অনবদ্য: সকলেই ধরে নিয়েছিলেন নিশ্চিত ছয়। অ্যাডাম জ়াম্পার বলে বিরাট কোহালির সেই লম্বা শট বাউন্ডারি লাইনের ছয় গজ আগে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফিয়ে ধরেছিলেন অ্যাশটন অ্যাগার (ডান দিকে)। কিন্তু শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে তিনি মাঠের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। তাই দ্রুত বল ছুড়ে দেন মাঠের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত বিরাটের ক্যাচটি নেন মিচেল স্টার্ক। এএফপি
বিরাট কোহালি কিন্তু অস্ট্রেলীয়দের প্রতি খুবই দরদি!
না, ভুল নয়। ঠিক কথা। এই তো ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ভারতীয় দর্শকরা স্টিভ স্মিথকে বিদ্রুপ করছিলেন বলে বিরক্ত কোহালি তাঁদের চুপ করতে বলেন। অস্ট্রেলিয়ার পেসার কেন রিচার্ডসন ‘ভিগান’ হয়েছেন। মানে প্রাণীজ কোনও খাদ্য (যার মধ্যে দুধ, মাখন, ক্রিম চিজও পরে) খান না। সেই রিচার্ডসনকে খাদ্যের সন্ধান দিয়েছেন ভারত অধিনায়ক। কোহালি নিজেও ‘ভিগান’। তাই খাবারও ভাগ করে খেয়েছেন অস্ট্রেলীয় পেসারের সঙ্গে। এ বারের আইপিএল নিলামে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর কিনে নেয় রিচার্ডসনকে। তার পরে কোহালি একটি টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন এই পেসারকে। যেখানে লেখেন, ‘‘এখানে এস। দারুণ সব খাবার খাওয়া যাবে।’’ যা দেখে তো রিচার্ডসন তো প্রায় আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন নাকি!
এই কোহালি হলেন ‘ডক্টর জেকিল’। মাঠে নামলেই অস্ট্রেলীয়রা আবার কোহালির মধ্যে ‘মিস্টার হাইড’-এর রূপ দেখতে পান। যে কোহালি নৃশংস, যে কোহালির আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলে তাঁর ব্যাট জ্বলে ওঠে।
ওয়াংখেড়েতে বিপর্যয়ের পরে হঠাৎ করে বেশ কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠে পড়েছিল। বলা হচ্ছিল, দাতা কর্ণ হয়ে কোহালি কেন তাঁর তিন নম্বর জায়গা ছাড়লেন? অস্ট্রেলীয়রা দাবি করছিলেন, তাঁরা ভারত অধিনায়কের ব্যাটিং-দুর্গে ছিদ্র আবিষ্কার করেছেন। শুরুর দিকে লেগস্পিনের সামনে নাকি স্বচ্ছন্দ নন কোহালি। তাই তাঁর জন্য দাওয়াই হিসেবে ছিলেন অ্যাডাম জ়াম্পা।
প্রত্যাশিত ভাবে তিন নম্বরেই নেমে কোহালি নিজের ইনিংসের শুরুতেই জ়াম্পাকে পেয়েছিলেন। কিন্তু জ়াম্পা তাঁর দূর্গে কোনও ছিদ্র খুঁজে বার করতে পারেননি। ঋষিসুলভ ভঙ্গিতে এই লেগস্পিনারকে সামলেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, অহং বোধকে প্রাধান্য দিয়ে হঠকারী কোনও শট খেলবেন না। তা জ়াম্পা যতই তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত করুন না কেন। কোহালি (৭৬ বলে ৭৮) ইনিংস গড়েছেন, উপযুক্ত সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ফাস্ট বোলার প্যাট কামিন্সকে স্বপ্নের কভার ড্রাইভ মেরেছেন। আর ভারতকে ৩৬ রানে জিতিয়ে সিরিজ ১-১ করতে সাহায্য করেছেন।
কোহালির ইনিংসে চোনা একফোঁটা অবশ্য আছে। তিনি সেই জ়াম্পার বলেই আউট হলেন। তবে উইকেটটা যতটা না জ়াম্পার, ততটাই ফিল্ডার অ্যাশটন অ্যাগারের। স্কোরবোর্ডে অবশ্য দেখাবে কোহালি কট স্টার্ক বো জ়াম্পা। যাঁরা খেলাটা দেখলেন, তাঁরা জানেন, এই ‘রিলে ক্যাচ’-এর আসল নায়ক অ্যাগারই। কোহালির ক্যাচটা লং অফের বাউন্ডারি লাইনে ধরার পড়ে অ্যাগার যখন ভারসাম্য হারিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দড়ির ও-পাশে, তিনি বলটা ছুড়ে দিলেন স্টার্কের দিকে। স্টার্ক চাইলেও ওই ক্যাচ ফস্কাতে পারতেন না।
