জুটি: কেকেআরের বিরুদ্ধে আবারও সফল ধোনি। বাবার হাত ধরে ইডেনে নেমে পড়ল ছোট্ট মেয়ে জ়িভাও। রবিবার। ছবি: পিটিআই।
তীব্র কোমরের যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই রবিবার ইডেনে নেমেছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। তা নিয়েই ছক্কা মারলেন, হারিয়ে দিয়ে গেলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সকে।
মাঠে এসে দলের ফিজিয়োকে প্রথমেই ধোনি জানান, তাঁর কোমরে ব্যথা হচ্ছে। ফিজিয়ো এবং ডাক্তার এর পর পরীক্ষা করে জানান যে, খেলার মতো অবস্থা নেই। জোর করে খেলতে নামলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কিন্তু সিএসকে তথ্যচিত্রে যেমন তাঁকে বলতে শোনা যায় ‘জিদ হ্যায় তো হ্যায়’ তেমন ভঙ্গিতেই তিনি ফিজিয়ো ও ডাক্তারকে বলে দেন, ‘‘আমি খেলব।’’ ম্যাচের আগে বেশ খানিকক্ষণ কোমরে ম্যাসাজ নিয়ে তিনি মাঠে নেমে পড়েন।
ইডেনে ধোনির চেন্নাই বনাম শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্স দ্বৈরথ দেখতে গিয়ে অবশ্য মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল। ম্যাচ কোথায় হচ্ছে, কলকাতায় না চেন্নাইয়ে? গ্যালারিতে যত না নীল, তার চেয়ে বেশি হলুদের ছোঁয়া। ইডেনের একেবারে উপরের তলা থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, অসংখ্য সূর্যমুখী ফুটে রয়েছে গ্যালারিতে।
আর মাঠের মধ্যে চমক দেখিয়ে চলেছেন ধোনির চেন্নাই। দলের প্রধান ক্রিকেটারদের দিকে চোখ বোলানো যাক— ১) অধিনায়ক ধোনি: বয়স ৩৭ বছর ২৮১ দিন। ২) ওপেনার শেন ওয়াটসন: বয়স ৩৭ বছর ৩০১ দিন। ৩) এ দিন চার উইকেট নিয়ে ইডেন জুড়ে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো ইমরান তাহির: বয়স ৪০ বছর ১৮ দিন। ৪) অন্য ওপেনার ফ্যাফ ডুপ্লেসি: বয়স ৩৪ বছর ২৭৫ দিন। ৫) এ দিন না খেললেও দলের অন্যতম স্পিন-অস্ত্র হরভজন সিংহ: বয়স ৩৮ বছর ২৮৫ দিন। ৬) চোটে বাইরে থাকা আর এক প্রধান স্তম্ভ, অলরাউন্ডার ডোয়েন ব্র্যাভো: বয়স ৩৫ বছর ১৮৯ দিন। কে যেন বলেছিল, টি-টোয়েন্টি আসলে তরুণ রক্তের খেলা! সেই ধারণাটাকেই তো বাবুঘাটের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন ধোনি।
আরও পড়ুন: একের পর এক জয়ের পর টানা তিন ম্যাচে হার, কোথায় ভুল হচ্ছে নাইটদের?
ভারতের অধিনায়ক হিসেবে ওয়ান ডে ক্রিকেটে অতিরিক্ত ‘ডট বল’ খেলা বন্ধ করে মাঝের ওভারগুলোতে খুচরো রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখার ধুরন্ধর নকশা তৈরি হয় তাঁর হাতেই। জোর দিতে শুরু করেছিলেন ফিটনেস, ফিল্ডিং এবং ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস’-এর উপর। তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে, এক দিনের ক্রিকেটে গড় স্কোর বাড়তে থাকা। এখন সাড়ে তিনশোও নিরাপদ নয়। চারশো রানও উঠে যাচ্ছে।
ক্রিকেটে নতুন শব্দেরই জন্ম ঘটিয়ে দিয়েছেন ধোনি— ‘ফিনিশার’। তাঁর আগে মাইকেল বিভানও দারুণ রান তাড়া করতে পারতেন কিন্তু কখনও এ ভাবে শুধুমাত্র এক জন ব্যাটসম্যানের একটি বিশেষ দক্ষতাকে কেন্দ্র করে আলোড়িত হয়নি ক্রিকেট। অন্য খেলার কিংবদন্তিকে টেনে বলা যায়নি, ‘‘বাস্কেটবলে মাইকেল জর্ডান আর ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। খেলার দুই সেরা ফিনিশার!’’
