মেসিকে ঘিরেই তৃতীয় বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্জেন্টিনা। ছবি: টুইটার।
চার বার আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলের সদস্য ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪। দেশের হয়ে পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলে ফেললেন লিয়োনেল মেসি। একটা সময় মারাদোনাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত আর্জেন্টিনার ফুটবল। ঠিক যেমন গত এক দশক ধরে মেসিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে লাতিন আমেরিকার এই দেশ।
ফুটবলার মারাদোনা তাঁর সেরা সময়ে দেশকে দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছিলেন। ১৯৮৬ সালে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। মেসিও আর্জেন্টিনাকে দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনালে তুললেন। ২০১৪ সালে ট্রফি জিততে পারেননি। এ বার পারবেন কি না, সেই উত্তর দেবে রবিবারের লুসাইল স্টেডিয়াম। তৃতীয় বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য লিয়োনেল স্কালোনিরা তাকিয়ে রয়েছেন মেসির দিকেই। কাতারে মেসির ছন্দ আশাবাদী করছে তাঁর সতীর্থদেরও।
মারাদোনার হাত ধরেই শেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। তার পর কেটে গিয়েছে ৩৬ বছর। এর মধ্যে দু’বার ফাইনালে উঠেও ট্রফি জেতা হয়নি। সা়ড়ে তিন দশকের খরা কাটাতে গোটা আর্জেন্টিনার ভরসা মেসিই। আর্জেন্টিনার সকলেই বিশ্বাস করছেন পারলে, তিনিই পারবেন। ফুটবলপ্রেমীরা তো বটেই, ফুটবলাররা এমনকি কোচ স্কালোনির বিশ্বাসও তেমনই। আর্জেন্টিনার কোচ তো বলেই দিয়েছেন, মেসি তাঁদের দলে খেলায় তাঁরা ভাগ্যবান এবং সুবিধাপ্রাপ্ত।
সতীর্থ হিসাবে মেসিকে পাশে পাওয়া যে কোনও ফুটবলারের কাছেই গর্বের। আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা নিঃসন্দেহে সেই গর্বে গর্বিত। জাতীয় দলে মেসির দীর্ঘ দিনের সঙ্গী অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া এক সময় ক্লাব ফুটবলে ছিলেন মেসির প্রতিপক্ষ। মেসি বার্সেলোনায় থাকার সময় দি মারিয়া কয়েক বছর খেলতেন রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে। ক্লাব ফুটবলে প্রতিপক্ষ হলেও জাতীয় দলের অধিনায়কের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা বা সম্ভ্রমের কখনও ঘাটতি হয়নি। পাওলো ডিবালার মতো ফুটবলার বলে দেন, হালকা চোট থাকলেও দলে থাকতে চান শুধু মেসির শেষ বিশ্বকাপে তাঁর পাশে থাকতে। গোলরক্ষক মার্টিনেজ ২০১৮ সালে রাশিয়ায় ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিছক দর্শক হিসাবে। তখনই লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন। ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম গোলরক্ষক হবেন। মেসির বিশ্বজয়ের মুহূর্ত একদম কাছ থেকে দেখবেন। বিশেষ দিনের সহযোদ্ধা হবেন।
মেসি বিশ্বকাপ জেতাবেন, এটা দাবি নয়। আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমী বা ফুটবলারদের বিশ্বাস। এমন এক বিশ্বাস যে মেসির জন্য তাঁরা সব কিছু করতে পারেন। মেসিকে নিয়ে মুগ্ধতা শুধু আম ফুটবলপ্রেমীদের নয়। তাঁর সতীর্থদেরও। এমনকি কোচেরও। মেসির আন্তর্জাতিক ফুটবল জীবনের প্রথম দিকে স্কালোনি ছিলেন তাঁর সতীর্থ। লিয়োনেল তখনও মেসি হয়ে ওঠেননি। মারাদোনা এবং মেসি যুগের মধ্যবর্তী প্রজন্মের ফুটবলার ছিলেন স্কালোনি। তিনিও মুগ্ধ প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে।
স্কালোনি জানেন ফুটবলার মেসিকে তাঁর শেখানোর কিছু নেই। বরং মেসির দলের কোচ হওয়াটাই তাঁর আসল প্রাপ্তি। বিশ্বকাপের ট্রফি সেখানে মাধ্যমিকের অতিরিক্ত বিষয়ের মতো। কোচ হিসাবে নম্বর কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে মাত্র। স্কালোনি বলেছেন, ‘‘প্রতি বার ওকে খেলতে দেখাই আমাদের সকলের কাছে একটা বিশেষ ব্যাপার। আমার কাছে। আমার ছেলেদের কাছেও। ওর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সবাইকে আকৃষ্ট করে। শুধু আর্জেন্টেনীয়দের আকর্ষণ করে তা নয়। আমরা ভাগ্যবান যে মেসি আমাদের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলে।’’
কাতারে ফ্রান্স ট্রফি জিতলে ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় দেশ হিসাবে পর পর দু’বার চ্যাম্পিয়ন হবে তারা। কিলিয়ন এমবাপেদের নজির তৈরির পথে এক এবং একমাত্র বাধা মেসিই। ফাইনালের আগে এই বাধাকে আরও পোক্ত করতে চাইছেন স্কালোনি। তিনি বলেছেন, ‘‘চেষ্টা করি যাতে উত্তেজিত না হই। আর্জেন্টিনার যে কোনও মানুষের মতো আমিও স্বপ্ন দেখি। আমি যখন দলের কোচ, ছেলেরা যেটা করছে তার বাইরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। বিষয়টা দারুণ উত্তেজনার।’’
বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচ জেতার পর সাজঘরে ফিরে সতীর্থদের নিয়ে উৎসব করছেন মেসি। অনুশীলনেও হাসি-মজা করে সতীর্থদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছেন। প্রথম দলে যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন না, তাঁদেরও মানসিক ভাবে তরতাজা রাখার চেষ্টা করছেন মেসি। সাজঘরের উৎসবকে বুয়েনস এয়র্স পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইছেন মেসি। তাঁর সতীর্থরা চাইছেন, মেসির উৎসবের গর্বিত অংশীদার হতে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই কেন এত উৎসব? স্কালোনি বলেছেন, ‘‘আমরা উৎসব করছি কারণ, সকলেই ভীষণ উত্তেজিত। জানি আমাদের আরও কয়েক পা এগোতে হবে। তবু এই সময়টা আমরা উপভোগ করতে চাইছি। কী আসতে চলেছে, সেটা নিয়ে আমরা এখন থেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছি।’’ মারাদোনাকেও এমনই ভরসা বিশ্বাস করতেন আর্জেন্টিনার মানুষ। মেসিকেও একই জায়গায় রাখছেন তাঁরা। আকুতি বিশ্বকাপ ট্রফির থেকেও বেশি মেসির জন্য, মেসির সঙ্গে, মেসির মঞ্চে গর্বিত হওয়ার।