গুরু গম্ভীরের উপস্থিতিতে পুরনো গৌরব ফেরার আশা, বেঙ্গালুরু মাত ‘স্লোয়ার’ বলে
IPL 2024

প্রাপ্তি ওপেনার সুনীল নারাইন ও বোলার আন্দ্রে রাসেল, চিন্তা মিচেল স্টার্ক ও ফিল্ডিং নিয়ে

চাপ কি গম্ভীরের উপরে ছিল না? অবশ্যই ছিল। কথা উঠেছিল, নারাইনের তো দ্রুতগতির বোলিংয়ের সামনে সফল হওয়ার টেকনিকই নেই। তার উপরে এ বার থেকে আইপিএলে দুটো বাউন্সারের নিয়ম চালু হয়েছে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪ ০৭:২৮
Share:

(বাঁ দিকে) আন্দ্রে রাসেল ও সুনীল নারাইন। —ফাইল চিত্র।

ওপেনার নারাইন: ইডেনে প্রাক-আইপিএল নাইট রাইডার্সের শিবির বসারও অনেক আগে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। গৌতম গম্ভীরকে যখন শাহরুখ খান ফোন করে বললেন, এটা তোমার দল, তুমিই ঠিক করো ভাঙবে না গড়বে আর গম্ভীর সেই অনুরোধ ফেলতে পারলেন না, তার পরেই দ্রুত ছক সাজাতে বসেন নতুন মেন্টর। টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে গম্ভীরের সফল হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ঝুঁকি নিতে ভয় না পাওয়া। মেন্টর গম্ভীরও একই রকম ডাকাবুকো মনোভাব নিয়ে এসেছেন। নারাইন শেষ আইপিএলে পুরোপুরি ব্যর্থ হন ব্যাট হাতে। ১৪ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ২১ রান।

Advertisement

কিন্তু তখন বেগুনি শিবিরে গম্ভীর ছিলেন না। নারাইনকে শুধু ওপেনার হিসেবে ফেরাননি গম্ভীর, বুস্টার ডোজ় দিয়ে নামিয়েছেন যে, তুই উপরে খেলবি, সমালোচকদের ভাইরাস তাড়া করলে আমি বুঝে নেব। ইডেনে প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ হলেও তাঁকে ওপেন থেকে সরাননি। নারাইন পাঁচশোতম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেন বেঙ্গালুরুতে শুক্রবার। আর তিন জন মাত্র এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তার মধ্যে দু’জন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। কায়রন পোলার্ড (৬৬০ ম্যাচ) ও ডোয়েন ব্র্যাভো। তৃতীয় জন পাকিস্তানের শোয়েব মালিক (৫৪২)। রুদ্ধশ্বাস প্রথম ম্যাচে হায়দরাবাদকে হারানোর রাতে বোলার নারাইনের জাদু দেখেছিল ইডেন। চিন্নাস্বামী দেখল ব্যাট হাতে কখনওসখনও তিনি আন্দ্রে রাসেলও হয়ে উঠতে পারেন। আরও বোঝালেন, টি-টোয়েন্টি লিগ জিততে হলে এখনও সেরা মন্ত্র— ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লাও। অস্ট্রেলীয়দের যতই ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বিসর্জন দিয়ে ধরে আনো, আইপিএলে আসল ফিক্সড জিপোজ়িট ক্যারিবীয়রা। কলকাতা ফুটবলে যেমন এক সময় একচেটিয়া রাজ ছিল নাইজিরীয়দের।

দোসর ফিল সল্ট: ব্যাটসম্যান নারাইন যেমন হারিয়ে গিয়েছিলেন আইপিএল গ্রহ থেকে, তেমনই ফিল সল্টের এ বারের প্রতিযোগিতায় খেলারই কথা ছিল না। নিলামে কেউ তাঁকে কেনার ন্যূনতম আগ্রহটুকুও দেখায়নি। সল্ট কিন্তু এতটা খারাপও নন। ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মারমুখী শতরান আছে। জেসন রয় হঠাৎ জানান, আসবেন না। পরিবর্ত হিসেবে শেষ মুহূর্তে ঢুকলেন সল্ট আর প্রতিপক্ষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে লাগিয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছে, আইপিএল নিলামে বসা মালিকদেরও ছক্কাঘাতে ওড়াতে এসেছেন যে, আমাকে কেউ কিনলেই না? এখন বোঝো ঠ্যালা।

Advertisement

ক্রিস গেল যেমন অবিক্রীত ছিলেন নিলামে। পরিবর্ত হিসেবে আরসিবি-তে নিয়ে আসেন অনিল কুম্বলে। তার পর বাকিটা তো ইতিহাস। শুক্রবার সল্ট ও নারাইন পাওয়ার প্লে অর্থাৎ প্রথম ছয় ওভারে তোলেন ৮৫-০। নাইট রাইডার্স এত রান শেষ কবে প্রথম ছয় ওভারে তুলেছে, মনে করতে পারছি না। দশ বছর ধরে কেকেআরের ট্রফি না পাওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই দুর্ধর্ষ সব তারকা হাতে পেয়েও গোদা মাথায় বুঝতে না পেরে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া। শুভমন গিল। মহম্মদ শামি। সূর্যকুমার যাদব। প্রবাদই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কেকেআর ছাড়ে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। দ্বিতীয় কারণ দল নির্বাচনে স্থায়িত্ব না থাকা। গত দু’বছরে অন্তত দশটা নতুন ওপেনিং জুটি খেলেছে। সল্ট-নারাইন সফল হলে তুঘলকি প্রবণতা অন্তত কমবে।

গুরু-গম্ভীর: গত বারের কেকেআর ডাগআউটটা শুধু ভাবুন। গম্ভীর তখন লখনউ সুপার জায়ান্টসে। শ্রেয়স আয়ার চোটের জন্য খেলতে পারেননি। নেতৃত্বে নীতীশ রানা। একটা ম্যাচে নিজেই প্রথম ওভার বল করতে এলেন এমন ভাবে যেন লিলি-টমসনের প্রিয় ছাত্র। কোচের নাম চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। এত খারাপ কোচ-অধিনায়ক জুটি বানিয়ে কলকাতার চতুর্থ ডিভিশন ফুটবলেও কোনও দল খেলতে নামবে না। পণ্ডিত রঞ্জি ট্রফিতে দারুণ সফল হতে পারেন। কিন্তু রঞ্জিতে রান করা বা উইকেট নেওয়া সব ক্রিকেটার যেমন আন্তর্জাতিক মঞ্চের যোগ্য হয় না, তিনিও তেমন রঞ্জি ট্রফিরই পণ্ডিত, আইপিএলের নন। দরকার ছিল গম্ভীরের মতো কাউকে যিনি দলটার মধ্যে আগ্রাসন আনবেন। এমন চনমনে একটা খেলায় ডাগআউটে সিক্সটি প্লাসের ঝিমুনি কাটাবেন। আত্মবিশ্বাসের সিরিঞ্জ হাতে উপস্থিত হবেন। বুক চিতিয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেবেন। যেমন নারাইনের ক্ষেত্রে নিয়েছেন।

চাপ কি গম্ভীরের উপরে ছিল না? অবশ্যই ছিল। কথা উঠেছিল, নারাইনের তো দ্রুতগতির বোলিংয়ের সামনে সফল হওয়ার টেকনিকই নেই। তার উপরে এ বার থেকে আইপিএলে দুটো বাউন্সারের নিয়ম চালু হয়েছে। গম্ভীরের পাল্টা মত ছিল, শুরুতে গিয়ে যাঁর কাজ হবে স্রেফ ঠ্যাঙানো, তাঁর টেকনিক ধুয়ে কি জল খাব? আট নম্বরে ওকে ফেলে রেখে কী করব? তার চেয়ে সুইসাইড বম্বারের মতো ব্যবহার করি। নিজে মরলে মরবে। কিন্তু যেদিন লাগবে, বিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে আসবে। নারাইন কি ডারবানে রাবাডার বিরুদ্ধে টেস্টে ওপেন করতে নামছে নাকি? অকাট্য যুক্তি। এক-এক সময় মনে হচ্ছে গম্ভীর-কোহলি আলিঙ্গনের ছবি ভাইরাল তো হওয়ারই কথা। আইপিএলের ইতিহাসের সেরা চমক বলেও আখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। কাছাকাছি আসার মতো একমাত্র মনে পড়ছে ‘মাঙ্কিগেট’-এর পরে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস ও হরভজন সিংহের একই সঙ্গে মুম্বই ইন্ডিয়ানসের হয়ে খেলা। কিন্তু চলতি আইপিএলে কেকেআর-রথ যদি এগোতে থাকে, গম্ভীর-নারাইন যুগলবন্দিও কম মূল্যবান ছবি নয়।

