বিহান রেড্ডি। ছবি: সংগৃহীত।
বিহান রেড্ডি। উইম্বলডনের অনূর্ধ্ব ১৪ বালক বিভাগের দ্বিতীয় বাছাই। এ বারের উইম্বলডন সিঙ্গলসে বাছাই তালিকার এক মাত্র ভারতীয়। কে এই বিহান? সে কী ভাবে পৌঁছে গেল উইম্বলডনের মঞ্চে?
বেঙ্গালুরুতে জন্ম। বাবা-মায়ের কর্মসূত্রে বিহান ২০১৪ সাল থেকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। বিহানের বাবা বসন্ত গৌড়া সোমনাথ রেড্ডি স্কুল-কলেজজীবনে খেলতেন ক্রিকেট। কিন্তু পাঁচ বছরের ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন টেনিস র্যাকেট। বাস্কেট বলের পোকা বিহান দ্রুত ভালবেসে ফেলে টেনিসকে। সাত বছর বয়স থেকে টেনিসই তার ধ্যান জ্ঞান।
বৃহস্পতিবার বিহান উইম্বলডনে অনূর্ধ্ব ১৪ পর্যায়ের প্রথম ম্যাচ খেলবে অস্ট্রেলিয়ার লাচলান কিংয়ের বিরুদ্ধে। তার আগের দিন বিহানের বাবা উইম্বলডনের কোর্ট থেকে ফোনে কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে। অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ক্লাবের অনুশীলন কোর্টে ছেলের অনুশীলন দেখছিলেন বসন্ত। ঠিক পাশের কোর্টেই তখন অনুশীলন করছিলেন ইতালির ইয়ানিক সিনার। বৃহস্পতিবার নোভাক জোকোভিচের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের প্রস্তুতি সারছিলেন সিনার। নিজের প্রিয় খেলোয়াড়কে পাশের কোর্টে দেখে বিহানের চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল সে দিকে। তাই ছেলের অনুশীলনে সতর্ক নজর রাখতে রাখতেই কথা বললেন বসন্ত।
কী ভাবে শুরু হল বিহানের টেনিস যাত্রা? বসন্ত বললেন, ‘‘ওর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন হাতে র্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তার আগে বাস্কেট বলের ভক্ত ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। টেনিস শুরু করার পর বাস্কেট বল নিয়ে আগ্রহ কমে যায়। টেনিসের টেকনিক দ্রুত রপ্ত করতে শুরু করে। টেনিসকে ভালবেসে ফেলে। এখন আর বিহানকে টেনিস কোর্টে ঠেলে পাঠাতে হয় না। নিজের আগ্রহেই অনুশীলন করে।’’
প্রতিদিন কত ক্ষণ অনুশীলন করে বিহান? বসন্ত জানালেন, ‘‘আমেরিকার টেনিস ক্লাবগুলোয় শিক্ষার্থীদের ভিড় প্রচুর। প্রতি দিন অনুশীলন করার সুযোগ পাওয়া যায় না। খরচ সাপেক্ষও। এখন বিহান সপ্তাহে তিন দিন অনুশীলন করে। মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার ওর অনুশীলনের দিন। এই তিন দিন দুটো সেশনে মোট চার ঘন্টা অনুশীলন করে। আর এক ঘণ্টা ফিটনেস ট্রেনিং করে। বাকি দিনগুলোয় সুযোগ হলে বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস বল মারার অভ্যাস করে।’’
১৩ বছরের বিহান সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। টেনিস এবং পড়াশোনার মধ্যে কী ভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে সে? বসন্ত বললেন, ‘‘গত বছরের শেষ দিক থেকে প্রতিযোগিতা খেলতে শুরু করেছে বিহান। তাই এখন অনলাইন স্কুলে পড়ছে। রোজ স্কুল যাওয়ার ব্যাপার নেই। সময় মতো পড়াশোনা করতে পারে। নিজের মতো করে টেনিস এবং পড়ার সময় ভাগ করে নেয়। পড়াশোনা করতেও ভালবাসে বিহান। তাই অসুবিধা হয় না।’’
