যুযুধান: দুই ভরসা। কৃষ্ণ ও চিমা। ছবি এটিকেএমবি, এসসি ইস্টবেঙ্গল।
আমি সব সময় আমার মতো থাকতেই ভালবাসি। ইইচই থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু মোহনবাগান আর ডার্বির প্রসঙ্গ উঠলেই কেমন জানি বদলে যাই। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা অনুভব করতে শুরু করি। কিছুটা হলে অশান্ত হয়ে পড়ি।
তবে এ বার তুলনামূলক ভাবে শান্ত আছি। মন বলছে, ডার্বিটা আমরাই জিতব। তার উপর শতবর্ষের ডার্বি শনিবার, তাই ঐতিহাসিক ম্যাচ তো জিততেই হবে। শুধু একটাই খচখচানি হচ্ছে। ম্যাচটা হচ্ছে গোয়ায়। আহা, শতবর্ষের ডার্বিটা যদি কলকাতায় হত! কোভিডের এই কঠিন পরিস্থিতিতে দূরত্ববিধি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে খেলা দেখতে যেতে পারতেন ফুটবলপ্রেমীরা।
ঘটি পরিবারে আমার জন্ম। বাড়ির প্রায় সকলেই মোহনবাগানের সমর্থক। আমার মাসতুতো দাদার প্রভাবে নিজের অজান্তেই মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে উঠেছিলাম। সেই সময় খুব ভাল লাগত চিমা ওকোরির খেলা। ও রকম শক্তিশালী স্ট্রাইকার ময়দানে খুব কমই এসেছে। প্রতিপক্ষকে যেন বুলডোজ় করে বেরিয়ে যেত চিমা। আর কে ভুলতে পারবে ময়দানে সেই ‘চিমা-চিমা’ বিখ্যাত ধ্বনি। কলকাতার ফুটবল ইতিহাসে বিদেশি স্ট্রাইকারদের মধ্যে মজিদ বাসকার আর চিমা ওকোরি সম্ভবত সব চেয়ে জনপ্রিয় দুই তারকা।
সেভাবে দেখতে গেলে এখনকার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে অনেক বেশি বিদেশিদের প্রভাব। কোচেরাও বিদেশি। কিন্তু আগের মতো বিদেশি তারকা আর কোথায় পাই আমরা? মজিদ, জামশিদ, চিমা, এমেকাদের নিয়ে মানুষের উন্মাদনা ছিল যেন ফিল্মি তারকাদের মতো। ছোটবেলায় তাঁদের নিয়ে মাতামাতি কিছুটা স্বচক্ষে দেখেছি, বাকিটা পরিবারের লোকেদের মুখে গল্প শুনেছি। এখন যেমন ক্রিকেটারদের নিয়ে হইচই হয়, তখন দুই প্রধানের ফুটবলারদের নিয়ে তেমনই হত।
এ বারে শুনছি, আমাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব নাকি নতুন এক চিমাকে নিয়ে এসেছে। ওদের বলে দিতে চাই, চিমা এক জনই হয়। এক জনই এসেছিল। নতুন চিমাকে নিয়ে তোমাদের বিশেষ স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। নামে মিল থাকা মানেই তো খেলায় মিল নয়। শনিবারের ডার্বিতেই সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। আর আমাদের কোচ আন্তোনিয়ো লোপেস হাবাস হচ্ছেন রক্ষণ মজবুত করার মাস্টার। কী করে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভোঁতা করতে হয়, এই স্পেনীয় কোচের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। তাই নতুন চিমাকে নিয়ে বিনিদ্র রজনী কাটানোর কোনও কারণ একেবারেই দেখছি না।
আমাদের সবুজ-মেরুন দলটা এ বার আরও বেশি শক্তিশালী। রয় কৃষ্ণ, ডেভিড উইলিয়ামসের সঙ্গে রয়েছে হুগো বুমোসের মতো শিল্পী ফুটবলার। প্রিয় দলে আমার প্রিয় ফুটবলার অবশ্য কৃষ্ণ-ই। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলার। শারীরিক ভাবেও দারুণ শক্তিশালী। ওর কাছে আমার একটাই আব্দার, ডার্বি জেতাও কৃষ্ণ, একটা গান লিখব তোমার জন্য।
ডার্বির প্রসঙ্গ উঠলেই মনে ফিরে আসে অনেক স্মৃতি। ঠাকুরপুকুরে আমি বড় হয়েছি। আমাদের পাড়ায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই ক্লাবেরই সমর্থক ছিল। তাই ম্যাচের কয়েক দিন আগে থেকে আবহ সম্পূর্ণ বদলে যেত। বিকেলে ফুটবল খেলার সময় আমাদের মধ্যে পরিষ্কার দু’টি ভাগ হয়ে যেত। এক দিকে আমরা। অন্য দিকে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। ডার্বির আগের কয়েকটা দিন আমাদের পাড়াতেও ডার্বি হত! তাতে কেউ নিজেকে মনে করতাম চিমা, কেউ সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কেউ কৃশানু দে, কেউ বিকাশ পাজি। আমি পড়ে যেতাম মহা সমস্যায়। মোহনবাগান আমার হৃদয়ে। কিন্তু প্রিয় ফুটবলারদের মধ্যে ছিল কৃশানু-বিকাশ। ওরা তখন ইস্টবেঙ্গলে খেলত। মনের সঙ্গে আপস করতে হত যে, ওরা দু’জন ভাল খেলুক কিন্তু ম্যাচটা যেন
আমরা জিতি।
এখন ঘরে বসেই বিশ্বের সব প্রথম সারির লিগ দেখা যায়। ইপিএলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে প্র্ত্যাবর্তন, পেপ গুয়ার্দিওলার সম্মোহনী পাসিং ফুটবল, লা লিগায় বার্সেলোনার কোচ হয়ে জ়াভির আসা, ফরাসি লিগে মেসি, নেমার, এমবাপে ত্রিফলা, বুন্দেশলিগায় লেয়নডস্কি, মুলারদের দাপট— সব এসে যায় রিমোটে আঙুলের ছোঁয়ায়। আমাদের সময়ে এতটা টিভির প্রভাব ছিল না। আমাদের ইপিএল, লা লিগা, বুন্দেশলিগা সবই ছিল কলকাতার দুই প্রধানের ডার্বি। এখনও সেই অনুভূতিতে তারতম্য হয়নি।
আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি মোহনবাগানকে নিয়ে গান লেখার সুযোগ পাওয়া। তার পরে প্রিয় ক্লাবের মাঠেই হাজার হাজার সবুজ-মেরুন সমর্থকদের সামনে গেয়েছিলাম— ‘জিতে নিতে চাই সব খেতাব...আমাদের রক্তে মোহনবাগান, আমাদের তর্কে মোহনবাগান, আমাদের স্বপ্নে মোহনবাগান, আমাদের শর্তে মোহনবাগান!’
শনিবারের ঐতিহাসিক ডার্বিতে রয় কৃষ্ণদের নৈপুণ্য দেখব আর এই সবুজ-মেরুন মন গাইতে থাকবে ওই লাইনগুলোই!