রাসেল শুধুই ‘মাস্‌ল’ নয়: মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ছাড়া যেমন চেন্নাই সুপার কিংস হয় না, তেমনই সুনীল নারাইন ও আন্দ্রে রাসেলকে ছাড়া কেকেআর হয় না। ইডেনে জিতিয়েছিল ব্যাট হাতে রাসেল ‘মাস্‌ল’। চিন্নাস্বামীতে উজ্জ্বল বোলার রাসেল। পিচে যে বল থমকে আসছে, কোহলি রানমেশিন আটকাতে গেলে বলের গতি কমিয়ে দিতে হবে, শুক্রবার রাতে তা প্রথম ধরেন রাসেল। আরসিবি ইনিংসের নবম ওভারে বল করতে এসে দু’টো স্লোয়ার বাউন্সার তিনি করলেন কোহলি আর ক্যামেরন গ্রিনকে। দু’জনেই পুল মারতে গিয়ে ব্যাটে-বলে করতে পারলেন না। পরের ওভারে ছ’টা বলের চারটেই স্লোয়ার করেন রাসেল। ঘণ্টায় ১৪৫-১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে করতে ঝুপ করে ঘণ্টায় ১১০ কিমিতে নেমে আসেন। কোহলির মতো ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্রও ধরতে পারছিলেন না। এর পরে রাসেল দ্রুত পিচের চরিত্র বুঝিয়ে দেন মিচেল স্টার্ক ও হর্ষিত রানাকেও। স্টার্ক প্রথম দুই ওভারে বুনো গতিতে বল করছিলেন। তিনিও শেষ দুই ওভারে একাধিক স্লোয়ার করলেন। ১৬, ১৭, ১৮— এই তিন ওভারে আরসিবি তোলে মাত্র ১৯ রান। সৌজন্যে ‘চাণক্য’ রাসেলের স্লোয়ার বল। কে বলে আন্দ্রে রাসেলের ক্রিকেট মানে শুধুই পেশিশক্তি!

২৪.৭৫ কোটির কত গেল: হার্দিক পাণ্ড্য যদি এই মুহূর্তে ভারতের সব চেয়ে ‘ট্রোল্‌ড’ ক্রিকেটার হন, তা হলে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন মিচেল স্টার্ক। ইতিমধ্যেই কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে যে, ২৪.৭৫ কোটি দিয়ে হাতি পুষেছে কেকেআর। তাঁর জন্য সমান্তরাল একটা স্কোরবোর্ড চালু হয়েছে মনে হচ্ছে। কত টাকা গচ্চা গেল, তার স্কোরবোর্ড। প্রত্যেক বলের দাম যদি ৬ লক্ষ করে হলে দু’টো ম্যাচ মিলিয়ে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ জলে। নতুন বলে কোহলি তাঁর বিরুদ্ধে করলেন ১৭ বলে ৩৩ রান। দু’টো ছক্কা। তার মধ্যে একটা ছক্কা সামনের পায়ে হেলায় কব্জির মোচড়ে এমন ভাবে মিডউইকেট গ্যালারিতে ফেললেন, মনে হল যেন বলতে চাইছেন, ‘‘তোর যা দাম আমিও কখনও পাইনি। যা এ বার বলটা কুড়িয়ে আন।’’ তিনি সম্পদ না অপচয়? দ্রুত উত্তর দিতে হবে স্টার্ককেই।

লুকনোর জায়গা নেই: ক্যাচের ক্ষেত্রে ময়দানের অতি পরিচিত কথা— গজা ক্যাচ আর মাঠে লুকনোর জায়গা নেই। বেঙ্গালুরু জয়ের মধ্যেও ক্যাচ-আতঙ্ক কাটাতে গম্ভীরদের ঘুমের বড়ি লাগবে। ক্যাচ ফেলার প্রতিযোগিতায় এক নম্বরে বরুণ চক্রবর্তী। কেকেআরের ফিল্ডিং কোচটা কে রে? দ্রুতই নিশ্চয়ই জনতা খোঁজ করবে। রায়ান টেন দুশখাটে। বেচারা খুলিটের দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার না ডাগআউটে বসেই হার্দিক-স্টার্কদের মতো সমাজমাধ্যমে আক্রান্ত হন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement