ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সমৃদ্ধ তখনকার ফুটবল মাঠ যতটা উত্তাল ছিল, ততটাই রোমাঞ্চকর ছিল ফুটবলারদের দলবদল। ফুটবলারদের তুলে নিয়ে নজরবন্দি করে রাখা হত। তখন বাকি ফুটবলাররা পাশে দাঁড়াতেন সেই পরিবারের মতোই।
ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইঙ্গারের নিজের খেলা নিয়ে অহমিকা ছিল না। অহঙ্কার ছিল চরিত্র নিয়ে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
গত ২৩ জানুয়ারি ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রয়াত প্রাক্তন ফুটবলার শান্ত মিত্রের স্ত্রী নিয়তির ফোন। বললেন, ‘‘সুভাষও (সুভাষ ভৌমিক) চলে গেল! কত স্মৃতি। শুক্লার (সুভাষের স্ত্রী) নম্বরটা দিও। কথা বলব। সুরজিৎ কেমন আছে?’’ যখন শুনলেন, ভাল আছেন, স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।
ঘটনাচক্রে, তার ঠিক পর দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। এবং ‘কত স্মৃতি’-র অন্যতম অংশীদার সুরজিৎও সেই চলে গেলেন স্মৃতির দেশে। সত্তর দশকে বাংলার উত্তাল ফুটবল ময়দান এমনই ছিল। সুভাষ ভৌমিক-শ্যাম থাপা-শান্ত মিত্র-সুরজিৎ সেনগুপ্ত-সৈয়দ নঈমুদ্দিন— একটা একাত্মতা ছিল এঁদের মধ্যে। সেই পরিবার আরও ভেঙে গেল সুরজিতের প্রয়াণে।
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সমৃদ্ধ তখনকার ফুটবল মাঠ যতটা উত্তাল ছিল, ততটাই রোমাঞ্চকর ছিল ফুটবলারদের দলবদল। ফুটবলারদের তুলে নিয়ে নজরবন্দি করে রাখা হত। তখন বাকি ফুটবলাররা পাশে দাঁড়াতেন সেই পরিবারের মতোই।
১৯৭৮ সালে সুরজিৎ যখন ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক, তখন পরের বছর সইয়ের ঠিক আগে গোটা দলকে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন। যাতে কোনও ফুটবলারকে বিপক্ষ দল তুলে নিতে না পারে, তাই তাঁর বাড়ি থেকেই সকলে মিলে সই করতে গিয়েছিলেন আইএফএ দফতরে। সত্তরের বাংলা ফুটবল পরিবারে এরকমই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সুরজিতের।
মনে করতেন, ‘মগজাস্ত্র’ প্রয়োগ করে খেলার মধ্যে অন্য তৃপ্তি আছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইঙ্গারের নিজের খেলা নিয়ে কোনও অহমিকা ছিল না। অহঙ্কার ছিল, নিজের চরিত্র নিয়ে। দাবি করতেন, ‘‘আমার চরিত্রটা খুব প্লেজেন্ট।’’ সতীর্থদের আপন করে নেওয়া সেই স্বভাবের জন্যই সুরজিৎ অনায়াসে সেই ফুটবল পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছিলেন, যা অটুট ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। সন্তোষ ট্রফিতে যখন বাংলা দলের অধিনায়ক হলেন, তখন সবাইকে সামলাবেন কী করে জানতে গিয়েছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। পিকে-র জবাব ছিল, ‘‘তুমি যে ধরনের মানুষ, তাতে কোনও সমস্যা হবে না।’’ হয়ওনি।
ময়দানে সুরজিৎ হাতে গোনা কয়েক জন ফুটবলারের মধ্যে পড়েন, যাঁরা অজাতশত্রু। নিজে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, যখন অবসর নিয়েছিলেন, তার থেকে আরও বেশ কয়েক বছর তিনি খেলতে পারতেন। অবশ্যই পারতেন। কিন্তু কর্তাদের সঙ্গে মতের অমিল হচ্ছে দেখে তিনি সময় নষ্ট না করে বুটজোড়া তুলে রেখেছিলেন। বিবাদ-বিতর্ক থেকে এতটাই দূরে থাকতে চাইতেন সুরজিৎ।
বিতর্ক যে হয়নি, তা নয়। সেটিও সেই উত্তাল দলবদল ঘিরে। সুরজিৎকে অনশনে বসতে হয়েছিল। তাঁর বাবা চুঁচুড়া থানায় গিয়ে শৈলেন মান্নার বিরুদ্ধে এফআইআর করে এসেছিলেন। ১৯৭৪ সালে মোহনবাগান ছেড়ে সুরজিতের ইস্টবেঙ্গলে খেলা পাকা। সেই সময় মোহনবাগানের কোনও কর্তা তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন না। তাঁকে রাখা হবে কি না, সে ব্যাপারে ঘোর অনিশ্চয়তায় ছিলেন সুরজিৎ। ফলে ইস্টবেঙ্গলকে এক রকম পাকা কথা দিয়েই ফেলেছিলেন। শুধু বলেছিলেন, বছরের শেষ প্রতিযোগিতা রোভার্স কাপটা তিনি মোহনবাগানের হয়েই খেলবেন। মুম্বই থেকে ফিরে এসে লাল-হলুদে সই করবেন।
