায়, ‘‘দু’জন ক্রিজে ছিল। কিন্তু এক জনই বড় শট নিচ্ছিল। এ রকম কঠিন টার্গেট এক জনের বড় স্ট্রোক নেওয়ার দক্ষতার উপর দাঁড়িয়ে জেতা সম্ভব নয়।’’ তাঁর যুক্তি যে ফেলে দেওয়ার মতো নয়, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের স্কোরবোর্ড বলে দিচ্ছে। জাডেজার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৩০.৫০, ধোনির ৬৯.৪৪।

যত সময় যাচ্ছে, পরিষ্কার হচ্ছে যে, ভারতীয় ক্রিকেটের হাইকম্যান্ডে ধোনির ভবিষ্যৎ নিয়ে জোরালো আলোচনা অবশ্যম্ভাবী। এর পরে ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর রয়েছে। ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি, টেস্ট— সবই আছে সূচিতে। সেই সফরের দল নির্বাচনী সভার আগেই হয়তো ধোনি নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই মুহূর্তে শীর্ষস্থানীয় মহলে ভোটাভুটি হলে ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের পক্ষে খুব বেশি সমর্থন থাকবে কি না, বলা কঠিন। প্রভাবশালী মহলের এক কর্তার কথায়, ‘‘কিংবদন্তিদের কেরিয়ারও একটা সময় শেষ হয়। সকলকেই যেতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেটে সুনীল গাওস্কর, কপিল দেব, সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কিংবদন্তিদেরও তো অবসর নিতে হয়েছে। ক্রিকেট কি থেমে থেকেছে?’’ ধোনি নিয়ে এর চেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য এই মুহূর্তে আর কিছু হতে পারে না।

এখন কথা হচ্ছে, ধোনি নিজে কী করবেন? আশেপাশের পরিবেশ যে ভারী হয়ে উঠছে, তিনি কি বুঝছেন না? যে সতীর্থেরা এত দিন সমর্থন করে যাচ্ছিলেন, তাঁরা কি গোটা বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাটিং দেখার পরেও একই রকম ভাবে পাশে দাঁড়াবেন? আবেগ যা-ই বলুক, বাস্তব বলছে, সংশয় আছে। বিরাট কোহালির সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক ধোনির। ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়ক এবং তাঁর উত্তরসূরির মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস বেশিটাই তিক্ততার। কিন্তু ধোনি-কোহালি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে থেকে যাবেন। বিশ্বকাপের মধ্যে আটত্রিশতম জন্মদিনেও কোহালি টুইট করেছেন, ‘‘তুমি এখনও আমাদের ক্যাপ্টেন। বরাবর তা-ই থাকবে।’’ যখন সচিন তেন্ডুলকরের মতো কিংবদন্তিও ধোনিকে আক্রমণ করেছেন, কোহালি পাশে দাঁড়িয়েছেন। রবি শাস্ত্রী সেমিফাইনাল হারের পরেও বলেছেন, ধোনি আর জাডেজার পার্টনারশিপ না হলে খেলা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত।

তবু ক্রিকেট যে নির্মম বাস্তবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কোহালিদের! কে ভেবেছিল, লর্ডসে আসার আগেই বিদায় নিতে হবে তাঁদের। আর পরাজয়ের চিতাভস্ম থেকেই তাই কথা উঠেছে নতুন দল গড়ে তোলার। এবং, সেই নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার ডাক উপেক্ষা করা কঠিন হবে কোহালিদের পক্ষেও। কয়েক দিন আগেও এ রকম বিশ্বকাপের পরে যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থাকত, তা হলে প্রশ্ন উঠত, ধোনি কি যাবেন? এখন সেই প্রশ্নটাই ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ধোনি কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবেন? তিনি যে আটত্রিশ বছরের ধোনি এবং উইকেটকিপিংয়ে ক্ষিপ্র থাকলেও ব্যাটিংয়ে মরচে ধরেছে, লুকোনোর উপায় নেই।

যা পরিস্থিতি, ধোনিকে নিয়ে সিদ্ধান্তের লগ্ন উপস্থিত। প্রভাবশালী মহল তাঁর উত্তরসূরিও বেছে রেখেছে— ঋষভ পন্থ। সেমিফাইনালে যতই তিনি বাজে স্ট্রোক খেলে উইকেট বিসর্জন দিয়ে আসুন, পন্থই যে ভবিষ্যৎ তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাঁকেই পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে। সামনের বছরেই রয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেখানে ধোনির যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। পন্থই হবেন দলের এক নম্বর উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। পরের পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ ২০২৩-এ। ভাবা হচ্ছে, এখন থেকে তৈরি করা হলে চার বছর পরে পন্থ হয়ে উঠতে পারেন তুরুপের তাস। তেমনই ছেঁটে ফেলা হবে দীনেশ কার্তিকের মতো মাঝারি মানের ক্রিকেটারদের। চার নম্বর হিসেবে নতুন কাউকে তৈরি করা হবে। নজরে আছেন কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলা শুভমান গিল, দিল্লি ক্যাপিটালসের শ্রেয়স আইয়ারের মতো তরুণরা।

প্রশ্ন হচ্ছে, ধোনি কি সময়ের ধ্বনি শুনতে পেয়ে নিজে থেকে সরে দাঁড়াবেন? নাকি বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কঠিন কাজ করতে হবে নির্বাচকদের? ভারতীয় ক্রিকেটে অতীতে কয়েক জন তারকা ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচকদের তরফে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে যে, তুমি নিজে যদি সরে না দাঁড়াও আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধোনির ক্ষেত্রেও কি জল সে দিকে গড়াবে?

ওয়াকিবহাল মহলে এক জনের কথায়, ‘‘টেস্ট ক্রিকেটে দলের জন্য অবদান রাখতে পারছে না দেখে নিজেই সরে দাঁড়িয়েছিল ধোনি। এখানেও যদি নিশ্চিত থাকে আর পারবে না, নিজেই চলে যাবে। কাউকে কিছু বলতেও হবে না।’’ তাঁকে দীর্ঘ দিন ধরে কাছ থেকে দেখা আর এক জন বললেন, ‘‘সাড়ম্বর ফেয়ারওয়েলে কখনও বিশ্বাস করে না ধোনি। নিঃশব্দে চলে যাওয়াটাই ওর ধরন। বিশ্বকাপ হ্যাংওভার কাটিয়ে, পরিবারের সঙ্গে কয়েক দিনের ছুটি উপভোগ করে যদি বোর্ডকে একটা ই-মেল পাঠিয়ে বলে দেয়, আমি চললাম, অবাক হব না।’’

বিশ্বকাপ শেষ, ধোনি নিয়ে চর্চা, কৌতূহল আর জল্পনা থামার লক্ষণ নেই। বরং যা ইঙ্গিত, আগামী কয়েক দিনে তা আরও বেড়ে যেতে পারে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement