ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম পছন্দ নয় রোহিত শর্মার। —ফাইল চিত্র।
গত আইপিএল থেকেই শুরু হয়েছে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ নিয়ম। ম্যাচের মাঝে যে কোনও সময় এক জন ক্রিকেটারকে বদলে ফেলতে পারবে দু’টি দল। কিন্তু সেই নিয়ম কি বিপদে ফেলছে ভারতীয় দলকেই? নাকি সুবিধা হচ্ছে? উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম আসার পর আইপিএলে ক্রিকেট এখন আর ১১ জনের খেলা নয়। এখন আর প্রথম একাদশ বেছে নিলেই হয় না। বেছে নিতে হয় এক জন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারকেও। ১২ জনের খেলা হয়ে গিয়েছে। আইপিএল কর্তৃপক্ষ এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, টসের আগে দল ঘোষণা করতে হবে না। ফলে টস জিতে বা হেরে দলের অধিনায়ক ঠিক করে নিচ্ছেন বাড়তি ব্যাটার না কি বাড়তি বোলারকে দলে রাখবেন। বেশির ভাগ সময় তো কোন ১১জন প্রথম একাদশে আছেন সেটাই মনে রাখেন না অধিনায়ক। স্পষ্ট বলে দেন, ‘সম্প্রচারকারী সংস্থায় দেখে নেবেন।’
যে দিন থেকে আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম এসেছে, সে দিন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে অলরাউন্ডারের প্রয়োজন কমে যাবে কি না। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় দলে এর জন্য কোনও প্রভাব পড়ছে কি না। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন ক্রিকেটার বলেন, “ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম আসায় চোট থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্রিকেটার খেলতে পারছে। দলে অলরাউন্ডার প্রয়োজন হচ্ছে না। আইপিএলে ক্রিকেট এখন ১২ জনের খেলা হয়ে গিয়েছে। এতে আইপিএলের আকর্ষণ বেড়েছে। কিন্তু অলরাউন্ডারের প্রয়োজন শেষ করে দিয়েছে। তাই পুরো ফিট না হয়েও হার্দিক পাণ্ড্য খেলতে পারছে।”
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বারের আইপিএল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। আইপিএলের আগেই সে কথা বলে রেখেছিলেন অজিত আগরকর পরিচালিত নির্বাচক কমিটি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আদৌ সব ক্রিকেটারকে সঠিক ভাবে দেখা সম্ভব এই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম থাকলে?
প্রথমেই প্রশ্ন উঠছে শিবম দুবেকে নিয়ে। চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেন তিনি। বেশির ভাগ ম্যাচেই নামছেন শুধু ব্যাট করার জন্য। অন্য দিকে, হার্দিক সব ম্যাচে বল করছেন না। ফলে এই দুই অলরাউন্ডার কতটা তৈরি তা বোঝা সম্ভব নয় নির্বাচকদের পক্ষে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওই ক্রিকেটার বলেন, “যদি ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম না থাকত, তাহলে দুবেকে বল করাতে বাধ্য হত চেন্নাই। আবার রাহুল তেওতিয়া এক সময় ফিনিশার হিসাবে নাম করেছিল। ও কিন্তু লেগ স্পিন করতে পারে। কিন্তু ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম আসার পর আর ওকে বল করতে হয় না। ও শুধু ব্যাট করে। এতে কার ক্ষতি হচ্ছে? ভারতীয় দলের।”