ময়দানে সুরজিৎ হাতে গোনা কয়েক জন ফুটবলারের মধ্যে পড়েন, যাঁরা অজাতশত্রু। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
মোহনবাগান যখন রোভার্স খেলতে যাচ্ছে, তখন শৈলেন মান্না হঠাৎ বলেন, ‘‘তোকে খেলতে যেতে হবে না। আমাদের হয়ে সইটা করে নে।’’ মান্না ভাল করে জানতেন, সুরজিৎকে নিয়ে জীবন-পল্টুর (ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন দুই কর্তা জীবন চক্রবর্তী-পল্টু দাস) সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে শুধু কথায় কাজ হবে না। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে সুরজিতের মালপত্র নামিয়ে মান্নার গাড়িতে তুলে তাঁকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল ডায়মন্ড হারবারের একটি হোটেলে।
সেই থেকেই গৃহবন্দি এবং প্রতিবাদী সুরজিতের শুরু হল অনশন। ইতিমধ্যে ইস্টবেঙ্গল কর্তারা তাঁর বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে বলে এসেছেন, মোহনবাগান কর্তারা সুরজিতের উপর কী অত্যাচারটাই না করছে! লাল-হলুদ কর্তাদের পরামর্শেই থানায় মান্নার নামে ডায়েরি করে এসেছিলেন সুরজিতের বাবা। লড়াইয়ে টেকা সম্ভব নয় বুঝে মোহনবাগান শেষ পর্যন্ত সুরজিৎকে ছেড়ে দিয়েছিল। তবে সেই গল্প বলতে গিয়ে মোহন-কর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করতেন সুরজিৎ, ‘‘ওরা কিন্তু গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। মান্না’দা শুধু ছেড়ে দেওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘আমার নামে চুঁচুড়া থানায় একটা এফআইআর হয়েছে। ওটা তুলে নিয়ে বাড়ি ঢুকিস’।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তার পর আর ইস্টবেঙ্গল তাঁকে ছাড়েনি। সেই বছর রোভার্সটাও লাল-হলুদ জার্সিতেই খেলেছিলেন। পরের ছয় বছর দাপটে খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৭৮ সালে সুরজিৎকে অধিনায়ক করে ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গলে গিয়েই কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন পিকে-কে। আর পিকে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন ফুটবলার সুরজিতের। মুম্বই থেকে স্ত্রী আরতিকে চিঠি লিখেছিলেন পিকে। প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত চিঠির বিষয় ছিল ‘সুরজিৎ’। তাঁর ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়া ঠেকাতে শেষ বারের মতো একটা চেষ্টা করেছিল মোহনবাগান। সবুজ-মেরুনের কয়েক জন দ্বিতীয় সারির কর্তা সরাসরি পিকে-কে গিয়ে সুরজিতের নামে কটূক্তি করেছিলেন। পিকে সে সব শুনে শুধু বলেছিলেন, ‘‘সত্যিই ভাবছিলাম, ছেলেটাকে নেব কি না। কিন্তু তোমরা যা বললে, তাতে এই ছেলেকে তো নিতেই হবে। সত্যিই যদি এমন হয়, তবে তো ময়দানে একেবারে মানানসই।’’
কী বলেছিলেন মোহন-কর্তারা পিকে-কে, তা কোনওদিন প্রকাশ্যে আসেনি। ‘খারাপ’ সুরজিৎকে পাওয়া গিয়েছিল এক বারই। সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে গোল করে বার ধরে ঝুলে পড়া। ব্যাস ওটুকুই। ‘খারাপ’ সুরজিৎকে পাওয়া এতটাই দুর্লভ ছিল যে, পরের দিনের সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল সেই ছবি। বহুচর্চিত হয়েছিলেন ‘নতুন চোহারার’ সুরজিৎ।