সেনাপতি কোহালি এ দিন পেয়ে গিয়েছিলেন দুই সৈনিককে। প্রথমে শিখর ধওয়ন (৯০ বলে ৯৬)। তার পরে কে এল রাহুল। অস্ট্রেলিয়া যেন ধওয়নের সামনে লাল কাপড় হয়ে দেখা দেয়। উইকেট ছুড়ে না দিয়ে এলে সেঞ্চুরিটা নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটা ব্যাপার হয় ধওয়নের। ব্যাট করতে করতে চোট পেয়ে যান। বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভাঙা আঙুল নিয়ে। এ দিন দশম ওভারে প্যাট কামিন্সের বলে পাঁজরে আঘাত খেলেন। সেই নিয়ে ব্যাট করলেও আর ফিল্ডিং করতে নামেননি।
ওয়াংখেড়ের পরে জাতীয় আলোচনায় উঠে এসেছিলেন রাহুল। তাঁর জন্য যে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছিল স্বয়ং কোহালিকে। কারও, কারও কাছে তাই তিনি প্রায় খলনায়ক হয়ে উঠেছিলেন। রাহুলের কাজটা এ দিন আরও কঠিন হয়ে যায় তাঁর ব্যাটিং অর্ডারের জন্য। ওপেন থেকে তিনে, তার পরে একেবারে পাঁচে। রাহুল যখন ব্যাট করতে নামলেন, তখন ৩২ ওভার হয়ে গিয়েছে। এর কিছু পরে ফিরে গেলেন কোহালি। ভারত তখন তিনশোর ও-পারে কতদূর এগোতে পারবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজকোটের পিচে নিরাপদ স্কোর খুঁজতে চাওয়া বেশ কঠিন কাজ। সেই কাজ যতটা সম্ভব সহজ করতে শুরু করলেন রাহুল। তাঁর ৫২ বলে ৮০ রান দেখে মুগ্ধ মাইকেল স্লেটারের মতো পোড় খাওয়া প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান। ইনিংস বিরতিতে বলছিলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ার কাজটা কঠিন করে দিয়ে গেল রাহুল।’’ কেউ, কেউ তাঁর মধ্যে রাহুল দ্রাবিড়ের ছায়া দেখছেন। যিনি দলের স্বার্থে বিশ্বকাপে কিপিং করতেও রাজি হয়ে যান। এ দিন কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিপিং করলেন এই রাহুল। অ্যারন ফিঞ্চকে দুর্দান্ত স্টাম্পড করলেন। ভাল একটা ক্যাচও নিলেন। কোহালি কি তা হলে বিশ্বকাপের সেই রাহুলকে এই রাহুলের মধ্যে পেয়ে গেলেন?
কঠিন লক্ষ্যের দিকে অস্ট্রেলিয়াকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন গুরু-শিষ্য জুটি। স্টিভ স্মিথ এবং মার্নাস লাবুশেনের ব্যাটিং দেখতে দেখতে প্রেসবক্সে কে যেন বলে উঠলেন, ‘‘ক্রিকেটে কি ক্লোনিং চলে এসেছে!’’ সত্যি, মাঝে মাঝে বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল, স্মিথ না লাবুশেন— কে ব্যাট করছেন। হাঁটা-চলা, ব্যাটিংয়ের ধরন— সবই যে প্রায় এক রকম।
অভিষেক ম্যাচে লাবুশানে ৪৭ বলে ৪৬ করে রবীন্দ্র জাডেজার বলে ফিরে যেতেই ম্যাচ ভারতের দখলে চলে আসে। স্মিথের (৯৮) পক্ষে একা এই ম্যাচ জেতানো সম্ভব ছিল না।
ওয়াংখেড়েতে অস্ট্রেলিয়ার একটা উইকেটও ফেলতে পারেননি ভারতীয় বোলাররা। এ দিন ফেলে দিলেন ১০ উইকেটই। শুরু থেকেই যশপ্রীত বুমরার বলে সেই পুরনো ঝাঁঝটা দেখা যাচ্ছিল। প্রত্যাশিত ভাবেই গোধূলিতে ভারতীয় পেসারদের বল নড়াচড়া করেছে। আর অস্ট্রেলিয়ার কাজটা কঠিন হয়েছে। স্মিথকে ফিরিয়ে ওয়ান ডে ক্রিকেটে একশো উইকেট তুলে নেন কুলদীপ যাদব। রাজকোটে অস্ট্রেলিয়ার সিরিজ জয়ের আশাও ওখানেই শেষ। বাকি কাজটা করে দেন পেসাররা।
কিন্তু দুরন্ত জয়ের দিনেও কোহালির কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি থাকছে। তাঁর দুই ওপেনারই যে চোট পেয়ে গেলেন। ধওয়ন ব্যাটিংয়ের সময়। রোহিত ফিল্ডিং করতে গিয়ে। জয়ের মুহূর্তটা উপভোগ করতে এই দু’জনের কেউই মাঠে ছিলেন না।