দুই কৃতি ছেলের মাঝে প্রয়াত হিমাংশু পাণ্ড্য। ফাইল চিত্র
সে অনেক বছর আগের কথা। ১৯৯৮ সাল। সুরত থেকে গাড়ি কেনা-বেচার ব্যবসার পাট চুকিয়ে বদোদরায় চলে এসেছিলেন হিমাংশু পাণ্ড্য। লক্ষ্য দুই ছেলেকে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার তৈরি করবেন। পাঠান ভাইদের মতো হতদরিদ্র অবস্থা পাণ্ড্য পরিবারের কখনও ছিল না, এটা সত্যি। কিন্তু দুই ছেলের ক্রিকেট পাঠের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন সেটা প্রয়াত হিমাংশুর কাছে ছিল না। ছেলেরা ম্যাগি খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। স্রেফ ক্রিকেট পাঠের জন্য। তারপরেই ক্রিকেট বিশ্ব পেয়েছে হার্দিক ও ক্রুণাল পাণ্ড্যকে।
কিন্তু কথায় আছে ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়’। পাণ্ড্য পরিবারের বড় কর্তার ক্রিকেটের প্রতি আবেগ দেখে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন কিরণ মোরে। প্রায় নিখরচায় দুই ভাইকে নিজের অ্যাকাদেমিতে সুযোগ দেন ভারতের প্রাক্তন উইকেট রক্ষক। তাই মোরে এই পরিবারের কাছে ভগবানের মতো। ওঁর কাছে যাওয়ার পর থেকে শুধুই উত্তরণ। তবে সেটা ভাই হার্দিক পাণ্ড্যর ক্ষেত্রে। দাদা ক্রুণাল পাণ্ড্য জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত দেখেছেন। ক্রিকেটীয় সাফল্যের বিচারে ভাই সবসময় দাদার থেকে এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এতে দুই ভাইয়ের সম্পর্কে একফোঁটাও চিড় ধরেনি। কারণ ওঁরা যে ওঁদের বাবার মতোই দিল খোলা।
আনন্দবাজার ডিজিটালকে ফোনে কিরণ মোরে বললেন, “দুই ভাই সিংহ হৃদয়। তবে আমার মতে ক্রুণাল অনেক বেশি লড়াকু। ক্রিকেটে সাফল্য পাওয়ার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে লড়াই করে আসছে। আজকের এই ইনিংস দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা অনেকদিন মনে রাখবে। তবে দুঃখের ব্যাপার হল হিমাংশু ভাই ওঁর বড় ছেলের এমন মারকুটে ব্যাটিং দেখে যেতে পারল না।”
প্রয়াত বাবাকে স্মরণ করে হার্দিকের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছেন ক্রুণাল। ছবি - টুইটার।
২০১৫ সালে হার্দিক মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে সুযোগ পান। এর পরের বছর আসে ক্রুণালের কাছে সুযোগ। দলের তৎকালীন প্রশিক্ষক জন রাইটের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ওঁদের আইপিএল সফর। কিন্তু রোহিত শর্মার দলে সুযোগ পাওয়ার আগে একাধিক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন ক্রুণাল। বদোদরার হয়ে বুচিবাবু ট্রফি খেলতে গিয়ে ওঁর বাঁ কাধের হাড় সরে যায়। একটা মরসুম মাঠের বাইরে চলে যান হার্দিকের দাদা। এর পর যখন ফের দলে ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন চলে এল ডাক বিভাগের সরকারি চাকরির প্রস্তাব। সেই সময় বেতন ছিল প্রায় ২০ হাজার। প্রয়াত হিমাংশু হয়তো সংসার টানতে পারছিলেন না। তাই যন্ত্রণা চেপে নিজের ও ছেলের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুণাল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সেই চাকরির চিঠি ছিঁড়ে ফেলে ফের কিট ব্যাগ কাঁধে তুলে নেন।
তাঁর সেই সিদ্ধান্ত সব হিসেব বদলে দেয়। ২০১৬ সালে রাজ্য দলের হয়ে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে দারুণ খেলা দেখালেন। জন রাইটের চোখ তো জহুরীর। তিনি এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে দলে নিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি। এর পর তো বাকিটা ইতিহাস।
যদিও কিরণ মোরে কোনও রাকডাক না করেই বলছেন, “আজ গোটা দেশ ক্রুণালের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, ওর কান্না দেখে অনেকের মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু ক্রুণালের এই ইনিংস দেখে নির্বাচকদের উপর আমার রাগ হচ্ছে। ক্রুণালের অনেক আগে দেশের হয়ে একদিনের ম্যাচ খেলে ফেলা উচিত ছিল। তাহলে আজকে দুই ভাইকে গোটা দুনিয়ার সামনে কাঁদতে হত না। ওদের বাবাও দুই ছেলের সাফল্যগুলো আরও আগে দেখতে পারতেন।”
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ওঁদের বাবা হিমাংশু পাণ্ড্য প্রয়াত হন। দুই ছেলের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মতো মিশতেন ওঁদের বাবা। স্বভাবতই পাণ্ড্য পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্যের প্রয়াণ মেনে নিতে পারেননি ক্রুণাল ও হার্দিক। বাইশ গজের যুদ্ধের মাঝে দুই ভাইয়ের চোখের জল এবং তাঁদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ বারবার যেন সেই প্রমাণ দিচ্ছিল।
২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক ঘটানোর আগে হার্দিকের হাত থেকে ‘ক্যাপ’ নিয়েছিলেন ক্রুণাল। মঙ্গলবার একদিনের ক্রিকেটে সফর শুরু করার সময়ও সেটাই হল। তিন বছরের মধ্যে তফাত শুধু একদিনের অভিষেক ম্যাচে বড় ছেলের এমন দাপুটে ব্যাটিং হিমাংশু পাণ্ড্য দেখে যেতে পারলেন না। তাই তো ‘ক্যাপ’ পাওয়া থেকে শুরু করে অর্ধ শতরান, কিংবা এর পরেও বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ক্রুণাল। আর দাদার চোখের জল দেখে কোন ভাই নিজেকে শান্ত রাখতে পারে।
তাই তো দাদা ক্রুণাল কীর্তি গড়ার পর আকাশের দিকে ব্যাট তুলে প্রয়াত বাবাকে স্মরণ করতেই ভাই হার্দিক দেশ দুনিয়ার পরোয়া না করে চোখের জল ফেললেন। যদিও ওঁদের ক্রিকেট ‘গুরু’র রাগ হচ্ছে। কারণ তাঁর সেরা ছাত্রকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি।