অভিনন্দন: সেঞ্চুরির পরে রোহিতকে শুভেচ্ছা ধোনির। গেটি ইমেজেস
সাউদাম্পটনে বুধবার জন্ম হল স্বপ্নের। তৃতীয় বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।
যে ভাবে যশপ্রীত বুমরা শুরুতে ধাক্কা দিল, যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দুই স্পিনার প্রতিপক্ষকে চুরমার করল, সামান্য চাপ তৈরি হওয়ার পরেও রোহিত শর্মা যে রকম দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে দলের জয় নিশ্চিত করল, তাতে স্বপ্ন দেখাই যেতে পারে।
তবু মাথায় রাখতে হবে, বিরাট এ দিন রান পায়নি। মনে রাখতে হবে, ধোনিকে ওর স্বভাবসিদ্ধ মেজাজে দেখা যায়নি। লক্ষ্য খুব বড় ছিল না বলে ধোনিকে ঝুঁকি নিয়ে বেশি আগ্রাসী হতে হয়নি। যত সময় যাবে, তত ওরাও আসরে নামবে। তত ওদের স্বাভাবিক খেলা খুলবে। প্রথম ম্যাচের পরেই ভারত যদি ফেভারিটের তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসে, মোটেও অবাক হব না। আমি এমন ভারতীয় দল খুব কমই দেখেছি, যাদের ব্যাটিং যেমন দুর্দান্ত, তেমনই দুর্ধর্ষ বোলিং। তার সঙ্গে ফিল্ডিংয়েও আমাদের দল এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা।
মনে পড়ে যাচ্ছে ওয়ান ডে ক্রিকেটের একেবারে শুরুর দিকের কথা। তখন সকলে বলেছিল, স্পিনাররা এ বার ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন সেই বিজ্ঞগুলো কী বলবে? আমি তখনই বলেছিলাম, স্পিন এমনই একটা শিল্প, যত দিন ক্রিকেট থাকবে তত দিন সেটা থাকবে, কেউ মেরে ওড়াতে পারবে না। এখনও যদি বিজ্ঞগুলো হিসেব মেলায়, তা হলে দেখবে, সীমিত ওভারে ক্রিকেটে স্পিনারদের চেয়ে ফাস্ট বোলাররাই বেশি ছক্কা খায়।
রোহিত শর্মা সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানেন?
সাউদাম্পটনে বুধবার তো সেটাই আবার দেখে নেওয়া গেল। দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে প্রথমার্ধেই ভারতীয় দল চেপে ধরতে পেরেছিল, তার কারণ দুই স্পিনার। লেগস্পিনার চহাল নিল চারটি উইকেট, চায়নাম্যান কুলদীপ একটি। কিন্তু উইকেট সংখ্যাটাই শুধু দেখলে হবে না, প্রভাবের দিকটাও বোঝা দরকার। জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যে রকম অবস্থা হয়, কুলদীপ আর চহালের সামনে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানেরা সে রকম ধড়ফড় করছিল। বিশেষ করে ওদের অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি যখন কুলদীপকে খেলছিল, দেখে মনে হচ্ছিল, চায়নাম্যান বোলিংটা সম্পূর্ণ ওর সিলেবাসের বাইরে।
তবে আর এক জনের কথাও না বললে অন্যায় হবে। যশপ্রীত বুমরা। অসাধারণ বল করছে। বিশ্বের সেরা পেসার বললেও বোধ হয় বাড়াবাড়ি হবে না। বুধবারও দুই ওপেনারকে ফিরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে শুরুতে ধাক্কা দিল ও-ই। বুমরার বিরল বোলিং অ্যাকশন ব্যাটসম্যানদের মনে বিভ্রান্তি তো তৈরি করছেই, তার উপরে ওর অস্ত্র হচ্ছে পিচ্ছিল গতি। মানে, বল ক্রিজে পড়ে খুব দ্রুত পিছলে শরীরের দিকে চলে আসে। আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, ক্রিজের কোণকে দারুণ ভাবে ব্যবহার করতে পারে বুমরা।
