টক্কর: আর্জেন্টিনার আক্রমণ রুখছেন অধিনায়ক অমরজিৎ। ছবি: টুইটার।
ভারত ২ • আর্জেন্টিনা ১
প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে আনোয়ার আলির ফ্রি-কিকটা যখন পোস্টে লেগে গোলে ঢুকে ইতিহাস লিখছিল, তখন জালন্ধরের আনোয়ারপুরের বস্তির ছোট্ট আলোহীন ঘরে তাঁর পরিবার ঘুমিয়ে। বাড়ির পাশেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বায়ুসেনা ঘাঁটি। সেখান থেকে প্রবল গর্জনে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানগুলোর মতোই যেন আনোয়ারের বাঁক খাওয়া ফ্রি-কিকটা আছড়ে পড়ল আর্জেন্টিনার জালে।
হ্যাঁ, আর্জেন্টিনা! যাদের অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল টিম ছ’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। যে ‘যুব দলে’ কখনও খেলেছেন দিয়েগো মারাদোনা, কখনও লিয়োনেল মেসি। বিশ্ব-ফুটবলের নিতান্ত ‘সাধারণ ছাত্র’ ভারতের কাছে সেই টিমটাই হেরে গেল। যে দেশের ক্লাব মেসির বার্সেলোনা, কাকতালীয় ভাবে সেই স্পেনেই ঘটল ঘটনাটা। রবিবার বেশি রাতে কটিফ কাপের শেষ ম্যাচে ভারতের অনূর্ধ্ব-২০ দলের ২-১ গোলে জয় এল অসম যুদ্ধ লড়ে। কারণ, ছাব্বিশ মিনিট ভারত খেলল দশ জনে।
সোমবার সকাল থেকেই দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল দেশ জুড়ে! ফুটবলপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। আনোয়ার আলি, বরিস সিংহদের বিরুদ্ধে যে আর্জেন্টিনা রবিবার খেলল, তাদের কোচও দু’জন বিশ্বকাপার— লিয়োনেল স্কালোনি এবং পাবলো আইমার। ভারত অবশ্য গ্রুপের দু’টি ম্যাচ হেরে এবং একটি ড্র করে টুনার্মেন্ট থেকে আগেই বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনা-বধের বিরল কৃতিত্ব সেই ব্যর্থতা ঢেকে দিয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন করে।
খেলাটা ছিল আশি মিনিটের। শুরুর চার মিনিটে দীপক তাংরির গোল। তার পরে আনোয়ার যখন ২-০ করেন, তখন লাল কার্ড দেখে বাইরে চলে গিয়েছেন অনিকেত যাদব। কোনও মতে একটি গোল শোধ করে আর্জেন্টিনা। ফলে আনোয়ারের গোলটাই ‘জয়সূচক’ গোল।
ছ’বছর আগে জালন্ধরের বস্তির ঘর থেকে মিনার্ভা পঞ্জাবের অ্যাকাডেমির স্পটাররা তুলে আনেন আট বছরের আনোয়ারকে। সেখানে চার জন কোচের কাছে তালিম নিয়ে আনোয়ার আগুন হয়ে ওঠেন গত বছরের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পেয়ে। পর্তুগিজ কোচ লুইস নর্টন দ্য মাতোসের হাতে পড়ে যুব বিশ্বকাপ খেলার সময়েই চোখ টেনেছিলেন পনি টেলের লম্বা ঝকঝকে চেহারার আনোয়ার। মাতোস উচ্ছ্বসিত ছিলেন তাঁকে নিয়ে। আই-লিগের ইন্ডিয়ান অ্যারোজ দলের সব ম্যাচেই আনোয়ারকে খেলিয়েছিলেন মাতোস।
আরও পড়ুন: ‘১০ জনে খেলে আর্জেন্টিনাকে হারানোর খবরে মনটা ভাল হয়ে গিয়েছে’
এ বার আনোয়ার ইতিমধ্যেই সই করে ফেলেছেন আইএসএলের ক্লাব মুম্বই সিটি এফসিতে। অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশি দামে তাঁকে কিনেছে মুম্বই। পেয়েছেন প্রায় তিরিশ লাখ টাকা। ইচ্ছে, ইউরোপে খেলা। ঘনিষ্ঠ মহলে আনোয়ার বলেছেন, ‘‘আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল, আইএসএল খেলা। এটা খেলতে খেলতেই আমি ইউরোপের ক্লাবে ট্রায়াল দিতে চাই। ধীরাজ সিংহ যেমন দিচ্ছেন। আর আমার স্বপ্ন, ইউরোপের কোনও বড় ক্লাবের জার্সি পরে নামা।’’ দুর্দান্ত গোলটা নিয়ে অবশ্য সতীর্থদের আনোয়ার বলেছেন, ‘‘নিয়মিত অনুশীলনের ফল পেয়েছি। এর আগেও জার্মানিতে এ রকম একটা গোল করেছিলাম। বল মারার সময়ে সেটা মাথায় ছিল।’’
অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ভারতের যে দল ছিল, সেই দলের আট জন ফুটবলার খেলেছেন আর্জেন্টিনা ম্যাচটায়। বাকিরা ইন্ডিয়ান অ্যারোজের। জয়ের অন্যতম কারিগর পশ্চিমবঙ্গের দুই বাসিন্দাও। টালিগঞ্জের জিতেন্দ্র সিংহ এবং ইছাপুরের রহিম আলি। স্টপার জিতেন্দ্র পুরো ম্যাচ জুড়ে সামলেছেন মেসির দেশের দামাল ফরোয়ার্ডদের। পরিবর্ত হিসেবে নামেন মোহনবাগান অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা রহিম আলি। আর্জেন্টিনা তাঁকে ফাউল করার পরেই আনোয়ার ফ্রি-কিকটা পান। ভারতের প্রথম গোল যিনি করেন, সেই দীপক তাংরিও মোহনবাগান অ্যাকাডেমির ছেলে। দলের কোচ ফ্লয়েড পিন্টো বলছেন, ‘‘অবিশ্বাস্য জয়। এর ফলে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে সবাই ভারতকে আরও সমীহ করতে শিখবে।’’