আবেগরুদ্ধ: লন্ডনে বিদায় নেওয়ার সময় রজার। ফাইল চিত্র
রজার ফেডেরারের অবসরের ঘোষণাটা আকস্মিক বলা যাবে না। অনেক দিন ধরেই এ রকম একটা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল। ওর হাঁটুর পরপর অস্ত্রোপচারের সময় থেকে প্রশ্নটা উঠছিলই আর কোর্টে ফিরতে পারবে কি না ফেডেরার। প্রায় এক বছরেরও বেশি ওকে প্রতিযোগিতার বাইরে থাকতে হয়েছিল।
ওর ঐশ্বরিক ফোরহ্যান্ড আর দেখা যাবে না ভেবেই কোটি কোটি ভক্তের মন খারাপ। অনেকেই জানতে চাইছে, ফেডেরারই সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় কি না? টেনিসে এক-একটা প্রজন্মে একাধিক মহাতারকা উঠে এসেছে—বিল টিলডেন, কেন রোজওয়াল, রয় এমার্সন, রড লেভার, বিয়র্ন বর্গ, আন্দ্রে আগাসি, পিট সাম্প্রাস, রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচ। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে আমার টেনিস খেলা এবং খেলা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনও প্রজন্মের সঙ্গেই অন্য প্রজন্মের তুলনা হতে পারে না। আমাদের সময় টেনিস খেলোয়াড়দের এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। তখন এত অত্যাধুনিক খেলার সরঞ্জাম পাওয়া যেত না, কাঠের র্যাকেটে খেলতে হত, কোনও ম্যানেজার ছিল না, নিজেকেই প্রতিযোগিতায় নামার চিঠি লেখা আর সব ব্যবস্থা, ইকনমি ক্লাসে যাত্রা করতে হত। এক এক মরসুমে টানা চার-পাঁচ মাসের জন্য সফর করতে হত। এখনকার মতো একটা প্রতিযোগিতা খেলেই বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার মতো সুযোগ ছিল না।
আমার প্রজন্মে আমি সেরা বলব রড লেভারকে। আর এই প্রজন্মের সেরা ফেডেরার। আমাদের প্রজন্মে লেভারের দাপট ঠিক কতটা ছিল, বলে বোঝানো কঠিন। টানা সাত বছর বিশ্বের এক নম্বর থাকা তো ছেড়েই দিলাম, লেভার এক মাত্র খেলোয়াড় যার অ্যামেচার (১৯৬২) আর ওপেন যুগে (১৯৬৯) একই ক্যালেন্ডার বর্ষে চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামই জেতার রেকর্ড রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে পাঁচ বছর লেভারকে গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে দেওয়া হয়নি। ওই পাঁচ বছর খেললে লেভারের মোট গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, ধারণা করা কঠিন। তবে লেভার নিজে কিন্তু মনে করে, ফেডেরার ওর চেয়ে এগিয়ে। লেভারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব। ফেডেরার নিয়ে আমাদের আলোচনায় এক বার ও বলেছিল, ‘‘রজারের সার্ভিসটা আমার চেয়ে ভাল।’’
আমিও ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি টেনিসের দূত হিসেবে ফেডেরারই সর্বোত্তম। কারণ প্রথমত ওর প্রতিভা। ওর খেলা দেখলে মনে হয় কোর্টে যেন প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। এতটাই অনায়াস ওর কোর্ট মুভমেন্ট। এক হাতে মারা ব্যাকহ্যান্ড, ক্যানভাসে শিল্পীর তুলি চালানোর মতো ফোরহ্যান্ড দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। অথচ ওর চেহারা কিন্তু একেবারেই পেশিবহুল নয়। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের সংখ্যায় নাদাল বা জোকোভিচ এগিয়ে থাকলেও ফেডেরারকেই আমি এগিয়ে রাখছি।
বিপক্ষকে চিরকাল সম্মান দিয়ে এসেছে রজার। কোর্টের বাইরে একেবারে মাটির মানুষ। একটা ঘটনার কথা বলি। ফেডেরারের এক সময়ের কোচ টোনি রোচ আমার খুব ভাল বন্ধু। উইম্বলডন চলার সময় এক দিন ফেডেরারের ম্যাচ দেখতে গিয়েছি। টোনি হঠাৎ ম্যাচ শুরুর আগে বলল, ‘‘তোমার সঙ্গে রজারের আলাপ আছে?’’ আমি বললাম, না। টোনি বলল, ‘‘চলো, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।’’ ফেডেরার কোর্টে নামার আগে টোনি ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই ফেডেরার বলল, ‘‘আপনার কথা আমি শুনেছি।’’ আমি তো অবাক।ফেডেরার বলে চলল, ‘‘টোনির মুখে আপনাদের টেনিস খেলার কথা অনেক শুনেছি। আলাপ করে খুব ভাল লাগল।’’ তখন ২০০৭। ফেডেরার বিশ্বের এক নম্বর। এত বড় এক জন খেলোয়াড়, অথচ কী নম্র। ওর সঙ্গে ওই কয়েক মুহূর্ত কথা বলে হৃদয় ভরে গিয়েছিল।
আমি উইম্বলডনে বসে বর্গ-ম্যাকেনরো দ্বৈরথ দেখেছি। কিন্তু ২০০৮ সালে উইম্বলডনের ফাইনালে রজার-রাফার ৪ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের দ্বৈরথ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। টেনিসের ইতিহাসে অনেক যাকে সর্বকালের সেরা ম্যাচও বলে। পাশাপাশি ২০০৯ অস্ট্রেলীয় ওপেন ফাইনালে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা লড়াই করে ফেডেরারকে হারিয়ে নাদালের প্রথম অস্ট্রেলীয় ওপেন জয়ের ম্যাচকেও সেরার তালিকায় রাখতে হবে। জোকোভিচের সঙ্গেও ফেডেরারের একাধিক অনবদ্য ম্যাচ রয়েছে। যার মধ্যে ২০১৯ উইম্বলডন ফাইনালে পাঁচ সেটের সেই ম্যাচ কে ভুলতে পারে!।
প্রতিদ্বন্দ্বীরাও ফেডেরারকে কতটা সম্মান করে লেভার কাপে ওর বিদায়বেলাতেই দেখেছে বিশ্ব। রজারের মতো ভাল মানুষ কিংবদন্তির জন্য এমন ফেয়ারওয়েলই তো মানায়!