বন্ধু যুবরাজের পরামর্শেই পাল্টে গিয়েছে মানসিকতা

কাপ জিতলে তবেই না কাজে লাগবে এই ফর্ম, বলছেন রোহিত

ব্যাটিংয়ের মতোই সহজ, সরল ভঙ্গিতে তাঁকে দেখা গেল মাইক হাতেও। হেডিংলেতে পাঁচ নম্বর সেঞ্চুরি করার পরে সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষকে তিনি আড্ডার কক্ষেই পরিণত করে ফেললেন।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

ম্যাঞ্চেস্টার শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৯ ০৪:২২
Share:

রান-মেশিন: বিশ্বকাপে অবিশ্বাস্য ফর্মে রোহিত। সেমিফাইনালেও তাঁর ব্যাটের দিকে তাকিয়ে দল। ফাইল চিত্র

বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষ বোলারেরা তো বটেই, হেডিংলের আকাশে ওড়া বিমানও যেন তাঁর ছন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না। শনিবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ম্যাচে ভারত-বিরোধী স্লোগান নিয়ে সেই বিতর্কিত বিমান এক বার যখন মাথার উপরে চক্কর কাটছে, তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে। সেখান থেকে এক বার আলসেমি ভরা চোখে আকাশের দিকে তাকালেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা। ঠিক যে ভাবে বোলারদের দিকে তাকান। বোলার ভাবে, তিনি ঘুমোতে যাবেন। পরক্ষণেই আবিষ্কার করবে, বল বাউন্ডারিতে।

Advertisement

ব্যাটিংয়ের মতোই সহজ, সরল ভঙ্গিতে তাঁকে দেখা গেল মাইক হাতেও। হেডিংলেতে পাঁচ নম্বর সেঞ্চুরি করার পরে সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষকে তিনি আড্ডার কক্ষেই পরিণত করে ফেললেন। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির তো রবিবার জন্মদিন। আপনারা কী ভাবে সেলিব্রেট করবেন? রোহিতের জবাব, ‘‘আরে ইয়ার, হ্যাপি বার্থ ডে বলে দেব। এটাই তো বলে নাকি জন্মদিনে? আমরা তো রবিবার ট্র্যাভেলও করব। বাসের মধ্যে কেক-টেক নিশ্চয়ই কাটা হবে।’’

আর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে চাইলেন সঞ্জয় মঞ্জরেকর-রবীন্দ্র জাডেজা বিতর্ক নিয়ে। কিন্তু করলেন খুব ঘুরিয়ে। রোহিত তাঁকে থামিয়ে দিলেন, ‘‘আপনি তো নাম না নিয়েও নাম করেই দিলেন।’’ কিন্তু ব্যাটিংয়ের মতোই আলস্য ভরা ভঙ্গিতে জবাব দিতে থাকলেও তিনি যে চিন্তাশীল ব্যক্তি, তা গোপন থাকে না। চাপ কমানোর টোটকা হিসেবে যেমন বললেন, ‘‘আমরা যে হোটেলে উঠি, সেখানেও অনেক মানুষ পৌঁছে যায়, যারা কাপ জিততে চায়। এই ভালবাসাটা দারুণ কিন্তু সব সময় কানের মধ্যে যদি একটা আর্তি ঘুরতে থাকে তা হলে খুব চাপ তৈরি হয়ে যেতে পারে। আমি সে দিক দিয়ে বেশ ভাল আছি যে, পরিবার এখানে আছি। যখনই সুযোগ পাচ্ছি, ইংল্যান্ডের আবহাওয়া উপভোগ করছি পরিবার নিয়ে।’’ কথাবার্তা শুনে মনে হল জাডেজার মতো তিনি কখনও বিতর্কে জড়িয়ে পড়বেন না। ‘‘বাইরে কী ঘটছে আমি কানে তুলি না। দিনের শেষে আমার কাজটা হচ্ছে, দলের হয়ে নেমে রান করা। দলকে জিততে সাহায্য করা। দেখতে হবে যাতে ফোকাস নড়ে না যায়।’’

Advertisement

শনিবার ম্যাচ জেতার পরে পুরস্কার বিতরণীতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক ম্যাচে নামার আগে ভাবার চেষ্টা করছেন, আগে কোনও ওয়ান ডে খেলেননি। এটাই প্রথম। বলার জন্য সহজ কিন্তু কাজে করে দেখানো কত কঠিন? জানতে চাওয়া হল। রোহিত বললেন, ‘‘কাজটা সহজ নয় ঠিকই। কারণ, এমন একটা দুনিয়ায় আছি যেখানে আশেপাশে সারাক্ষণ এ সব নিয়েই তো কথা নয়। কতগুলো সেঞ্চুরি হল? কত রান হল? ক’টা উইকেট পেল? এ সব তো চলতেই থাকে। তবু এ সবের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রত্যেক ম্যাচকে নতুন ভাবতে হবে।’’ অতীতে বহু বার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ধারাবাহিকতা নিয়ে। এ বার যেন নতুন রোহিত। রানমেশিনে পরিণত তিনি। রান করে যাওয়ায় কোনও ক্লান্তি নেই।

