হুঙ্কার: তিন উইকেট নিয়ে নায়ক ওয়াহাব রিয়াজ। গেটি ইমেজেস
পাকিস্তান দল নিয়ে একটা কথা আমি অনেক বারই বলেছি। কোনটা যে ওদের আসল দল, তা বোঝা কঠিন। এক দিন এমন খেলবে, দেখে মনে হবে, এই দলটার কিস্সু হবে না। আবার পরের দিন সেই পাকিস্তানের খেলা দেখে মনে হবে, ওদের আটকানোর মতো প্রতিপক্ষ কোথায়?
এই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের প্রথম দুটো ম্যাচই ধরুন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে দলটা ১০৫ রানে শেষ হয়ে গেল, তারাই কি না ফেভারিট ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৪৮ রান তুলে ফেলল! বিশ্বের এক নম্বর ওয়ান ডে দলকে ১৪ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপে আরও একটা অঘটন ঘটিয়ে দিল সরফরাজ় আহমেদরা। সত্যি বলছি, এই পাকিস্তান দলটা কোন দিন কেমন খেলবে, তা বলা সম্ভব নয়।
এই ইংল্যান্ডের প্রধান শক্তি অবশ্যই ব্যাটিং। ওদের বোলিং দুর্বলতা কিন্তু সামনে চলে আসছে। এই বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই কিছু দিন আগের দ্বিপাক্ষিক সিরিজে নিয়মিত তিনশো রান তুলে এসেছে পাকিস্তান। এ দিনও তুলল। এও বোঝা গেল, দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তিনশোর উপরে রান তাড়া করে জেতা এক জিনিস আর বিশ্বকাপে আর এক। বিশ্বকাপে ফেভারিট হওয়ার চাপটা ভালই টের পাচ্ছে ইংল্যান্ড। পাশাপাশি বলব, মহম্মদ আমির, ওয়াহাব রিয়াজ় ও শাদাব খান দলে আসায় পাকিস্তানের বোলিং রীতিমতো শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে।
এই বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিটা এল জো রুটের (১০৪ বলে ১০৭) ব্যাট থেকে। আর ছয় নম্বরে নেমে দুরন্ত ইনিংস খেলে গেল বাটলারও (৭৬ বলে ১০৩)। কিন্তু এই জোড়া সেঞ্চুরি সত্ত্বেও জিততে পারল না ইংল্যান্ড।
সোমবার যে পাকিস্তানকে ট্রেন্ট ব্রিজে দেখলাম, তার সঙ্গে আগের ম্যাচের পাকিস্তানের কোনও মিল নেই। শুরু থেকেই আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার শপথ নিয়ে নেমেছিল ওরা। সেটা ব্যাটিংয়ে হোক কী বোলিংয়ে। উইকেট তোলার জন্য লেগস্পিনার শাদাবকে দিয়ে বোলিং ওপেন করাল। উইকেটও পেল শাদাব। পাকিস্তানকে ইদানীং যে ব্যাটসম্যান খুব ভুগিয়েছে, সেই জেসন রয়কে ফিরিয়ে দিল।
পাকিস্তানের দুই বাঁ হাতি পেসার এ দিন বিশেষ করে নজর কাড়ল। মহম্মদ আমির এবং ওয়াহাব রিয়াজ়। ভাগ্য ভাল থাকলে শুরুতেই রুটকে পেয়ে যেত আমির। স্লিপে রুটের ক্যাচ ফেলে দিল বাবর আজ়ম। কিন্তু শেষের দিকে বাটলারকে একটা স্লোয়ার ডেলিভারিতে তুলে নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল সেই আমিরই।
দু’বছর বাদে ওয়ান ডে দলে ফিরে এসে দুরন্ত বোলিং করে গেল ওয়াহাব রিয়াজ়ও। ৪৮তম ওভারে পরপর দু’বলে ফিরিয়ে দিল মইন আলি ও ক্রিস ওক্সকে। ইংল্যান্ডের হাত থেকে ম্যাচ বেরিয়ে যায় ওখানেই। মনে রাখতে হবে, এই দুই পেসারকেই কিন্তু বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলে রাখেননি পাক নির্বাচকেরা। কিন্তু চূড়ান্ত দলে রেখে ভুল শুধরে নিয়েছেন। এও বোঝা গেল, অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প নেই। এ দিন পাকিস্তানের জয়ের পিছনে রয়েছে তিন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারেরই অবদান— আমির, ওয়াহাব এবং মহম্মদ হাফিজ়।
দুই ওপেনার ভাল শুরু করার পরে পাকিস্তান ব্যাটিংকে টানল হাফিজ়। চার নম্বরে নেমে করল ৬২ বলে ৮৪। পরে সাত ওভারের অফস্পিনে ৪৩ রান দিয়ে এক উইকেট। স্বাভাবিক ভাবে ম্যাচের সেরা হাফিজ়ই।
পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছে। এক, ইংল্যান্ড মোটেই অপরাজেয় নয়। দুই, স্পিনাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেছে বিশ্বকাপে। তিন, পরপর দু’দিন বাংলাদেশ-পাকিস্তান বড় অঘটন ঘটিয়ে বার্তা দিল, এশিয়ার দলগুলোকে হারানো কঠিন হবে।
সোমবার নটিংহ্যামে পাকিস্তানের ব্যাটিং দেখে একটা কথা বলতেই হবে। ওদের শরীরী ভাষা এবং মানসিকতা কিন্তু সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। দেখে যেন মনে হচ্ছিল, প্রথম থেকেই আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার মনোভাব নিয়ে নেমেছে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা।
আগের ম্যাচে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসারদের শর্ট বল। বোঝা যাচ্ছিল, ইংল্যান্ডও একই কৌশল নেবে। যে কারণে লায়াম প্লাঙ্কেটের বদলে মার্ক উডকে এই ম্যাচে নিয়ে আসে ওরা। উডের বলে প্লাঙ্কেটের চেয়ে গতি অনেক বেশি। টস জিতে ইংল্যান্ড আগে পাকিস্তানকে ব্যাট করতে পাঠিয়ে হয়তো ভেবেছিল, আর্চার-উডের দ্রুতগতির শর্ট বল সমস্যায় ফেলে দেবে পাক ব্যাটসম্যানদের।
কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। ইংল্যান্ড শর্ট বল করতে কসুর করেনি। কিন্তু পাকিস্তানের দুই ওপেনার— ইমাম উল হক এবং ফখর জ়মান সেই শর্ট বল ভালই সামলে দেয়। পরের দিকে হাফিজ়ের নেতৃত্বে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তান। পাক ব্যাটসম্যানদের দেখে একটা কথা মনে হল। ওরা মনে হচ্ছে নেট প্র্যাক্টিসে খুব বেশি করে শর্ট বলের বিরুদ্ধে অনুশীলন করে এসেছে। তা ছাড়া ওশেন থমাস বা আন্দ্রে রাসেলের মতো গতিও ইংল্যান্ড বোলারদের হাতে ছিল না, যাতে করে সমস্যায় পড়তে পারে হাফিজ়রা।
ট্রেন্ট ব্রিজের পিচটা এমনিতে ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ। এখানে দুটো চারশো রানের ওপর ইনিংস আছে। গত বছরই এই মাঠে ৪৮১-৬ রান তুলে বিশ্বরেকর্ড করেছিল ইংল্যান্ড। পিচ যতই নিষ্প্রাণ হোক না কেন, পাক ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্ব দিতেই হবে এই ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।
স্কোরকার্ড
পাকিস্তান ৩৪৮-৮ (৫০)
ইংল্যান্ড ৩৩৪-৯ (৫০)
পাকিস্তান
ইমাম ক ওকস বো মইন ৪৪•৫৮
ফখর স্টাঃ বাটলার বো মইন ৩৬•৪০
বাবর ক ওকস বো মইন ৬৩•৬৬
হাফিজ় ক ওকস বো উড ৮৪•৬২ সরফরাজ় ক ও বো ওকস ৫৫•৪৪
আসিফ ক বেয়ারস্টো বো উড ১৪•১১
শোয়েব ক মর্গ্যান বো ওকস ৮•৮
ওয়াহাব ক রুট বো ওকস ৪•২
হাসান ন. আ. ১০•৫
শাদাব ন. আ. ১০•৪
অতিরিক্ত ২০
মোট ৩৪৮-৮ (৫০)
পতন: ১-৮২ (ফখর, ১৪.১), ২-১১১ (ইমাম, ২০.১), ৩-১৯৯ (বাবর, ৩২.৫), ৪-২৭৯ (হাফিজ়, ৪২.৪), ৫-৩১১ (আসিফ, ৪৬.১), ৬-৩১৯ (সরফরাজ়, ৪৭.২), ৭-৩২৫ (ওয়াহাব, ৪৭.৫), ৮-৩৩৭ (শোয়েব, ৪৯.১)।
বোলিং: ক্রিস ওকস ৮-১-৭১-৩, জোফ্রা আর্চার ১০-০-৭৯-০, মইন আলি ১০-০-৫০-৩, মার্ক উড ১০-০-৫৩-২, বেন স্টোকস ৭-০-৪৩-০, আদিল রশিদ ৫-০-৪৩-০।
ইংল্যান্ড
রয় এলবিডব্লিউ বো শাদাব ৮•৭
বেয়ারস্টো ক সরফরাজ় বো ওয়াহাব ৩২•৩১
রুট ক হাফিজ় বো শাদাব ১০৭•১০৪
মর্গ্যান বো হাফিজ় ৯•১৮
স্টোকস ক সরফরাজ় বো শোয়েব ১৩•১৮
বাটলার ক ওয়াহাব বো আমির ১০৩•৭৬
মইন ক ফখর বো ওয়াহাব ১৯•২০
ওকস ক সরফরাজ় বো ওয়াহাব ২১•১৪
আর্চার ক ওয়াহাব বো আমির ১•২
রশিদ ন. আ. ৩•৪
উড ন. আ. ১০•৬
অতিরিক্ত ৮ মোট ৩৩৪-৯ (৫০)
পতন: ১-১২ (রয়, ২.১), ২-৬০ (বেয়ারস্টো, ৮.৬), ৩-৮৬ (মর্গ্যান, ১৪.৫), ৪-১১৮ (স্টোকস, ২১.২), ৫-২৪৮ (রুট, ৩৮.৫), ৬-২৮৮ (বাটলার, ৪৪.৩), ৭-৩২০ (মইন, ৪৭.৫), ৮-৩২০ (ওকস, ৪৭.৬), ৯-৩২২ (আর্চার, ৪৮.৪)।
বোলিং: শাদাব খান ১০-০-৬৩-২, মহম্মদ আমির ১০-০-৬৭-২, ওয়াহাব রিয়াজ় ১০-০-৮২-৩, হাসান আলি ১০-০-৬৬-০, মহম্মদ হাফিজ় ৭-০-৪৩-১, শোয়েব মালিক ৩-০-১০-১।