ভারতের অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। ছবি: সংগৃহীত
বুধবার সন্ধেয় ভারত বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ শুরুর অনেক আগে থেকেই বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে একটি লম্বা ব্যানার দেখা যাচ্ছিল। ‘ওয়েস্ট ব্লক ব্লুজ’ নামে পরিচিত সমর্থক দলের সেই ব্যানারে লেখা ছিল, ‘ইমমর্টাল নাম্বার ইলেভেন’। অর্থাৎ, যে ১১ নম্বরে অন্য কাউকে কল্পনাও করা যায় না। ভারতীয় দলে সুনীল ছেত্রী ঠিক তাই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ৭ নম্বর, লিয়োনেল মেসির ১০ নম্বর যেমন ফুটবল বিশ্বে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিয়েছে, তেমনই ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সুনীল ছেত্রীর ১১ নম্বরও। কাকতালীয় ভাবে, তিন জনের বয়সও পিঠোপিঠি।
বুধবার ম্যাচের ৭১ মিনিটে পেনাল্টি থেকে শাকিব হানিফকে বোকা বানিয়ে যখন সুনীল তৃতীয় গোলটি করলেন, কান্তিরাভায় তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। বল জালে জড়িয়েও বর্ষণসিক্ত সুনীলের মুখে একটুও পরিবর্তন হল না। গোল করেই পিছনে হাঁটা দিলেন। কোনও উচ্ছ্বাস নেই। কোনও আবেগ নেই। তাঁর ওই গোলে অন্য কারও কৃতিত্ব ছিল না, তাই সুনীলেরও কোনও উচ্ছ্বাস ছিল না। না হলে অন্যান্য সময় যে ফুটবলার অ্যাসিস্ট করেছেন, তাঁর দিকে আগে ছুটে যান সুনীল।
পাকিস্তানের ম্যাচের আগে একটুও চাপে ছিলেন না তিনি। বলেছেন, “সবার সঙ্গে যখন দেখা হল, তখন প্রত্যেককে বেশ শান্ত দেখলাম। এর আগে দু-এক বার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা হওয়ার সময়েও খুব ভাল লেগেছে। ওরাও পঞ্জাবি বলে, আমরাও বলি। কিন্তু এক বার রেফারির বাঁশি বেজে ম্যাচ শুরু হলে কী হবে জানি না।”
মেসি ৩৬ পূর্ণ করবেন এক দিন পরেই। ৩৮ পেরিয়ে গিয়েছেন রোনাল্ডো। সুনীলেরও ৩৮। প্রথম দু’জনের সাফল্য নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। কিন্তু সুনীলের সাফল্যও কি ফেলে দেওয়ার মতো? বাকি দু’জনের মতো তাঁরও যত বয়স বাড়ছে, ততই খেলা ধারালো হচ্ছে। এই বয়সেও অফুরান প্রাণশক্তি। দেশের হয়ে যেন একটু বেশিই। গোলের জন্যে সব সময় ছটফট করছেন। প্রথম গোলটার ক্ষেত্রেই ধরা যাক।
পাকিস্তানের গোলকিপার হানিফ দু’মিনিট আগেই একটি ভুল করেছিলেন। সুনীল তখনই বুঝে যান বিপক্ষ গোলকিপারের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেই সুযোগে সচেতন ভাবেই হানিফের আত্মবিশ্বাস নড়ানোর চেষ্টা করলেন। সফলও হলেন। পাক গোলকিপারের ভুলে এগিয়ে গেল ভারত। যে দলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম গোল, চতুর্থ হ্যাটট্রিকও এল তাদের বিরুদ্ধেই।
তারও কিছু দিন আগের কথা। ভানুয়াটুর বিরুদ্ধে ম্যাচ। বাঁ দিক থেকে শুভাশিস বসুর ভেসে আসা ক্রস বুক দিয়ে নিখুঁত রিসিভ। বাঁ পায়ের জোরালো শটে গোল। লেবাননের বিরুদ্ধে আন্তর্মহাদেশীয় কাপের ফাইনালে বিরতির পরেই আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলে গোল। এখনকার তরুণ ফুটবলাররা যে কাজ করার আগে ভাববেন, ম্যাচের পর ম্যাচ সেটাই অবলালীয় করে চলেছেন সুনীল। কোনও ক্লান্তি নেই। কোনও বাড়তি আবেগ নেই। দায়িত্বশীল পিতা যে ভাবে তাঁর সন্তান এবং পরিবারের লালনপালন করেন, সুনীলও তেমনই। এই ভারতীয় দলের অভিভাবক।
সুনীলের সঙ্গে যাঁরা খেলা শুরু করেছিলেন, তাঁদের একজন মহেশ গাউলি। এখন ভারতীয় দলের সহকারী কোচ। তার আগে মেহতাব হোসেন, রহিম নবিরা অনেক আগেই অবসর নিয়েছেন। ঠিক যেমন মেসির পাশে খেলা জাভি, আন্দ্রে ইনিয়েস্তারা ফুটবল থেকে দূরে। ঠিক যেমন রোনাল্ডোর পাশে খেলা জাবি আলোন্সো, লুই ফিগোরা ফুটবল থেকে দূরে। মেসি-রোনাল্ডোর যেমন বয়স হয় না, সুনীলেরও বয়স বাড়ছে না।
ভারত অধিনায়কের পাশে মোহনবাগানে খেলেছেন দীপেন্দু বিশ্বাস। এখন তিনি মহমেডানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। কিন্তু সুনীলের গোল করার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ। আনন্দবাজার অনলাইনকে দীপেন্দু বললেন, “সুনীলের গোলসংখ্যাই বোঝাচ্ছে ও কত বড় স্ট্রাইকার। মেসি, রোনাল্ডোর সঙ্গে ওর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, এটা কি কম গর্বের ব্যাপার? সুনীলের শৃঙ্খলা এবং দায়বদ্ধতা মুগ্ধ করার মতো। খাবারদাবারে অনেক বদল এনেছে। অনুশীলনে নিজেকে নিংড়ে দেয়। এই কারণেই ৩৮ বছরেও তরুণ ফুটবলারদের মতো খেলে চলেছে। ও খেলা ছেড়ে দিলেও সারা জীবন মানুষ ওর অবদান মনে রাখবে। আমার মতে, মেসি, রোনাল্ডোর মতোই খুব দ্রুত ১০০ গোল হয়ে যাবে সুনীলের।”
পরিচিত লোকেদের সামনে খেললে সুনীল একটু বাড়তি চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। কান্তিরাভার প্রতিটি ঘাস তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। বহু বছর ধরে বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলছেন। এই মাঠের দর্শক সুনীলকে একটু বেশিই ভালবাসেন। তাই বৃষ্টির মধ্যেও যখন দুই সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়লেন, সুনীলকে একটুও ঘাবড়াতে দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রেও একটি কাকতালীয় ব্যাপার রয়েছে। কিছু দিন আগে মেসি এবং রোনাল্ডো দেশের হয়ে নামার সময়েও মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন দর্শক।
ভারতের মতো দেশের হয়ে ফুটবল খেললে যত টুকু পাওয়া সম্ভব, তার প্রায় সবটাই পেয়েছেন সুনীল। অসংখ্য ট্রফি, ভালবাসা, সেরার তকমা সবই রয়েছে। একটা লক্ষ্য এখনও তাঁর সামনে। তা হল, দেশের জার্সি গায়ে শততম গোল। আর মাত্র ১০টি বাকি। এশিয়ান কাপের আগে ভারত আরও অনেক ম্যাচ খেলবে। তাই ‘সেঞ্চুরি’ না হওয়ার কোনও কারণ নেই। সুনীলের আগে রোনাল্ডো, মেসি-সহ যে তিন জন রয়েছেন, সবারই গোলের ‘সেঞ্চুরি’ রয়েছে। সুনীল সেই দলে নাম লেখাতে পারলে তা শুধু তাঁর নিজের নয়, গর্বিত করবে গোটা দেশকে।