আইপিএলে ব্যাট হাতে ফর্মে রয়েছেন শিবম দুবে। ছবি: পিটিআই।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম পছন্দ নয় ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মারও। তিনি বলেন, “ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মটা আমার খুব একটা পছন্দ নয়। এর ফলে অলরাউন্ডারদের প্রয়োজন কমে গিয়েছে। ক্রিকেটটা এখন ১২ জনের খেলা হয়ে গিয়েছে। এর ফলে ক্রিকেটটা নষ্ট হচ্ছে। দর্শকের জন্য যদিও খুব উপভোগ্য হচ্ছে ব্যাপারটা।” রোহিতের মতে এই নিয়মের ফলে ভারতীয় অলরাউন্ডারেরা সুযোগ পাচ্ছেন না। ওয়াশিংটন সুন্দরের মতো ক্রিকেটারকে দলে নেওয়া হচ্ছে না। শিবম দুবে ব্যাট হাতে রান করলেও বল করছেন না। রোহিত বলেন, “ভারতীয় ক্রিকেটের দিক থেকে দেখতে গেলে ওয়াশিংটন, শিবমেরা বল করছে না। এটা দলের জন্য ভাল দিক নয়। কী করব জানি না। দলে ১২ জন ক্রিকেটার রয়েছে। খেলার পরিস্থিতি বুঝে এক জনকে দলে আনা হচ্ছে। এটা দেখতে খুব ভাল লাগছে। কিন্তু এই বাড়তি ক্রিকেটার দলে আসার পর থেকে সাত বা আট নম্বরের ব্যাটার সুযোগ কম পাচ্ছেন। আলাদা করে ব্যাটার নামানোর সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে।”
অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এক সময় আইপিএল খেলেছেন। তিনিও বলেন, “এই নিয়মটা দর্শকের জন্য। ক্রিকেটের স্বার্থ দেখে এই নিয়ম তৈরি করা হয়নি। আমার মনে হয়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমনিতেই অনেক বিনোদন রয়েছে। সেখানে কোনও চটকের প্রয়োজন ছিল না।” গিলক্রিস্ট আরও বলেন, “২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইপিএলে ২৫০ রানের গণ্ডি পাড় করেছিল মাত্র দু’বার। কিন্তু এ বারের আইপিএলে ইতিমধ্যে চার বার ২৫০ রানের গণ্ডি পাড় করেছে। খারাপ বোলিং হচ্ছে এমন নয়। খোলা মনে খেলতে আসছে ব্যাটারেরা। যেদিকে খুশি মারছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখন এ ভাবেই খেলা হয়।”
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পাল্টা মতও রয়েছে। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার প্রণব রায়ের মতে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মের জন্য ক্রিকেট এখন আরও আকর্ষণীয়। তিনি মনে করেন না ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মের জন্য কোনও অলরাউন্ডারের ক্ষতি হচ্ছে বলে। প্রণব বললেন, “যে ক্রিকেটার ভাল খেলতে পারে সে জায়গা করে নেবে। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম আসার কারণে ভাল ক্রিকেটারকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন নয়। বরং এক দলে ১২ জন ক্রিকেটার খেলছে। অর্থাৎ এক জন বাড়তি ক্রিকেটার খেলার সুযোগ পাচ্ছে। সে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে।”
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম যে, আইপিএলে সব দল খুব ভাল ব্যবহার করতে পেরেছে এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হিসাবে নেমে কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি। বুধবার যেমন দ্রুত উইকেট পড়ে যাচ্ছে দেখে শাহরুখ খানকে নামিয়ে দিয়েছিল গুজরাত টাইটান্স। কিন্তু তিনি রান করতে পারেননি। আবার আইপিএলের শুরুর দিকে একটি ম্যাচে দিল্লি ক্যাপিটালস রিকি ভুঁইয়ের জায়গায় অভিষেক পোড়েলকে নামিয়ে দেয় ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে। অভিষেক ১০ বলে ৩২ রান করে বুঝিয়ে দেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের প্রভাব কী হতে পারে। পরের ম্যাচগুলিতে প্রথম একাদশে জায়গা করে নিলেন তিনি। ফলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়মের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে এমনটা বলা যাবে না।
