বিদায়: শেষ বারও চেন্নাই সুপার কিংসকে ট্রফি জেতান ধোনি। জল্পনা চলছে এটাই কি তাঁর শেষ মরসুম? ছবি টুইটার।
সেই নিঃশব্দে চলে যাওয়া। বর্ণাঢ্য বিদায়ী সংবর্ধনার সুযোগটুকু পর্যন্ত কাউকে না দেওয়া। চিরাচরিত মাহি-ভঙ্গি।
কী মেলবোর্নে সাদা জার্সিতে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সময়। কী ওয়ান ডে থেকে বিদায় নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের উপরে পাকাপাকি ভাবে পর্দা টেনে দেওয়ার মুহূর্তে। কী চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়কত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর লগ্নে। ফিনিশারের রহস্যভেদ যেমন করতে পারতেন না বোলাররা, বিদায়বেলায় পুষ্পবৃষ্টির বরাত পাওয়াও অধরাই থেকে গেল ক্রিকেট-ভক্তদের।
তিনি— মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যে পুষ্পবৃষ্টিতে বিশ্বাসই করেন না। মুকেশের সেই বিখ্যাত গানটাই তো শুনিয়ে রেখেছেন— ম্যায় পল দো পল কা শায়র হুঁ/পল দো পল মেরি কহানি হ্যায়/পল দো পল মেরি হাসতি হ্যায়!’’ তিনি চলে যাবেন আপন খেয়ালে। আপন সময়ে। যখন তাঁর মনে হবে, মুহূর্তটা পেরিয়ে গিয়েছে। ফিনিশার নিশ্চয়ই জানবেনই, কখন শেষ করতে হয়।
ধোনি এমন এক চরিত্র, যাঁকে তাঁর ঘনিষ্ঠরাও বুঝে উঠতে পারেননি। কখন যে তাঁর মাথায় কী চলছে! ভিভিএস লক্ষ্মণ অবসর নেবেন বলে তাঁকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করে পাননি। সাধারণ ভাবে যে কেউ মনে করবে, ক্যাপ্টেন নিশ্চয়ই কল-ব্যাক করবে। ধোনির দিক থেকে সে রকম কোনও উদ্যোগ দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন লক্ষ্মণ। বোলিং কোচ হিসেবে চাকরি হারানোর সময় বেঙ্কটেশ প্রসাদ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, ‘‘এত দিন টিমের সঙ্গে কাটালাম। ক্যাপ্টেন এক বার ফোনটা তো ধরতে পারত। একটা থ্যাঙ্ক ইউ-ও কী বলতে পারত না।’’
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এ রকমই। মাঠে যেমন আবেগহীন, মাঠের বাইরেও ভাবলেশহীন। মহাতারকা হয়েও যিনি তারকাপ্রথায় বিশ্বাস করেন না। তাঁর আমলে সব চেয়ে বেশি অবসরের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তারকাদের। আর সে সব ফিরিস্তি খুল্লমখুল্লা তাঁর বায়োপিকেও রাখতে দ্বিধা করেননি। যেমন বিবাহিত হয়েও গোপন করেননি তাঁর এক প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল।
গোলকিপার থেকে উইকেটকিপার, সেখান থেকে ভারতীয় দল, দুনিয়ার সেরা ফিনিশার, দু’দু’বারের বিশ্বকাপজয়ী। যিনি খড়গপুর স্টেশনে টিকিট কালেক্টরের কাজ করতেন, টেনিস বলে হেলিকপ্টার শট মেরে বেড়াতেন, কয়েক বছরের মধ্যে তিনিই ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ হাতে তুলবেন, কে ভেবেছিল! যে কিনান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তাঁর বাবা ওয়াটারপাম্প চালাতেন, সেখানেই এক দিন পূজিত হবেন তাঁর পুত্র, কে জানত!
রূপকথাকে সত্যি করে দেওয়া মহানায়ক তিনি। আর তার জন্য কোনও আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে ছিল না। ২০০৭-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের পরে বাড়িতে হামলা হয়েছে। কয়েক মাস পরে তারাই আবার জয়ধ্বনি দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পরে। কয়েক দিনের তফাতে কাঁটা ও ফুলের অভ্যর্থনা সারাজীবনের শিক্ষা দিয়ে যায় ধোনিকে। সাফল্যে উচ্ছ্বাসের আলোয় ভেসে যেও না, ব্যর্থতায় তা হলে অন্ধকার অপেক্ষা করবে। রাঁচীর মতো ছোট শহর থেকে উত্থান ঘটিয়ে মেট্রো শহরের আধিপত্যের বেড়া ভাঙার পথিকৃৎ তিনি। ফিল্ডিং, ফিটনেস, পাওয়ারহিটিংয়ে বিপ্লব ঘটানো সংস্কারক। ইয়ান চ্যাপেলের মতো যিনি কোট-টাই-ব্লেজ়ারের জগৎ থেকে ভারতীয় ক্রিকেটকে বার করে এনে জিন্স-টি শার্টের ‘স্ট্রিটস্মার্ট’ দলে রূপান্তরিত করে দিয়ে গেলেন। অদ্ভুত সব অঙ্ক যাঁর মাথায় ঘোরে। এক বার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘‘আমি হিসাব করে দেখেছি, ৬৫ লক্ষ টাকা থাকলেই অবসর নিয়ে নিতে পারব!’’