তবু বলব, মাঝ বরাবর আক্রমণাত্মক বোলিং করে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিংকে দুমড়ে দিল দুই স্পিনারই। আমার তো মনে হচ্ছে, ভারতীয় স্পিনাররাই দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারে। কুলদীপ আর চহালের সব চেয়ে বড় গুণ, সীমিত ওভারের ক্রিকেট হলেও ফ্লাইট করাতে ভয় পায় না। এই আক্রমণাত্মক মনোভাবই ওদের সাফল্যের প্রধান কারণ। ওয়ান ডে ক্রিকেটে মাঝের দিকে উইকেট তুলতে পারবে যে দল, তাদের জেতার সম্ভাবনা বেশি। কুল-চা জুটি এই জায়গাতেই এগিয়ে দিতে পারে ভারতকে। গত দু’বছরে এই দুই রিস্টস্পিনার (কব্জির ব্যবহারে যারা স্পিন করে) আসার পরে মাঝের দিকে ভারতের উইকেট নেওয়ার হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে লেংথের ব্যাপারে অভ্রান্ত নিশানা রাখতে পারা। স্পিনারদের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘লেংথ ইজ ম্যান্ডেটরি, লাইন ইজ অপশনাল’। অর্থাৎ, লাইন নিয়ে তবু ভুলচুক করলে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, লেংথ অভ্রান্ত হতেই হবে।
ভাল স্পিনারের এই প্রধান শর্ত মেনেই বুধবার বল করতে দেখলাম দুই ভারতীয় স্পিনারকে। দু’জনের কুড়ি ওভারে গুডলেংথ বলের শতকরা হার আশি শতাংশ। খাটো লেংথের বল প্রায় করেইনি। তার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানেরাও কাট মেরে রান তোলার সুযোগ পায়নি। মার খাওয়ার ভয় ত্যাগ করে স্পিনাররা গুডলেংথে বেশি বল করলে দু’টো ব্যাপার হয়। এক) উইকেট তোলার সম্ভাবনা থাকে বেশি, দুই) ব্যাটসম্যানের উপরেও মানসিক চাপ তৈরি হয় যে, স্পিনারকে মারতে যাব কী করে, এ তো উল্টে আমাকেই আক্রমণ করছে!
কুলদীপের বলের গতিটা চায়নাম্যান বোলিংয়ের জন্য আদর্শ। এই গুণটা ওকে অনেক সাফল্য এনে দিতে পারে। এমনিতেই চায়নাম্যান বোলার খুব বেশি নেই ক্রিকেটে। দক্ষিণ আফ্রিকার পল অ্যাডামস ছিল। এখন শামসি আছে। তবে কুলদীপের মতো বৈচিত্র বা ধার কোনওটাই বাকিদের মধ্যে নেই। চহাল আবার খুব বুদ্ধিমান বোলার। শিকারির মতো সজাগ। ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা বুঝে নিয়ে আক্রমণ শানায়। ওকে খুব চিন্তাশীল বোলার মনে হয়েছে আমার। এবং, দু’জনেরই রয়েছে নির্ভীক হৃদয়। মার খেলেও ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় না। তার পরেও ফ্লাইট করাতে ভয় পায় না। স্পিনার হতে গেলে যেটা সবার আগে দরকার।
পাশাপাশি, এটাও বলব, ডুপ্লেসিদের এই স্পিন-দুর্বলতা আমাকে বেশ অবাক করেছে। আইপিএলে এত দিন ধরে পড়ে থেকে সকলে তো ভারতীয় স্পিনারদের সঙ্গেই ট্রেনিং করল। নেটে এত ব্যাট করল ওদের বিরুদ্ধে। তা থেকে ওরা কি কিছুই শিখল না? ভারতীয় স্পিনারদের সামনে লেজেগোবরে হয়ে ৫০ ওভারে মাত্র ২২৭ রান তোলা দেখে আমার মনে এই প্রশ্নটা জাগছে। ভারত ব্যাট করার সময় বোঝা গিয়েছে, পিচটা রান তোলার পক্ষে সহজ ছিল না। তা বলে অতটা কম্পিতই বা দেখাবে কেন?
আমার মনে হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম দুই ম্যাচ হারার পরে একেবারে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। না-হলে মেঘলা আবহাওয়ায় টস জিতেও কেন ডুপ্লেসি ব্যাটিং নেবে? ওর হাতে রাবাডার মতো পেসার আছে। তাকেই তো এগিয়ে দেবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দিকে! তবে যতই দক্ষিণ আফ্রিকার ভুলের কথা বলি না কেন, ভারত অনেক যোগ্য দল হিসেবে বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছে।
হ্যাঁ, স্বপ্ন তো দেখা যেতেই পারে!