বিহানের মা রূপবতী রেড্ডিও কর্মরত। বাবা-মা দু’জনেই বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। ছেলের খেলার জন্য প্রচুর ছুটি নিতে হচ্ছে তাঁদের। বিভিন্ন দেশে খেলতে যেতে সমস্যা হচ্ছে না? বিহানের সঙ্গে কে যাচ্ছে সব জায়গায়? বসন্ত বললেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত খুব বেশি প্রতিযোগিতায় খেলেনি বিহান। তাই তেমন সমস্যা হয়নি। এর আগে ভারতে গিয়ে চারটে প্রতিযোগিতা খেলেছিল। তখন ওর মা ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল আত্মীয়-পরিজনদের কাছে। সঙ্গে বিহানও গিয়েছিল। তাই সমস্যা হয়নি। ভারতে দু’টো আইটিএফ প্রতিযোগিতা খেলে ফিরে আসার কথা ছিল। এখানে ফিরে জাতীয় স্তরের অনূর্ধ্ব ১৬ পর্যায়ের একটা প্রতিযোগিতা খেলার কথা ছিল বিহানের। কিন্তু সেটা না খেলে ভারতেই আরও দু’টো প্রতিযোগিতা খেলল। ওর মাকে বাড়তি ছুটির আবেদন করতে হয়েছিল।’’
গত মার্চ মাসে ভারতে গুরুগ্রাম, মাদুরাই, দেহরাদূন এবং ভিলাইয়ে খেলেছে বিহান। চারটিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গুরুগ্রামের প্রতিযোগিতায় যোগ্যতাঅর্জন পর্বে খেলতে হয়েছিল। মূলপর্বে খেলে ৬৪ জন। সাধারণ অনূর্ধ্ব ১৪ বা ১৬ পর্যায়ের প্রতিযোগিতাগুলির মূলপর্ব হয় ৩২ জনকে নিয়ে। গুরুগ্রামে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে পরের তিনটি প্রতিযোগিতায় সরাসরি খেলার সুযোগ পায় বিহান। চার সপ্তাহে টানা ২১টি ম্যাচ জিতেছিল। একটি প্রতিযোগিতায় সিঙ্গলসের পাশাপাশি ডাবলসেও খেলেছিল। ডাবলসেও সঙ্গীকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আমেরিকা থেকে ভারতে এসে খেলার তো অনেক খরচ। তা ছাড়া আমেরিকায় জুনিয়র পর্যায়ের প্রতিযোগিতার সংখ্যাও অনেক। তাও কেন প্রতিযোগিতা খেলার জন্য ভারতকে বেছে নিল বিহান? বসন্ত বললেন, ‘‘আসলে বিহান মায়ের সঙ্গে ভারতে ঘুরতেই গিয়েছিল। সঙ্গে টেনিসের সরঞ্জাম, পড়ার বই নিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল সুযোগ পেলে অনুশীলন করার। তখনই ওখানে পর পর প্রতিযোগিতা ছিল। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।’’
১৩ বিহানের নিজস্ব ‘ওয়েব পেজ’ রয়েছে। সেখানে তার নামের পাশে রয়েছে আমেরিকার জাতীয় পতাকার ছবি। আমেরিকায় টেনিস শুরু করা বিহান সর্বভারতীয় টেনিস সংস্থার নথিভুক্ত খেলোয়াড়ও নয়। অথচ উইম্বলডনে সে ভারতের প্রতিনিধি! এই বৈপরীত্যের কারণ জানালেন বসন্ত। তাঁর কথায়, ‘‘বিহানের নাম যেহেতু আমেরিকায় নথিবদ্ধ তাই ওর নামের পাশে এখানকার পতাকা আছে। কিন্তু ও এ দেশের নাগরিক নয়। আমরা সবাই ভারতের নাগরিক। তাই ও ভারতীয় হিসাবেই উইম্বলডন খেলছে। আমাদের সাত বছরের মেয়ে শুধু জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক। এখানকার নাগরিকত্ব নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা আমাদের এখনও নেই।’’
সবে শুরু করলেও ধীরে ধীরে বিহানকে প্রতিযোগিতা খেলার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে খেলতে হবে প্রয়োজনে। ক্রমে বাড়বে ব্যস্ততা। কে যাবে ওর সঙ্গে ঘন ঘন? বসন্ত বললেন, ‘‘এখনও তেমন সমস্যা হয়নি। আমরা এখনও অতটা ভাবিনিও। ভারতে ওর মা গিয়েছিল। উইম্বলডনে আমি এসেছি। ব্যস্ততা বাড়লে আমাদের মধ্যে কাউকে ছুটি নিয়ে সঙ্গে যেতে হবে। কেউ-ই না পারলে কোচের সঙ্গে পাঠাতে হবে। আমাদের প্রতিযোগিতা বেছে নিতে হবে। সব জায়গায় ছেলেকে পাঠাতে পারব না। অনেক খরচ। আরও একটা ব্যাপার আছে। আপাতত দু’তিন বছর খেলুক। যদি আশাপ্রদ উন্নতি করতে পারে, এগোতে পারে তা হলে টেনিস নিয়ে থাকবে। সাফল্য না পেলে অন্য কিছু ভাবতে হতে পারে আমাদের। এখনই আমরা খুব বড় কিছু ভাবিনি। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে চাই আমরা।’’
টেনিসের পাশাপাশি অনলাইনে দাবাও খেলে বিহান। বাস্কেট বলে আগ্রহ তো আছেই। কোনটা প্রিয় খেলা উইম্বলডন অনূর্ধ্ব ১৪ পর্যায়ের দ্বিতীয় বাছাইয়ের? বসন্ত জানালেন, ‘‘দাবা নিয়ে আমার কোনও ধারণা নেই। বিশ্বনাথন আনন্দ ছাড়া কারও নামও জানি না। বিহান দাবা খেলে নিজের শখে। অবসর সময়ে। বাস্কেট বল দেখলেও এখন আর খেলে না তেমন। টেনিসই ওর প্রিয় খেলা। এটা খেলতেই ভালবাসে।’’
