ক্রীড়াপ্রেমীর পাতে মহাভোজ। ফাইল চিত্র।
সমাপতনই বটে। স্বাধীনতার ৭৫ পূর্তির বছরে, স্বাধীনতার মাস বলে কথা! আবার একই দিনে পর পর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এবং পাকিস্তান-ভারত টক্কর। রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় সল্টলেকে যুবভারতীর মাঠ আর দুবাইয়ে এশিয়া কাপের আসর। গড়পড়তা বাঙালি ক্রীড়াপ্রেমীর পাতে মহাভোজ।
“এ প্রজন্মের কাছে সন্ধেটা হয়তো চমৎকার বিনোদনের। কিন্তু কয়েকটি দিন ইতিহাসের স্মৃতিও উস্কে দেয়”, হেসে বলছিলেন ইতিহাসবিদ অমিত দে। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে-র পুত্র অমিতের মাতৃকুল আবার স্বাধীনতার আগে অখণ্ড বঙ্গ প্রদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের পরিবারের। তাঁর মা নাসিমা বানু, ফজলুল হকের প্রিয় ভাগ্নে আবু নাসের মহম্মদ ইউসুফ আলির কন্যা। অমিত হাসছিলেন, “আমার মাতৃকুলের একটা অংশ পাকেচক্রে পাকিস্তানে গেলেও আমার দাদু বরিশাইল্যা হয়েও দেশভাগ মানেননি। পার্ক সার্কাসেই ওঁর মাটি হয়েছে। আবার বাংলাদেশ গঠনের সময়েও পাকেচক্রে আমার নিজের মামা, মামিদের পাকিস্তানেই ঠাঁই হয়। একই সঙ্গে তিনটে দেশ পাকিস্তান,
ভারত, বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের মতো পরিবার, কলকাতায় বেশি মিলবে না।”
অমিতের মামা সদ্যপ্রয়াত সেলিম কুরেশি ১৯৭১-এর পর থেকে করাচিতেই থেকেছেন। মামিমা সলমা কুরেশি (বিয়ের আগে জয়া মুখোপাধ্যায়) এখনও সেখানেই। অমিত বলছিলেন, “মামিমা এখনও সব বিষয়ে সজাগ। ক্রিকেটেরও খবর রাখেন। আমাদের মতোই উনিও খেলাটায় নজর রাখবেন। তবে এখন ওঁরা পাকিস্তানেরই সমর্থক।”
মুম্বইয়ে এই সন্ধ্যায় অনন্যা দাশগুপ্তদের বাড়িতে আবার অন্য রকম ভাগাভাগি। কলকাতায় প্রাক্তন ক্রীড়া সাংবাদিক অনন্যা তাঁর মা অনিন্দিতার জেঠামশাই ১৯১১-র শিল্ডজয়ী মোহনবাগান একাদশের ফুলব্যাক কানু রায়ের গল্প শুনে বড় হয়েছেন। ‘বেয়ারফুট কানুদাদু’ বলে বইয়ের লেখক অনন্যা বলছেন, ‘ঢাকাইয়া কানুদাদু মোহনবাগানি হলেও আমার মায়েরা সব ইস্টবেঙ্গল। আবার আমার বাবা বাঙাল হয়েও মোহনবাগান। আমিও মোহনবাগানই হয়েছি!’ মুম্বইয়ের পার্সি শ্বশুরমশাই এবং বোহরি মুসলিম শাশুড়ির পরিবারে বিবাহিতা অনন্যার ছেলে, মেয়ে স্পন্দন ও চিনার অবশ্য এই সন্ধেটা মোহন-ইস্ট নয় ভারত-পাক নিয়েই মেতে থাকবে। তবে অনন্যার বাবা অচিন্ত্যকুমার দাশগুপ্তকে টিভি-র চ্যানেল ঘুরিয়ে মোহনবাগানের খবর নিতেই হবে। তিনিও এখন মুম্বইয়ে মেয়ের কাছে। অনন্যা ও তাঁর বর সিরাজ নিজেরা কোন খেলাটা দেখবেন, তত ভাবছেন না। তবে রবিবারের এই দুর্লভ সন্ধ্যায় দাদু এবং নাতিনাতনিদের মধ্যে মধ্যস্থতা তাঁদের করতেই হবে।
৭৫ বছর আগে দেশভাগের পরে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঢের তীব্র হয়েছিল। কিন্তু মাঠের নায়কেরা কখনওই ভাষা বা ধর্মের তকমায় চিহ্নিত হননি। অনন্যা বলছিলেন, “ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চ পাণ্ডব তো দক্ষিণ ভারতীয়। আমেদ, ভেঙ্কটেশ, সালে, ধনরাজ, আপ্পারাওদের ভাষা, ধর্ম নিয়ে বাঙালি কবে মাথা ঘামিয়েছে!” ঠিক তেমনই বাঙাল চুনি থেকে নাগাল্যান্ডের টি আও, পঞ্জাবের জার্নেলদের নিয়েও বরাবরই উদ্বেল মোহনবাগান। একেলে কর্পোরেট-শাসিত ফুটবলে দু’দলের তারকারা আবার অনেকেই বিদেশি। একই ভাবে সাড়ে সাত দশকে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের মাতামাতিও নানা পর্বান্তর দেখেছে। মুসলিম মানে পাকিস্তানি—এই অপপ্রচারের সামনে আজকের বাঙালি মুসলিম যুবক সমাজমাধ্যমে পাল্টা রসিকতা করে ঘৃণাকে নিভিয়ে দেন। অমিত বলছিলেন, “ফুটবল, ক্রিকেট, হকির সঙ্গে এ দেশের জাতীয়তাবোধের পুরনো যোগ। আজকের ভারত-পাক ক্রিকেটীয় টক্করও আসলে ঘৃণা নয়, পারস্পরিক সৌহার্দ্যেরই উৎসব। এ ভাবে দেখাটাই সময়ের দাবি।”