নায়ক: গোলের পরে মহমেডানের স্বপ্নের জাদুকর ডেভিড। —ফাইল চিত্র।
কলকাতা লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনে এই মরসুমে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে যাঁকে ঘিরে, তিনি ডেভিড লাললানসাঙ্গা। ইতিমধ্যেই তৃতীয়বারের জন্য কলকাতা লিগ ঢুকে পড়েছে মহমেডান তাবুঁতে। সেই অভিযানে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন মিজ়োরামের ২১ বছরের নতুন তারা ডেভিড। লিগে তাঁর পা থেকে এসেছে ২১ গোল।
ডেভিডের জন্ম হয়েছিল অসমের শিলচরে, মাত্র এক বছর বয়সেই ডেভিডকে নিয়ে মিজ়োরামের কোলাসিব জেলার ভাইরেংতে শহরে চলে আসে তাঁর পরিবার।
লিগে মহমেডানের ম্যাচে সেরার পুরস্কার এবং ডেভিড যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র গ্রুপ পর্যায়ে ডায়মন্ড হারবারের বিরুদ্ধে কোনও গোল করতে পারেননি তিনি। টালিগঞ্জ অগ্রগামীর বিরুদ্ধে ম্যাচে খেলেননি। বাকি সব ম্যাচেই নিজের ফুটবল জাদুতে সম্মোহিত করেছেন সমর্থকদের।
অথচ একটা সময় আইজলে হস্টেলে থাকার মতো অর্থ ছিল না। সেই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কোচ মালসোয়ামকিমা। ফলে নিজের মা-বাবার পাশাপাশি তাঁর ফুটবল জীবনে নতুন পথ তৈরি করে দেওয়ার জন্য কোচের প্রতিও তিনি সমান ভাবে কৃতজ্ঞ।
শুধু লিগেই নয়, এই মরসুমে ডুরান্ডেও সর্বোচ্চ গোল (৬) লেখা রয়েছে তাঁর নামের পাশে। ডুরান্ডে জামশেদপুরের বিরুদ্ধে একাই করেছিলেন চার গোল। মাঠে যিনি সবচেয়ে ভাল করে চেনেন গোলের পথ, সেই তিনিই অল্প কথা বলেন সাংবাদিকদের সামনে। তবে ডেভিডকে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটি ফুটবল খেলায় উৎসাহ দিতেন, সেই মানুষটি আজ পৃথিবীতে নেই। তিন বছর আগে তাঁর বাবা প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর স্বপ্নকে বুকে করে বহন করছেন ডেভিড। তাঁকে আশা, ভরসা দেওয়ার মানুষটির অভাব আজও অনুভব করেন ডেভিড। ছোটবেলায় যখনই তিনি কোনও প্রতিযোগিতা খেলতে যেতেন, সবসময় তাঁর পাশে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন বাবা। তাই তো গোল করার পরেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ডেভিড খোঁজেন বাবাকে।
কৃষিজীবী পরিবারের ছেলে ডেভিডের বেড়ে ওঠার লড়াইয়ের পথ মসৃণ ছিল না। পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী তাঁর মা ও বোন। আছে দুই ভাইও, তারাও ফুটবল খেলে। স্বপ্ন দেখে দাদার মত ফুটবলার হওয়ার। আইজল এফসি থেকেই ডেভিডের বেড়ে ওঠা। সেখানকার অ্যাকাডেমি থেকেই স্নাতক হয়েছেন। যুব দলে খেলে সুযোগ পান সিনিয়র দলে। কিন্তু সেখানে তেমন সুযোগ পেতেন না। নিজের প্রতিভাকে মেলে ধরার জন্যে খুঁজছিলেন অন্য ক্লাব।
সুযোগও এসে যায়। গত মরসুমের সুপার কাপের সময়ে আইজলের হয়ে খেলার সময়ে নজরে পড়ে যান মহমেডান ম্যানেজমেন্টের। রাহুল পাশোয়ান মহমেডান ছেড়ে যাওয়ার পরে সেই জায়গায় আসেন ডেভিড এবং বেনস্টন ব্যারেটো। তৎকালীন কোচ মেহরাজউদ্দিন ওয়াডুর তত্ত্বাবধানে বিশেষ অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে আরও শাণিত করে তোলেন ডেভিড। বাকিটা তো ইতিহাস। সাদা-কালো জার্সিতে মাঠে ফুল ফোটাচ্ছেন ডেভিড লাললানসাঙ্গা।
লিগ জিতে প্রথম লক্ষ্যপূরণে সফল হয়েছেন তিনি, কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চান না। এগিয়ে যেতে চান আরও বড় লক্ষ্যের দিকে। মহমেডান কর্তা থেকে সমর্থক সকলেই চান এ বারে আইলিগও আসুক সাদা-কালো তাঁবুতে। তবেই তাঁরা আইএসএলে খেলতে পারবেন।
সেই লক্ষ্যকেই পাখির চোখ করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভক্ত ডেভিড। তিনি চান আইলিগে চ্যাম্পিয়ন হতে, যাতে আইএসএলের মঞ্চে নিজেকে সঠিক ভাবে মেলে ধরতে পারেন। সুযোগ পেলে জাতীয় দলের জার্সিতেও নিজেকে উজাড় করে দিতে চান।
শুধু ডেভিড নয়, মহমেডানে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন লালরেমসাঙ্গা, আঙ্গুসানা, বিকাশ, ব্যারেটোর মত ফুটবলাররাও। দল গড়ার সময়ে অনেকেই এই দল দেখে ভুরু কুঁচকেছিলেন, কিন্তু লিগ জয়ের হ্যাটট্রিকের পরে এই দলই প্রশংসার জোয়ারে ভেসে গিয়েছে। তার সাক্ষী থেকেছে শুক্রবারের কলকাতার রাজপথ।
বিশেষ করে ডেভিড-রেমসাঙ্গা জুটি তো সুপারহিট। এই একতার রহস্যের কথা বলতে গিয়ে ডেভিডের উত্তর, “দল হিসেবে আমরা খেলি। মাঠের বাইরেও রেমসাঙ্গার সঙ্গে আমার ভাল জমে।”
গোল করে কোচ আন্দ্রে চের্নিশভ বা ফুটবল সচিব দীপেন্দু বিশ্বাসের থেকে কি বার্তা পান? “নিজের সেরাটা দাও। সুযোগ পেলেই গোল করো”, বক্তব্য ডেভিডের।