মাইকেল হোল্ডিংয়ের নামকরণ হয়েছিল ‘হুইসপারিং ডেথ’। এত সুন্দর, ছন্দময় দৌড় ছিল তাঁর যে, আম্পায়ারেরা বুঝতেই পারতেন না, কখন হোল্ডিং চলে এসেছেন বোলিং করতে। নামটা আম্পায়ার ডিকি বার্ডেরই দেওয়া। এক বার বোলার কেন আসছে না, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, হোল্ডিং বল ডেলিভারি করতে তৈরি। রোহিতও যেন ব্যাটিংয়ের ‘হুইসপারিং ডেথ’। নিঃশব্দ ঘাতকের মতোই অপারেশন চালিয়ে যান তিনি। বিশ্বকাপের এমন স্বপ্নের ফর্মের নেপথ্যে কোনও রহস্য-টহস্য নেই বলেই জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি। ‘‘কোনও আলাদা প্রস্তুতি নিইনি। শুধু খুব ভাল মানসিক জায়গায় থাকতে চেয়েছিলাম। আমি জানতাম, এ বারের বিশ্বকাপ অন্য রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। দশটা ম্যাচ খেলে ফাইনালে পৌঁছতে হবে। অন্যান্য বারের মতো নয়। তাই শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মানসিক ভাবে ঠিক জায়গায় অবস্থান করাটা খুব জরুরি ছিল,’’ বলে রোহিত শোনালেন তাঁর মানসিক প্রস্তুতির কথা। ‘‘আমি ঠিক করেছিলাম, অতীতে পড়ে থাকব না। এক-একটা করে ম্যাচ হিসেবে দেখব এবং যে মুহূর্তে আজকের ম্যাচটা হয়ে যাবে, এই মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাব।’’ আন্দাজ পাওয়া গেল, তাঁর বিশ্বকাপ সাফল্যের রহস্য কী। আত্মতুষ্টি ঢুকতে দিচ্ছেন না বলেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন। বলেই রোহিতের হয়তো মনে পড়ে গেল, ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা। এত দিন দু’হাত ভরে দিয়েছে। কালই হয়তো কেড়ে নিল। তাই যোগ করে দিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত এই ভাবনা কাজে দিয়েছে। জানি না ভবিষ্যতে কাজ করবে কি না।’’

বিশ্বকাপে পাঁচটা সেঞ্চুরি করে নতুন রেকর্ড। এটাকেই কি আপনার সেরা সময় বলবেন? রোহিত বলে দিলেন, ‘‘না, না। এখনই সেরা মুহূর্ত বলার সময় আসেনি। যদি আমরা বিশ্বকাপ জিততে পারি, তখন এটাকে সেরা সময় বলতেই পারি। তার আগে নয়। তার কারণ, আসল লক্ষ্য তো বিশ্বকাপ জেতা। কত রান করলাম, কটা উইকেট পেলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল হচ্ছে ম্যাচ জেতা। খেলোয়াড় হিসেবে আমার কাজ সেই জয়ে অবদান রাখা।’’ আরও গভীর ব্যাখ্যা দিলেন এর পরে, ‘‘আমরা প্রত্যেকে নিজেদের কাজ করতে চাইছি। বিশ্বকাপ জেতার জন্য সেটা জরুরি। মনে রাখা দরকার, বিশ্বকাপ আসে চার বছর পর-পর। আবার একটা বিশ্বকাপে খেলার জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। যদি এ ভাবেই খেলে সেমিফাইনাল, ফাইনাল জিততে পারি তখন সব পরিশ্রম সম্পূর্ণতা পাবে। তখন না হয় সেরা সময় বলা যাবে।’’

বিশ্বকাপ খেলতে আসার আগে আইপিএলে খুব ভাল ছন্দে ছিলেন না রোহিত। চিন্তায় পড়ে যুবরাজ সিংহের সঙ্গে কথা বলেন। জানতে চান, বড় মঞ্চে রান করতে গেলে কী করতে হবে? রোহিত ঠিক লোকের কাছেই গিয়েছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপের ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট যুবরাজ অবশ্য বেশি কথার মধ্যে যাননি। শুধু বলেন, ‘‘চিন্তা করতে হবে না। ঠিক সময়ে রান পাবি।’’ সঠিক মানসিক অবস্থানে নিজেকে ধরে রাখার টোটকাটা রোহিতকে দেন যুবিই। ‘‘আমার দারুণ বন্ধু যুবি। সব রকম কথা বলতে পারি। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে ও খুব ভাল ফর্মে ছিল না। ও আমাকে বলে, ২০১১ বিশ্বকাপের আগে নিজে ঠিক মানসিক অবস্থানে থাকতে চেয়েছিল। সেটা করেই সফল হয়েছিল।’’ একটা বিশ্বকাপে সচিন তেন্ডুলকরের করা সর্বোচ্চ রান থেকে আর মাত্র ২৪ রান দূরে তিনি। দেখা গেল, রোহিত ২০১১-তে করা সচিনের সেই রেকর্ডের খবরই রাখেন না। একদম ঠিকই বলেছেন তিনি। ‘‘রেকর্ডের জন্য খেলতে আসিনি। টিমকে জেতাতে এসেছি।’’ আর একটা কথা বললেন। সেই সময় আরও চোয়াল শক্ত দেখাল। ‘‘বাস্তবে থাকতে চাই। কতটা কী করে ফেললাম, তা ভেবে উড়তে চাই না। আমরা এখানে মিশনে এসেছি আর তা এখনও পূরণ হয়নি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement