বিধ্বংসী: পঞ্চম সেঞ্চুরি রোহিতের। এই বিশ্বকাপে সর্বাধিক রানও তাঁর। গেটি ইমেজেস
পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মাঝপথে থামিয়ে দিলেন কেভিন পিটারসেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন অভিনন্দনের জন্য। তার পরে জড়িয়ে ধরলেন।
সেই আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে নায়ক ছুটলেন সঞ্জয় মঞ্জরেকরকে ইন্টারভিউ দিতে। সারা দিন ধরে হেডিংলেতে জল্পনা চলছিল, যদি রবীন্দ্র জাডেজা এ দিন ম্যাচের সেরা হন, কী হতে পারে? তখনও কি মঞ্জরেকর আসবেন ইন্টারভিউ নিতে? আর জাডেজা কি রাজি হবেন তাঁর সামনে দাঁড়াতে?
রোহিত গুরুনাথ শর্মার সৌজন্যে অবশ্য ম্যাচের সেরার পুরস্কারটাই চলতি বিশ্বকাপে নিয়মরক্ষার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হালফিলে বিরাট কোহালি সম্পর্কে বলা হচ্ছিল, ক্রিকেট মাঠে আরও একটা দিন আর কোহালির আরও একটা সেঞ্চুরি। রান করাটা এতটাই জলভাত করে ফেলেছিলেন ভারত অধিনায়ক। চলতি বিশ্বকাপে রানমেশিন কোহালিকে ছাপিয়ে যাওয়ার অসম্ভব কাজ করে দেখাচ্ছেন রোহিত। এ দিন চলতি টুর্নামেন্টে পাঁচ নম্বর সেঞ্চুরি হয়ে গেল। একই বিশ্বকাপে এতগুলো সেঞ্চুরির রেকর্ড কারও নেই। এখনও সেমিফাইনাল, ফাইনাল বাকি। এর আগে কুমার সঙ্গকারার একই বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি ছিল। সেটাই ছিল রেকর্ড।
হেডিংলেতে শনিবারের সেরা দৃশ্য? ম্যাচ জেতার পরে রোহিতের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন কোহালি। ভারতীয় ক্রিকেটের রোলস রয়েস এবং ফেরারি তাঁরা। কখনও রোলস রয়েস এগিয়ে, কখনও ফেরারি। বিশ্বকাপের হাইওয়েতে আপাতত অনেক এগিয়ে গিয়েছেন রোহিত ‘ফেরারি’ শর্মা।
ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট নিয়ে দারুণ একটা গল্প খুব বিখ্যাত হয়ে আছে। দু’জন ক্রিকেট ভক্ত হেডিংলেতে খেলা দেখতে এসেছেন। গ্যালারিতে বসেই তাঁরা আবিষ্কার করেন, স্যান্ডউইচই আনেননি। তা হলে আর কী ভাবে ইয়র্কশায়ারীয় হলেন? এক জন তাই তক্ষুনি রওনা দিলেন বাড়ির দিকে। ফিরে এসে সঙ্গীকে বললেন, ‘‘খুব খারাপ খবর আছে। বাড়িতে আগুন লেগেছে। দেখে এলাম জামাকাপড় সব পুড়ছে, বেড রুম দাউ দাউ করে জ্বলছে। স্ত্রী আর আমার দুই সন্তান রাস্তায় বসে কাঁদছে। আজ তাই স্যান্ডউইচ আর পাওয়া যাবে না!’’ বন্ধুটি চুপ করে শুনলেন। তার পর মুখ খুললেন তিনি, ‘‘আমার কাছে তোমার জন্য আরও খারাপ খবর আছে। লেন হাটন আউট হয়ে গিয়েছে।’’
লেন হাটনের ইয়র্কশায়ার। জেফ বয়কটের ইয়র্কশায়ার। বিখ্যাত সব ওপেনার বেরিয়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের তীর্থ ভূমি থেকে। সেখানেই আধুনিক যুগের ওয়ান ডে ক্রিকেটের সেরা এক ওপেনারের জয়পতাকা উড়ছে। হাটনের মতোই ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের কাছে সব চেয়ে বড় দুঃসংবাদ হবে যদি মাঠে ঢুকে তাঁরা শোনেন, রোহিত আউট।
প্রেস বক্স থেকে দেখলাম, মাঠের মধ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে কোহালি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন রোহিতের, তার একটু দূরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভিভিএস লক্ষ্মণ। পূর্ববর্তী প্রজন্মের দুই কিংবদন্তি। মাঠে রোহিতের রোশনাই চলছে। আর মাইক হাতে তার ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন পূর্বসূরিরা। এই হেডিংলেতেই সৌরভের অধীনে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট জয়। ভেজা পিচে প্রথমে ব্যাট করে ছ’শোর উপরে তোলে ভারত। ব্যাটিংয়ে চার মহারথীই সেঞ্চুরি করেন। সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভিভিএস লক্ষ্মণ। চতুর্ভুজের দু’জন সচিন এবং রাহুল ছিলেন না। সচিন এই ম্যাচটাতেই কমেন্ট্রি বক্স থেকে বিশ্রাম নিলেন। ফেরার কথা আবার সেমিফাইনালে। আর দ্রাবিড় এখন ভারতীয় যুব দলের দায়িত্বে বলে কমেন্ট্রি বক্সে বসার অনুমতি নেই।
কিন্তু সৌরভ-লক্ষ্মণরা দেখে নিতে পারলেন, তাঁদের সেই স্বর্ণ যুগের ব্যাটিং গ্রুপের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো দু’জন অন্তত এখনকার প্রজন্মে আছেন। বিরাট এবং রোহিত। দ্রুত সেখানে যোগ দিতে পারেন কে এল রাহুল। ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে দারুণ দর্শনীয় সব স্ট্রোক খেলার ক্ষমতা রয়েছে রাহুলের। দক্ষিণ ভারতীয় ব্যাটিং পরম্পরাকে অক্ষুণ্ণ রেখে অসাধারণ ব্যাকফুট প্লে। শুধু একটাই সমস্যা। রোহিত যেমন সেঞ্চুরি করাকে অভ্যেসে পরিণত করেছেন, রাহুল তেমনই সুযোগ কী ভাবে জলে ফেলে আসতে হয়, তার উদাহরণ হয়ে উঠছিলেন। এ দিন অবশেষে সেই খরা দূর করতে পারলেন। রোহিত করলেন ৯৪ বলে ১০৩। ইনিংসে ১৪টা চার, ২টো ছয়। রাহুল ১১৮ বলে ১১১। মেরেছেন ১১টি চার, ১টি ছয়। শ্রীলঙ্কার ২৬৪-৭ স্কোরের জবাবে সফল রান তাড়া করার রিংটোন সেট করে দিলেন দুই ওপেনার। প্রথম উইকেটে তাঁরা ৩০ ওভারে তুলে দিলেন ১৮৯। এ দিনও সচেতন ভাবে শুরুর দিকে স্কোরিং রেট বাড়াতে দেখা গেল তাঁদের। দশ ওভারের প্রথম পাওয়ার প্লে-তে দু’জনে মিলে তুললেন ৫৯ রান। সেমিফাইনালের আগে ওপেনারদের ব্যাটিং নীতিতে এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ভারতীয় দলে আরও গভীরতা যোগ করছে।
ওপেনারদের আরও একটা সুপারহিট দিনে শ্রীলঙ্কার ২৬৪-৭ স্কোরকে ভারত টপকে গেল ৪৩.৩ ওভারে। কোহালি ৪১ বলে ৩৪ নট আউট করে সেমিফাইনালের জন্য গা গরম করে রাখলেন। জনমানবের কোলাহল থেকে দূরে একটি হোটেলে উঠেছে ভারতীয় দল। সেমিফাইনালের আগে শেষ ক’টি দিন জনতার ভিড়কে এড়াতে চেয়েছেন ক্রিকেটারেরা। সঙ্গে রয়েছে স্ত্রী, পরিবারও। এ দিন যেমন মাঠে দেখা গেল অনুষ্কাকে। রোহিতের সেঞ্চুরির সময় হাততালি দিচ্ছেন। তা-ও বিরুষ্কা শো এখনও শুরুই হয়নি সে ভাবে। এখন রো-হিট এবং রীতিকা জুটির রমরমা চলছে।
সেমিফাইনালের টিকিট আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল রোহিতদের। এ দিন তাঁরা যেটা করতে পারতেন, তা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথম হওয়ার রাস্তায় এগিয়ে থাকা। সার্জেনের মতো নিখুঁত অপারেশন চালিয়ে সেটা তাঁরা করলেন। তার পর নিরিবিলি হোটেলে ফিরে গেলেন। সেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে চাপমুক্তি ঘটিয়ে পাড়ি দেবেন সেমিফাইনাল ঘাঁটির দিকে।
অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের ফলাফল দেখে ঠিক হবে, টিম ইন্ডিয়ার বাস এ বার কোন রুট ধরবে। ম্যাঞ্চেস্টারমুখী হবে নাকি যাবে ফের বার্মিংহামে? ফুটবলের শহরে যাওয়া মানে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। বার্মিংহামে ফেরা মানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নিউজ়িল্যান্ডের সঙ্গে খেলার সুবিধা। রোহিত অবশ্য বলে গেলেন, ‘‘আমরা প্রতিপক্ষ কে, তা নিয়ে ভাবি না। আমরা নিজেরা যদি ভাল খেলতে না পারি, যে কেউ হারিয়ে দিয়ে যেতে পারে।’’ রাউন্ড রবিন পর্বে ৭-১ স্কোরলাইন নিয়ে শেষ চারে খেলতে যাচ্ছেন তাঁরা। ম্যাচের নায়কের মুখে ব্যক্তিগত কীর্তির দিনে বেশি করে দলের কথা। বললেন, ‘‘দারুণ একটা গ্রুপ রয়েছে আমাদের। সকলে একসঙ্গে খেলতে পেরেই সব চেয়ে আনন্দিত আমি।’’
শনিবার অধিক রাত পর্যন্ত চলল সেই নাটক। সাংবাদিক থেকে শুরু করে ক্রিকেট দর্শকের দল, সকলে উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে রোহিতরা কোথায় খেলবেন। উৎকণ্ঠার অবসান হল ভারতীয় সময় গভীর রাতে। আগামী মঙ্গলবার ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম সেমিফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ নিউজ়িল্যান্ড।
ভারতীয় সমর্থকদের বিশ্বাস, ট্রেন্ট বোল্টদের বিরুদ্ধেও দেখা যাবে রোহিতদের রোশনাই!