টেনিস পরিশ্রমের খেলা জানেন প্রসন্ন। শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকতে হয় খেলোয়াড়দের। অজানা নয় বসন্তের। তিনি জানালেন, ‘‘টেনিসে ভাল করতে হলে শুধু টেনিস কোচ দিলেই হয় না। ভাল ফিটনেস ট্রেনার দরকার। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হয়। সব কিছু মিলিয়ে খরচ অনেক। আমাদের সামর্থ্যে সবটা হয়ে ওঠা কঠিন। একটা স্পনসর পেলে ভাল হয়। সে জন্য চেষ্টা করছি আমরা। দেখা যাক কী হয়। তবে ওর উচ্চতা ভাল। এখনই প্রায় ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। মনে হয় না উচ্চতা ওর টেনিসের জন্য বাধা হবে।’’
টেনিসে বিভানের আদর্শ কে? বসন্ত বললেন, ‘‘আমার ছেলে এমনিতে রজার ফেডেরারের ভক্ত। ফেডেরারের মতো বিভানও খেলার সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। তবে এখন ও সিনারের বড় ভক্ত। আপনার সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন সিনার পাশের একটা কোর্টে অনুশীলন করছেন। প্রথম বার সিনারকে সামনে থেকে দেখে বিভান দারুণ উচ্ছ্বসিত। নিজের অনুশীলন শুরুর আগে কিছু ক্ষণ তো সিনারকেই দেখল।’’
বিহান রেড্ডি। ছবি: সংগৃহীত।
মাস আট-নয় আগে প্রতিযোগিতা খেলতে শুরু করা বিভান উইম্বলডনের আসরে। এত বড় মঞ্চে এসেও ঘাবড়ে যায়নি সে। আত্মবিশ্বাসী বিভান অনূর্ধ্ব ১৪ পর্যায়ের দ্বিতীয় বাছাই। খেতাবের অন্যতম দাবিদার। বসন্ত অবশ্য এখনই এতটা ভাবতে চাইছেন না। তিনি বললেন, ‘‘এখানে ১৬ জন প্রতিযোগী রয়েছে। চারটে গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে ওদের। প্রতি গ্রুপে চার জন করে আছে। গ্রুপে সবাই সবার সঙ্গে খেলার পর যে সেরা হবে সে সেমিফাইনালে উঠবে। ফরম্যাটটা একটু আলাদা। সবাই খুব ভাল খেলোয়াড়। আগের প্রতিযোগিতার ফলাফল দেখে ক্রমতালিকা করা হয়েছে। বিহান ভারতে পর পর চারটে প্রতিযোগিতা জেতায় দ্বিতীয় বাছাই হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রথম ম্যাচ খেলবে বিহান। আশা তো করবই ও চ্যাম্পিয়ন হবে। সে জন্যই তো এখানে আসা আমাদের।’’
ভারতীয় হয়েও ক্রিকেটকে ছেড়ে টেনিসকে কেন বেছে নিল বিভান? এ দেশের ছোটরা তো সব ক্রিকেটার হতে চায়! বসন্ত বললেন, ‘‘চার বছর বয়সে বিভান আমেরিকায় চলে এসেছে। তখনও ভাল করে এ সব বুঝতে শেখেনি। ক্রিকেট কী ও জানে না। কোনও ক্রিকেটারকে চেনেও না। টেনিসই ওর প্রিয়। আমি অবশ্য ক্রিকেট খেলতাম। কিন্তু ছেলেকে ক্রিকেটে দিতে চাইনি। যদিও ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন ক্রিকেট খেলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এখানকার বাচ্চারা অনেকে খেলছে।’’
বিহানের বোনের বয়স এখন সাত। দাদাকে দেখে সেও ছ’মাস আগে টেনিস শেখা শুরু করেছে। তা হলে কি আমরা মারাট সাফিন-দিনারা সাফিনার ভারতীয় সংস্করণ পাচ্ছি? হেসে ফেললেন বসন্ত, ‘‘এত বড় কিছু ভাবার মতো জায়গায় আমরা নেই। আগে ওরা খেলুক। শিখুক। সবে তো শুরু করেছে। জানি না কত দূর এগোতে পারবে। রাস্তা অনেক লম্বা এবং কঠিন।’’
বিভানের আপাতত লক্ষ্য যত বেশি সম্ভব প্রতিযোগিতা খেলে র্যাঙ্কিং পয়েন্ট বৃদ্ধি করা। যাতে বড় মঞ্চে সরাসরি খেলার সুযোগ পায়। উইম্বলডন প্রথম ধাপ। আত্মবিশ্বাসী বিভান চায় সার্ভ-ভলির দুনিয়ায় মেতে থাকতে। বয়সে তিন-চার বছরের বড়দের সঙ্গে খেলে নিজেকে তৈরি করতে চায়। তাই তার লক্ষ্য অনূর্ধ্ব ১৮ পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় খেলা।