নিজে মহানায়ক হয়েও যাঁর কোনও স্বপ্নের নায়ক নেই। কখনও ব্যাট জড়িয়ে ধরে ঘুমোননি। বিরাট কোহলির যেমন ক্রিকেট স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল সচিন তেন্ডুলকরের শারজায় মরুঝড়ের ইনিংস দেখতে দেখতে, ধোনির তেমন কোনও কাহিনি নেই। বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজে বসে কিং ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে দেখা করবেন কবে জানতে চাওয়ায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর মিলেছে, ‘‘দেখি, যদি মাঠে পেয়ে যাই তো দেখা করে নেব।’’
সচিন তেন্ডুলকরকে ভাল লাগত, এই যা। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম বার সচিনের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ হারিয়ে দুঃখ পেয়েছিলেন। তখন তাঁদের ক্রিকেট সংস্থার ভিতরেই চক্রান্ত করে খবরটা দেরিতে দেওয়া হয়। টিমে আছেন, যখন জানতে পারলেন, তত ক্ষণে কলকাতার সব ট্রেন চলে গিয়েছে। ভাবী জামাইবাবুর উদ্যোগে সড়ক পথে গাড়ি করে দমদম বিমানবন্দর পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। তাতেও লাভ হয়নি। বিমানবন্দরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফ্লাইট উড়ে গিয়েছে।
ধোনির আর সেই ম্যাচে খেলা হয়নি। সচিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ অবশ্য খুব শীঘ্রই ঘটল। মজার গল্প শোনা যায় সেই ম্যাচ নিয়ে। মাঠে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে ঢুকে নিজের দলের ক্রিকেটারদের কাছে না গিয়ে সচিনের দিকে জলের বোতল এগিয়ে দিলেন মাহি। কে জানত, এক দিন সেই সচিনই নির্বাচকদের কাছে বলবেন, ‘‘আমাকে আর অধিনায়ক হিসেবে ভাববেন না। ধোনিকে ক্যাপ্টেন করুন।
ও-ই যোগ্য নেতা।’’
২০০৭-এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু। ২৪ মার্চ, ২০২২, শেষ হয়ে গেল এক স্বপ্নের যাত্রা। আর কখনও টস করতে যাবেন না ধোনি। কোনও জার্সি পরেই নয়। ট্রফি আলমারিতে ঝকঝক করবে দু’টি বিশ্বকাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, চারটি আইপিএল, দু’টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, সঙ্গে ন’বার আইপিএল খেলার অবিশ্বাস্য রেকর্ড।
হয়তো ফুরিয়ে আসছে ব্যাট হাতে সেই দুর্ধর্ষ ম্যাচউইনারের জীবনও। ‘মাহি মার রহা হ্যায়’ তো সেই কবেই থেমে গিয়েছে। গত দু’টি আইপিএলে ২৩ ইনিংসে ধোনির সংগ্রহ ৩১৪ রান। গড় মাত্র ২০.৯৩। স্ট্রাইক রেট ১১২.৫৪। সর্বোচ্চ ৪৭। হয়তো বৃহস্পতিবারের ঘোষণার মধ্যে ভক্তদের প্রতিও ইঙ্গিত, সূর্যাস্তের দিকে ঢলে পড়ছেন তিনি। উত্তরসূরি হিসেবে জাডেজাকে বেছে দিয়ে গেলেন তিনিই। চেন্নাই শিবিরে যাঁকে বলা হয় ‘থালা’ অর্থাৎ অবিসংবাদী নেতা।
গবেষণা চলতে থাকবে, প্রবল স্নায়ুর চাপের মধ্যেও কী ভাবে তিনি গীতার সেই স্থিতধী পুরুষের মতো অবিচল থাকতেন। কী ভাবে মাইকেল জর্ডানের মতো নিশ্চিত হারের মুখ থেকে একের পর এক ম্যাচ অন্তিম লগ্নে জিতিয়ে দিতেন ‘ফিনিশার’। নিশ্চিত থাকা যায়, জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া ধোনির সে সব গবেষণায় কোনও আগ্রহ থাকবে না। তিনি খামার বাড়ির ক্ষেতে ফুলকপির চাষ করবেন, স্ট্রবেরি ফলাবেন। পিস্তল হাতে নিশানেবাজ চমকে দেবেন সেনাবাহিনীর শুটারদেরও। দুর্গম সেনা ছাউনিতে গিয়ে মাইনাস কুড়ি ডিগ্রিতে রাত কাটাবেন, যুদ্ধবিমান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্যারাশুট বেঁধে।
নেপথ্যে বাজবে হয়তো মুকেশের গানটা। ম্যায় পল দো পল কা শায়র হুঁ...