সমব্যথী: কিরিয়সকে সান্ত্বনা জোকোভিচের। রবিবার।
কী আসাধারণ একটা ম্যাচের সাক্ষী থাকলাম! এমনিতেই টেনিস বিশ্বে উইম্বলডনের একটা আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। তার উপরে ফাইনাল হলে তো কথাই নেই। গোটা টেনিস দুনিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। স্কোর বলছে চার সেটে নোভাক জোকোভিচ হারিয়ে দিয়েছে নিক কিরিয়সকে। যার বিশ্ব র্যাঙ্কিং ৪০। ফল ৪-৬, ৬-৩, ৬-৪, ৭-৬ (৭-৩)। কিন্তু স্কোর দেখে বোঝা যাবে না, কী দুরন্ত লড়াইটাই না করেছে কিরিয়স। গোটা ম্যাচে ৩০টা এস মেরেও হেরে গেল ও। তার প্রধান কারণ নিখুঁত জোকোভিচ।
ম্যাচটার আগে কেউ কেউ বলছিলেন, কিরিয়স ধাঁধার সমাধান করতে পারবে না জোকোভিচ। যেমন এর আগে দুবার মুখোমুখি হয়েও পারেনি। দু’বারই আত্মসমর্পণ করেছিল অস্ট্রেলিয়ার ছেলেটার সার্ভের সামনে। প্রায় ১২৫ মাইল বেগে ওর সার্ভগুলো যখন উড়ে আসে, তখন যে কোনও প্রতিপক্ষেরই ঘুম উড়ে যায়। জোকোভিচেরও গিয়েছিল গত দু’বার।
কিন্তু রবিবার সেন্টার কোর্টে জোকোভিচ দেখিয়ে দিল, ঠিক সময়ে সব সমস্যার সমাধান ও করতে পারে। কিরিয়স ধাঁধারও সমাধানও করে দেখাল। কী ভাবে? ডিফেন্সিভ অ্যাটাক বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেই কৌশলই নিয়েছিল নোভাক। ও জানত কিরিয়সের সার্ভিস রোখার উপায় খুঁজে পেতে হবে প্রথমে, তার পরে আক্রমণে যেতে হবে। সেটাই করেছে।
তবে প্রথম সেট থেকেই কিন্তু বেশি চাপে মনে হচ্ছিল জোকোভিচকেই। প্রথম সার্ভেই ডাবল ফল্ট করে বসে। কিরিয়স কিন্তু মেজাজেই ছিল। দুম করে আন্ডারআর্ম সার্ভ বা টুইনার মেরে বসতে দেখলাম। যেটা ওর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। তবে কিরিয়সের সার্ভের কোনও হদিশই পাচ্ছিল না এই সময় জোকোভিচ। এ ভাবেই পঞ্চম গেমে কিরিয়স দুটো ব্রেক পয়েন্ট পায় জোকোভিচের সার্ভে চাপ বাড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত ওই গেমে জোকোভিচের সার্ভ ভেঙে ৩-২ এগিয়ে যায় এবং দেখতে দেখতে সেটটাওদখল করে ফেলে।
তবে প্রথম সেটে হেরেও জোকোভিচ কিন্তু মাথা গরম করেনি। অনেকের হয়তো তখন গত বছরের উইম্বলডন ফাইনালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মাত্তেয়ো বেরেত্তিনির বিরুদ্ধে প্রথম সেটে কিন্তু হেরেই জোকোভিচ পরের তিন সেটে জিতেছিল। জোকোভিচ এ বারও কৌশল নেয় যে করে হোক, কিরিয়সের সার্ভ প্রথমে ফিরিয়ে দিতে হবে। তার পরে ওকে র্যালিতে যেতে বাধ্য করতে হবে। এই পরিকল্পনাটা ম্যাজিকের মতো কাজে আসে। তৃতীয় গেমে ৩০-৩০ পয়েন্ট থাকার সময় পরপর দুটো পয়েন্ট পায় জোকোভিচ। ২-১ করে ফেলে ও যেন আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পায়। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। এমনি এমনি তো আর ওকে টেনিস সার্কিটের সেরা রিটার্নার বলা হয় না! র্যালিতে যেতে গিয়েই ভুল করে বসে কিরিয়স। আনফোর্সড এররের সংখ্যাও বেড়ে যায় ওর। ঠিক এই সুযোগে কিরিয়সের সার্ভিস ভেঙে দেয় নোভাক এবং ৩-১ গেমে এগিয়ে যায়। নবম গেমে পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে কিরিয়স। মোট চারটে ব্রেক পেয়েছিল কিরিয়স। তবু জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙতে পারেনি। উল্টে জোকোভিচ ৬-৩ সেট জিতে সমতা ফেরায়। সেন্টার কোর্টের দর্শকরা সমানে সমানে টক্কর দেখে তখন উত্তেজনায় ফুটছে।
তৃতীয় সেটের মাঝামাঝি কিরিয়সের মনঃসংযোগ নষ্ট হয়। ওর সার্ভ করার সময় দর্শকাসন থেকে কেউ কথা বলে ওঠে। তাতেই ক্ষুব্ধ কিরিয়স চেয়ার আম্পায়ারকে অভিযোগ জানাতে থাকে। এত বড় মঞ্চে সফল হতে গেলে নিখুঁত টেনিস, পরিকল্পনার পাশাপাশি অটুট মনোযোগেরও প্রয়োজন। না হলে বিপক্ষ সেই সুযোগে এগিয়ে যেতে পারে। ঠিক সেটাই হয়। নবম গেমে কিরিয়সের সার্ভিস ভেঙে এগিয়ে যায় নোভাক এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তৃতীয় সেট দখল করে ফেলে। চতুর্থ সেট কিরিয়স টাইব্রেকে নিয়ে যেতে পারলেও লাভ হয়নি। টাইব্রেকে প্রথমেই ডাবল ফল্ট করে বসে কিরিয়স। জোকোভিচ এমনিতেই নিখুঁত খেলছিল, এই সুযোগ আর হাতছাড়া করেনি। পরপর পয়েন্ট তুলে নিয়ে ৬-১ এগিয়ে যায়। কিরিয়স এর পরে দুটো পয়েন্ট পেলেও জোকোভিচের টানা চার বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া রুখতে পারেনি। এর মধ্যে অবশ্য ২০২০ সালে করোনার জন্য উইম্বলডন আয়োজিত হয়নি।
২১নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম আর সাত নম্বর উইম্বলডন জিতে কিংবদন্তি পিট সাম্প্রাসকেও ছুঁয়ে ফেলল নোভাক। ওর সামনে এখন শুধু রাফায়েল নাদালের ২২ গ্র্যান্ড স্ল্যামের রেকর্ড। করোনা টিকা না নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে খেলতে পারবে কি না জানি না। অস্ট্রেলীয় ওপেনেও ওর নামা অনিশ্চিত। যদি পারত, ২২ নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ও হয়তো চলে আসত এর মধ্যে। কিন্তু ওকে আবার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পরের মরসুমে ফরাসি ওপেন আর উইম্বলডনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সে যাই হোক, টেনিসের ইতিহাসে জোকোভিচ অনন্য এক চরিত্র হিসেবে থেকে যাবে। যে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে গ্র্যান্ড স্ল্যামে না নামতে দিলেও পরোয়া করে না। যে কোর্টের মধ্যে যে রকম নিষ্ঠুর, কোর্টের বাইরে ততটাই আবেগপ্রবণ। যে শত্রুতা ভুলে বিপক্ষকে ম্যাচের আগেই কাছে টেনে নিতে পারে। বিজয়ীর ট্রফি নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে দর্শকদের। যত দিন টেনিস থাকবে, তত দিন জোকোভিচের নামও সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে টেনিসপ্রেমীদের হৃদয়ে।