মগ্ন: সুনীলের অনুশীলনে নজর ইগরের। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
কলকাতা মানেই শুধু ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা নয়। রসগোল্লা, মিষ্টি দইও রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় ফুটবল দলের অন্দরমহলে এই মুহূর্তে মিষ্টির প্রবেশ সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ!
প্রাতরাশ থেকে নৈশভোজ— বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে কুয়েতের বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন ম্যাচের আগে সুনীল ছেত্রীদের টেবলে শর্করাজাতীয় খাদ্য সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। ফিটনেস ধরে রাখতে খেতে হবে অল্প তেলে রান্না করা খাবার, কিনোয়া (এক ধরনের ফুলগাছের বীজ), ফল, সবজি ও প্রচুর পরিমাণে জল।
ফিফা ক্রমতালিকায় ভারত ১২১তম স্থানে। কুয়েত রয়েছে ১৩৯ নম্বরে। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে গত বছরের ১৬ নভেম্বর কুয়তকে তাদের দেশের মটিতে ১-০ হারিয়েছিল ভারত। ৬ জুন যুবভারতীতে দ্বিতীয় পর্বের সাক্ষাতের আগে ফুটবলারদের ফিটনেস নিয়ে এত চিন্তিত কেন ইগর স্তিমাচ? ভারতীয় দলের অন্দরমহলে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, ফিফা ক্রমতালিকায় কুয়েতের অবস্থান নিয়ে ভাবছেনই না কোচ। তাঁর প্রধান চিন্তা বিপক্ষের শারীরিক ফুটবল। গুয়াহাটিতে আগের ম্যাচে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের ফুটবলাররা শারীরিক শক্তির লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। ৬ জুন যুবভারতীতে কুয়েতের বিরুদ্ধে তার পুনরাবৃত্তি চান না ইগর। এই কারণেই শর্করাজাতীয় খাবারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। বাইপাসের ধারে যে পাঁচতারা হোটেলে রয়েছেন সুনীলরা, কলকাতায় পা দেওয়ার আগেই সেখানকার শেফদের হাতে খাদ্যের তালিকা তুলে
দিয়েছেন তিনি।
ফিটনেস নিয়ে একা ইগর নন, অধিনায়ক সুনীলও প্রচণ্ড সতর্ক। বৃহস্পতিবার থেকে নিউ টাউনে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের উৎকর্ষ কেন্দ্রে কুয়েত ম্যাচের প্রস্তুতি শুরু করল ভারতীয় দল। সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে অনুশীলন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় দল পৌঁছয় প্রায় আধ ঘণ্টা দেরিতে। সুনীলকে দেখতে মাঠের বাইরে তখন প্রায় পঞ্চাশ জন ফুটবলপ্রেমী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভারত অধিনায়ক টিম বাস থেকে নামতেই কেউ অনুরোধ করলেন নিজস্বী তোলার জন্য। কেউ কেউ এগিয়ে দিলেন অটোগ্রাফের খাতা। অনুশীলন শেষ হওয়ার পরে সকলের আব্দার মেটানোর আশ্বাস দিয়ে সুনীল দ্রুত ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমে।
অনুশীলন শুরু হওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে লালিয়ানজ়ুয়ালা ছাংতে ১৫ মিনিট কথা বলবেন বলে জানানো হয়েছিল ফেডারেশনের তরফে। ১৬ মিনিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুনীলে চিৎকার করে সতীর্থকে বললেন, ‘‘আর কত কথা বলবে? এ বার অনুশীলনে মন দাও।’’ দ্রুত সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে ছাংতে ছুটলেন মাঠের মধ্যে। ভারতীয় দলের অনুশীলন ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। টানা চল্লিশ মিনিট ধরে চলল শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর অনুশীলন। কখনও অল্প দূরত্বে প্রচণ্ড গতিতে দৌড়। কখনও আবার বল নিয়ে দৌড়। চল্লিশ ছুঁইছুঁই সুনীল গতিতে বারবার পরাস্ত করলেন বছর ছাব্বিশের ছাংতেকে! এখানেই শেষ নয়। ফিটনেস ট্রেনিংয়ের পরে ইগর ফুটবলারদের মাঠের একধারে নিয়ে গিয়ে বিশেষ অনুশীলন করাচ্ছিলেন। দুই প্রান্ত দিয়ে ডিফেন্ডাররা উঠে পেনাল্টি বক্সে পাস করছিলেন। গোল লক্ষ্য করে বল মারছিলেন মনবীর সিংহ, ছাংতে-রা। কিন্তু সুনীলকে দেখা গেল না।
কোথায় গেলেন ভারত অধিনায়ক? সুনীলকে দেখা গেল ফিজ়িক্যাল ট্রেনার লুকা রাদমালের সঙ্গে মাঠের অপর প্রান্তে একান্তে কথা বলতে। কলকাতায় প্রথম দিনের অনুশীলনেই কি চোট পেলেন ভারত অধিনায়ক? তাই শরণাপন্ন হয়েছেন ফিজ়িক্যাল ট্রেনারের? কয়েক মিনিটের মধ্যেই অবশ্য ভুল ভাঙল। লুকার কাছে শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিশেষ অনুশীলন করছেন সুনীল। ঘণ্টাখানেক পরে মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন তিনি। সকলকে অবাক করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এলেন। তবে মাঠের ভিতরে না ঢুকে সাইড লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন লিস্টন কোলাসো-দের অনুশীলন। কেউ ভুল করলেই শুধরে দিচ্ছিলেন। বল মাঠের বাইরে চলে গেলে নিজেই নিয়ে এসে কখনও বসিয়ে দিচ্ছিলেন কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে। কখনও আবার থ্রো করলেন। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে থেকে রহিম আলি একবার অবিশ্বাস্য ভাবে বাইরে মারলেন। সুনীলের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল, প্রচণ্ড হতাশ। কিন্তু অনুজ সতীর্থকে ভর্ৎসনা না করে বোঝালেন, কী ভাবে বলটা মারা উচিত ছিল। এমনকি অনুশীলন শেষ হওয়ার পরে ফুটবলাররা যখন মাঠের মাঝখানে ‘কুলিং ডাউন স্ট্রেচিং’ করছিলেন, সুনীল সেখানেও হাজির। বলের উপরে বসে কড়া নজর রাখলেন প্রত্যেকের উপরে। মাঠ ছাড়ার সময় পড়ে থাকা খালি জলের বোতলগুলো তুলে নিয়ে রাখলেন একটি বাক্সের মধ্যে। ভারতীয় দলের এক ফুটবলার বলছিলেন, ‘‘সুনীল হচ্ছে প্রকৃত নেতা। মাঠের ভিতরে ও বাইরে, সর্বত্র ওর নজর রয়েছে। যে কোনও সমস্যায় সুনীল ভাইয়ের সঙ্গে খোলামনে কথা বলতে পারি আমরা। সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’’
সুনীল নিরাশ করেননি ভক্তদেরও। হোটেলে ফেরার জন্য টিমবাসে ওঠার আগে সকলের আব্দার মেটালেন হাসিমুখেই।