কুড়ি ওভারের ক্রিকেট স্পিনারদের ধ্বংস করার খেলা, এই তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছেন ধোনি। বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, যত মন্থর করে দেওয়া যাবে বল, ততই কুড়ি ওভারের ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেটে সমস্যায় পড়বে ব্যাটসম্যানেরা। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছ’বছরে চেন্নাই পাঁচ বার ফাইনাল খেলেছিল। সেই সময়ে তাঁদের বোলিং আক্রমণ ছিল স্পিন ত্রয়ী নির্ভর। মুথাইয়া মুরলীধরন, অশ্বিন এবং শদাব জাকাতি। এই ২০১৯-এও তাঁদের বোলিং বলতে তিন স্পিনার। ইমরান তাহির, হরভজন সিংহ, রবীন্দ্র জাডেজা। এ দিন হরভজন ছিলেন না। নিউজিল্যান্ডের বাঁ হাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারকে নামিয়ে দিলেন। এ বারের আইপিএলে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক ইডেনে এ দিন উইকেট নিয়ে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে থাকা লেগস্পিনার তাহির। সব চেয়ে ভাল ইকনমি রেট (ওভার প্রতি রান দেওয়ার হিসাব) হরভজনের। রবিবারও ২০ ওভারের মধ্যে ১২ ওভার করলেন স্পিনারেরা।
পর-পর খেলা এবং লাগাতার ট্র্যাভেলিংয়ের এই ঝকল নিয়ে আইপিএল সূচির মধ্যে ধোনির ‘ড্যাড্স আর্মি’ সফল হচ্ছে কী করে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বয়স্কদের তরতাজা রাখার জন্য একাধিক ট্রেনার-ফিজিয়ো রাখা হয়েছে। তাঁরা সারাক্ষণ নজরে রেখেছে ‘ড্যাডিদের’ ফিটনেস। ঠাসা সূচির মধ্যে ধোনি-মন্ত্র হচ্ছে, প্র্যাক্টিস কম, বিশ্রাম বেশি। যুক্তি— ক্লান্ত শরীরে ট্রেনিং করতে গেলে ‘ব্রেকডাউন’ হবে।
সিএসকে সম্ভবত একমাত্র দল, যাদের সঙ্গে সব সময় ঘুরছেন এক জন ডাক্তার। বিদেশি ফুটবল দলে এটা এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভারতে কোনও খেলাধুলোতেই খুব একটা দেখা যায় না। কোন ক্রিকেটার কী খাবেন, তা দেখার জন্য ডায়েটেশিয়ান রয়েছেন। রবিবার ইডেনের ম্যাচের জন্য কোন কোন খাবার ঠিক কোন তাপমাত্রায় চাই, পুঙ্খানুপুঙ্খ সেই তালিকা সিএসকে কর্তৃপক্ষ আগাম তুলে দিয়েছিল স্থানীয় ম্যানেজার মঈনুদ্দিন বিন মকসুদের হাতে।
ম্যাচটাও যেন শনিবারেই শুরু করে দিয়েছিলেন সুরেশ রায়না, রবীন্দ্র জাডেজারা। যখন ড্রেসিংরুমে ঢুকে সকলে মিলে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিলেন অনুপ্রেরণামূলক নানা উক্তি। তাতে সব চেয়ে প্রাধান্য পেল দলগত লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য নয়। ধোনির মতো মহাতারকা থেকেও ব্যক্তি নয়, ভাবনাটা দলকেন্দ্রিক। নিয়ম, শৃঙ্খলার বুনোটে ঠাসা একটা দল। যারা তামিল নববর্ষ উদযাপন করল বাংলা নববর্ষের এক দিন আগে কলকাতাকে হারিয়ে। তাদের রাজা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ম্যাচ জিতে উঠে নিজের ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা কাগজ। টাঙিয়ে দিলেন ড্রেসিংরুমের দেওয়ালে। তাতে লেখা— ‘চ্যাম্পিয়ন হতে আমাদের আর ৯টা ম্যাচ বাকি’!
বলে না, সাফল্য একটা প্রক্রিয়ার ফল! ধোনির চেন্নাই জ্বলন্ত উদাহরণ!