তবে চোট লাগা ক্রিকেটারকে খেলানোর ক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম কাজে লাগাচ্ছে অনেক দল। কলকাতা নাইট রাইডার্স দলে যেমন রিঙ্কু সিংহ গত দু’টি ম্যাচে ফিল্ডিং করেননি। কিন্তু ব্যাটিং করেছেন। তাঁকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলাচ্ছে কেকেআর। রিঙ্কু নিজেই বলেন, “আমার সামান্য চোট রয়েছে। সেই কারণে ফিল্ডিং করিনি।” অর্থাৎ, চোট থাকলেও খেলিয়ে দেওয়া হয়েছে রিঙ্কুকে। শুধু ব্যাট করানো হয়েছে। এর দু’টি দিক রয়েছে। চোট থাকা সত্ত্বেও খেলতে গিয়ে আরও চোট বেড়ে যেতে পারে রিঙ্কুর। তাতে ভারতীয় দলের ক্ষতি হবে। অন্য দিকে, রিঙ্কুকে খেলানোর সুবিধা নিতে পেরেছে কেকেআর। রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে রিঙ্কুর ৯ বলে ২০ রান না থাকলে আরও কম রানে আটকে যেতে পারত দল। গত বছর ফ্যাফ ডুপ্লেসি চোট নিয়েই আইপিএল খেলেছিলেন। তিনি ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হিসাবে ব্যাট করছিলেন। ফিল্ডিং করছিলেন না। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিরাট কোহলি। কিন্তু এতে কী ভারতীয় দলের কোনও লাভ হচ্ছে?
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের দল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইপিএল বড় ভূমিকা নেবে, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও মানতে হবে যে, দল শুধু আইপিএল দেখে বেছে নেওয়া হবে না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কারা খেলবেন সেটা বেছে নেওয়ার জন্য গত দু’বছরে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স দেখা হবে। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেট। যদিও সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে (ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা) ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ নিয়ম রয়েছে। প্রণব বললেন, “ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে। সেটার জন্য আলাদা অনুশীলনও প্রয়োজন। কোনও ক্রিকেটারকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলানো হবে ঠিক করলে তাঁকে সেই ভাবে তৈরিও করতে হবে। হঠাৎ করে কেউ ১০ বল বাকি থাকতে নেমে চালাতে শুরু করতে পারবে না।”
তবে একটা জিনিস স্পষ্ট। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মের ফলে আইপিএলের আকর্ষণ বেড়েছে। প্রণবের মতে, “খেলা এখন আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। কোচ, অধিনায়কদের কাজ বেড়ে গিয়েছে। এখন ভাবতে হচ্ছে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়েও।” তাতে কি ভারতীয় দলের কোনও লাভ হচ্ছে? নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওই প্রাক্তন ক্রিকেটার বলেন, “এখন কার ক্রিকেটারেরা একমাত্রিক। তাঁরা হয় ব্যাটার, নয় বোলার। এর ফলে ভারতীয় দলের ক্ষতিই হচ্ছে।” তাঁর কথা যে সত্যি সেটার প্রমাণ অবশ্যই, ভারতীয় দলে অলরাউন্ডারের অভাব। রবীন্দ্র জাডেজা বাদে কোনও নিয়মিত অলরাউন্ডার ভারতীয় দলে নেই।
এক দিনের বিশ্বকাপের সময় রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, সূর্যকুমার যাদবদের নেটে বল করতে দেখা গিয়েছিল। বিরাট ম্যাচেও বল করেছিলেন। সেই সময়ই বোঝা গিয়েছিল ভারতীয় দলে অলরাউন্ডার কতটা অভাব। হার্দিক চারটি ম্যাচ খেলে চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার পর জাডেজা ছাড়া দলে আর কোনও অলরাউন্ডার ছিল না। ফলে পাঁচ বোলার নিয়েই খেলতে হয়েছে ভারতকে। বাকি ম্যাচে অসুবিধা না হলেও ষষ্ঠ বোলারের অভাব ভারত ভালই বুঝতে পেরেছিল ফাইনালে। মহম্মদ শামি রান দিয়ে দেওয়ার পর আর কেউ ছিলেন না তাঁকে ঢাকার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেই সমস্যা হবে না তো?