ঐতিহাসিক জয়ের পঞ্চাশ বছরে একই মাঠে বিজয়ী কোহালিরা। টুইটার
ঠিক পঞ্চাশ বছর লাগল ইতিহাস ফিরে আসতে। ১৯৭১ সালে অজিত ওয়াড়েকরের দল ওভালে টেস্ট জেতার পরে ভারত এই মাঠ থেকে বারবার শূন্য হাতেই ফিরেছে। শূন্যতার সেই অধ্যায় শেষ হল বিরাট কোহালির হাত ধরে।
সোমবার, ওভাল টেস্টের শেষ দিন শুরুর আগে তিনটে ফলই সম্ভব ছিল। অতীতে দেখা যেত, শেষ দিনে ভারত ড্র করার কথাই বেশি ভাবছে। জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপাত না। কিন্তু এই ভারত যে বদলে গিয়েছে। শেষ দিনেও জয়ের এই খিদেটা চিনিয়ে দেয় নতুন এক ভারতকে। যা আসল প্রাপ্তি। অধিনায়ক কোহালি এবং কোচ রবি শাস্ত্রীর হাত ধরে যে দলের মানসিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। যার ফল, ওভালে ১৫৭ রানে জয় এবং সিরিজ়ে ২-১ এগিয়ে যাওয়া।
এই টেস্টের প্রথম দিন থেকেই দল নির্বাচনী বিতর্ক তাড়া করেছিল ভারতকে। অফস্পিনার আর অশ্বিনকে বাইরে রেখে খেলতে নামা নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন উঠেছিল। শেষ দিনে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ২১০ রানে থামিয়ে অধিনায়ক বিরাট বুঝিয়ে দিল, অশ্বিনকে ছাড়াও টেস্ট জয় সম্ভব। এবং, সেই এক স্পিনার-চার পেসার ফর্মুলাতেই জয় এল।
মানছি, এই মুহূর্তে অশ্বিন বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার। কিন্তু ভারত ওকে খেলাত কার জায়গায়? রবীন্দ্র জাডেজা বা শার্দূল ঠাকুর— এই দু’জনের এক জনকে বসাতে হত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ওভালে দুই স্পিনার ছাড়া খেলা বোকামি। সে কথা মানলে সুযোগ পায় না শার্দূল। আর তা হলে কি আদৌ ভারত এই টেস্ট জিতত? আমার মনে হয় না। প্রথম ইনিংসে ওরকম ভরাডুবির মধ্যে পাল্টা আক্রমণে লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি করে দেয় শার্দূলই। দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্যাট হাতে হাফসেঞ্চুরি। আর এ দিন তো প্রথমে রোরি বার্নসকে অসাধারণ একটা ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দিল। ‘শুরু’ এবং ‘সারা’— দুটোর নেপথ্যেই পেসার-অলরাউন্ডার শার্দূল। এর পরে তুলে নিল জো রুটের উইকেট। রুট আউট মানে ইংল্যান্ডও আউট! প্রথম টেস্টেও কিন্তু রুটকে ফিরিয়েছিল শার্দূল। ওকে অনেকেই ডাকে ‘লর্ড’ শার্দূল বলে। আমার কাছে ও এখন ‘জাদুকর শার্দূল’।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে একটা খুব চালু কথা আছে। ‘প্রেসিং ফুটবল’। গোলের জন্য সারা ক্ষণ বিপক্ষের উপরে চাপ তৈরি করে যাওয়া। বিরাটের নেতৃত্বে ভারত এখন ‘প্রেসিং ক্রিকেট’ খেলছে। অর্থাৎ, সবসময় উইকেট তোলার জন্য ঝাঁপানো। বিপক্ষ বড় রানের জুটি গড়লেও হাল না ছাড়া। শেষ দিনেও যেমন হল। মধ্যাহ্নভোজের পরে ইংল্যান্ডের রান একটা সময় ছিল দু’উইকেটে ১৪১। সেখান থেকে মাত্র ছ’ওভারের মধ্যে ছ’রানে চার উইকেট তুলে নিল ভারত। দুটো বুমরা, দুটো জাডেজা। বুমরার ওই ছ’ওভারের আগুনে স্পেলটা অনেক দিন মনে থাকবে। দারুণ রিভার্স সুইং পেল। মারাত্মক গতিতে ছিটকে দিল অলি পোপের স্টাম্প। তার পরে বিষাক্ত ইয়র্কারে ফিরিয়ে দিল
জনি বেয়ারস্টোকে।
প্রায় সবারই ধারণা ছিল, ওভালের নিষ্প্রাণ পিচে পেসাররা শেষ দিনে কিছু করতে পারবে না। স্পিনার ছাড়া গতি নেই। আর সেখানে ভারতের হাতে একমাত্র অস্ত্র জাডেজা। এখানেও বিশেষজ্ঞদের ভুল প্রমাণ করে দিল বিরাট-বাহিনী। শেষ দিনে পেসাররাই তুলল সাত উইকেট! বুমরা, শার্দূল দুটো। উমেশ যাদব তিনটে। ভারতীয় পেসারদের গতি এবং রিভার্স সুইং সামলাতে পারল না ইংল্যান্ড। জাডেজাও খারাপ বল করেনি। উইকেটের ‘স্পট’ কাজে লাগিয়ে বাঁ-হাতি স্পিনারের শিকার দুই।
এই ভারতীয় দলটা বারবার দেখিয়ে দিয়েছে, পিছিয়ে পড়েও কী ভাবে ফিরে আসা যায়। অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি, ইংল্যান্ডেও দেখলাম। তবে ওভালকে আমি সবার আগে রাখতে চাই। কারণ শেষ দু’দিন এই টেস্টে ভারত পুরো অভিভাবকহীন ছিল। প্রধান কোচ শাস্ত্রী, বোলিং কোচ বি অরুণ, ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধর করোনা আক্রান্ত হয়ে নিভৃতবাসে। একা দলটাকে পরিচালনা করল বিরাট। অসাধারণ অধিনায়কত্বের নমুনাও দেখা গেল। যেমন, যখনই বোলার পরিবর্তন করেছে, উইকেট পড়েছে। ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের জন্য ‘লেগট্র্যাপ’ কাজে লাগিয়েছিল। ব্যাকওয়ার্ড শর্টলেগ, শর্ট স্কোয়ারলেগ, শর্ট মিডউইকেট রেখে। এই ফাঁদে পা দিয়ে আউট হয় ক্রিস ওক্স। নতুন বল না নিয়ে পুরনো বলটা রেখে দিয়েছিল বেশ কিছু সময়। যে পুরনো বলেই ফিরে যায় রুট এবং ওক্স।