কাছাকাছি সময়ে ময়দানে আসা দুই তারকা। চলে যাওয়াও কাছাকাছি সময়ে। দুই প্রধানের মুখ হয়ে প্রবীণ বয়সে সুরজিৎ সেনগুপ্ত এবং সুভাষ ভৌমিক। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সেই উচ্ছ্বাস অবশ্য শুধু-শুধু হয়নি। পিকে তখন রেলের কোচ। সুরজিতের বাংলার কোচ অরুণ ঘোষ। ফাইনালের ঠিক আগে হঠাৎ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এসে সুরজিৎকে বলেন, ‘‘দাদা খুঁজছে।’’ সুরজিৎ ফোন করেন। পরের দশ মিনিট ও পার থেকে শুধু গালি আর চিৎকার। পঞ্জাব সে বার খুব ভাল খেলছিল। ফাইনালে বাংলার প্রতিপক্ষ ছিল পঞ্জাবই। রেলের কোচ হয়েও বাংলাতেই হয়ত মন পড়েছিল পিকে-র। সুরজিৎকে বলেছিলেন, ‘‘খবরের কাগজ খুললেই শুধু তোমাদের সমালোচনা পড়ছি! এত খারাপ খেলছ কেন তোমরা? শেষ পর্যন্ত পঞ্জাবের কাছে কি বাংলাকে ফুটবল শিখতে হবে?’’ সুরজিৎ তাঁর গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কী করতে হবে?’’ এক শব্দের জবাব এসেছিল, ‘‘দৌ়ড়ও।’’
পর দিন বাংলা ৩-১ ব্যবধানে জিতেছিল। শেষ গোলটি এসেছিল সুরজিতের পা থেকে। গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বল পেয়ে উইং দিয়ে দৌড় শুরু করেছিলেন সুরজিৎ। চারটে পাস খেলে গোল। পঞ্জাবের ফুটবলাররা বল ধরতে পারেননি। ওই গোলের পরেই বার ধরে ঝুলে পড়েছিলেন ‘উচ্ছ্বসিত’ সুরজিৎ।
উইঙ্গার বলে একটা বাড়তি গর্ব ছিল। মনে করতেন, এক জন উইঙ্গারকে মাঠের এক দিক দেখে খেলতে হয়। তার কাছে আর একটা দিক বলে কিছু নেই। কারণ, সে দিকে সাইড লাইন। ওই খেলাটা খেলতে মগজ লাগে। আলাদা অনুশীলন দরকার হয়। ‘মগজাস্ত্র’ প্রয়োগ করে খেলার মধ্যে অন্য তৃপ্তি আছে।
বুদ্ধিদীপ্ত উইঙ্গার সুরজিৎকে পাওয়া গিয়েছিল মারডেকা কাপে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে। মালয়েশিয়ার গোটা মাঝমাঠ এবং রক্ষণ সুরজিৎকে সামলাতে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল। আলাদা করে ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল তাঁকে। ফলস্বরূপ কান ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল সুরজিতের।
১৯৭৮ সালে ইস্টবেঙ্গেলের অধিনায়ক ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত, মোহনবাগানের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
যে গোলের পরে বার ধরে ঝুলেছিলেন, আইএফএ শিল্ডে দক্ষিণ কোরিয়া একাদশের বিরুদ্ধে করা গোল অবশ্য তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় জাতীয় দলটাই সে বার শিল্ডে খেলতে এসেছিল। কর্নার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে গোল করেছিলেন সুরজিৎ। সবাই ভেবেছিলেন, সুরজিতের সেন্টার বক্সে ভেসে আসবে। হেড দেওয়ার জন্য সাব্বির আলি অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সুরজিতের বাঁক নেওয়া শট গোলে ঢুকে যায়। সেই গোলের পিছনেও একটি গল্প আছে। ম্যাচের আগের দিন প্রশাসনিক কিছু একটা ঝামেলায় ইস্টবেঙ্গলের অনুশীলন হয়নি। সুরজিৎ চলে গিয়েছিলেন অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অনুশীলন করতে। সেখানেই প্রিয় শিষ্যকে ওই রকম ১০০টি শট অনুশীলন করিয়েছিলেন অচ্যুৎ।
সারা জীবনে বোধ হয় ধমকেছিলেন এক জনকেই। তিনি অশ্বিনী বরাট। সুরজিতের ভোলাদা। হুগলির মানুষ সুরজিতের ফুটবলে পায়েখড়ি অশ্বিনীর কাছে। কোচ বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন না অশ্বিনী। তখন ব্যান্ডেলের মাঠে সিনিয়রদের অনুশীলন হয়ে যাওয়ার পরে সুযোগ পেতেন সুরজিৎরা। অশ্বিনী নিজের অনুশীলনের পর সুরজিৎদের একটু খেলা দেখিয়ে দিতেন। নানা পরামর্শ দিতেন। অশ্বিনীই সুরজিতের বাঁ পা-কে কার্যকরী করে তুলেছিলেন। তাঁর টোটকা ছিল, গোটা অনুশীলনে এক বারও ডান পায়ে বল ধরা যাবে না। ডান পায়ে বল ধরলেই পাঁচ বার কান ধরে ওঠবস। ঘটনা হল, সুরজিৎ জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন লেফ্ট উইঙ্গার হিসেবে। সেই অশ্বিনী যখন হাঁটুর যন্ত্রণায় কাবু হয়েও ডাক্তার দেখাচ্ছিলেন না, সুরজিৎই ধমকে নিয়ে যান। হাঁটু ঠিকও হয়ে যায়।
আসলে অশ্বিনীরাও যে তাঁর সেই পরিবারেরই অংশ। তাই শুধু ফুটবল খেলাই নয়, সুরজিৎদের ‘পরিবার’ হতেও শিখিয়েছিলেন সেই সব মাস্টারমশাইরা। বহু যত্নে গড়ে তোলা যে পরিবারের এক একটি ইট আস্তে আস্তে খসে পড়ছে।