প্রাপ্তি: মেসির জার্সি নিয়ে ভক্ত অ্যালেক্স (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
মেসি লেখা আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর নীল-সাদা জার্সিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর অনুশীলন মাঠের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন কেরলের অ্যালেক্স। কী করবেন, বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। জার্সিটা একবার ব্যাগে ঢোকাচ্ছেন, পরক্ষণেই আবার বার করে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। কখনও হাসছেন। কখনও আবার চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
অ্যালেক্স যেন পরশ পাথর চলচ্চিত্রের তুলসী চক্রবর্তী! সেই একই অভিব্যক্তি। উচ্ছ্বাস, আনন্দ, বিস্ময় সব মিলেমিশে একাকার। পার্থক্য হল, তুলসী চক্রবর্তী অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে কাল্পনিক চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। অ্যালেক্সের পুরোটাই খাঁটি। প্রায় বারো বছর ধরে কাতারে রয়েছেন তিনি। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামের নির্মাণকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। স্টেডিয়াম তৈরি হয়ে গেলেও বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটি পাবেন না।।
অ্যালেক্সকে কেন মাঠের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেসির জার্সি হাতে তুলে দিলেন আর্জেন্টিনা টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যরা? খোঁজ নিতেই উঠে এল চমকপ্রদ কাহিনি। সপ্তাহখানেক আগেই গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছিল কেরল। কোজ়িকোড়ের কুরুঙ্গাত্তু কাদাভু নদীতে মেসির ৩০ ফুট কাট-আউট লাগিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমেও সেই ছবি বেরিয়েছিল। এমনকী, ফিফা পর্যন্ত গণমাধ্যমে তা পোস্ট করেছিল। মেসিকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল ভক্তদের আবেগ। প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আর্জেন্টিনার টিম ম্যানজেমেন্টকে অনুরোধ করেছিলেন, বিশ্বকাপের সময় কাতারে যদি কেরলের কাউকে পাওয়া যায়, তাঁকে যেন তাঁর যেন জার্সি উপহার দেওয়া হয়।
কাতারে তো কেরলের অসংখ্য মানুষ থাকেন। অ্যালেক্সকেই কেন বেছে নেওয়া হল? আর্জেন্টিনা টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যদের কথায়, ‘‘আমরা যখনই কোথাও খেলতে যাই, সেখানকার মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের কোচিং দলের সদস্যরা ফুটবলের খুঁটিনাটি শেখান। আবু ধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার আগে আমরা দোহায় আসি। তখনই ঠিক করেছিলাম, বিশ্বকাপের জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে স্টেডিয়ামগুলি যাঁরা গড়ে তুলেছেন, তাঁদের সম্মান জানাতে হবে।’’ যোগ করেন, ‘‘ফিফাকে জানাই, আবু ধাবি থেকে দোহা ফেরার পরে এক দিন অনুশীলনে ওঁদের আমন্ত্রণ জানাতে চাই। বিশ্বফুটবলের নিয়ামক সংস্থার তরফে আমাদের যে তালিকা দেওয়া হয়, তাতে সকলের নামের পাশাপাশি কোন দেশের নাগরিক সেটাও উল্লেখ ছিল। কেরলের অন্তত পাঁচজনের নাম ছিল এই তালিকায়। কিন্তু কোজ়িকোড়ের কেউ ছিলেন না। তাই লটারির মাধ্যমে অ্যালেক্সকে বেছে নেওয়া হয়।’’
আর্জেন্টিনীয় কিংবদন্তির জার্সি উপহার পাওয়ার অনুভূতি কী? আবেগে কথাই বলতে পারছিলেন না বছর চল্লিশের অ্যালেক্স। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, ‘‘জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপহার পেলাম। লিয়োনেল মেসি তাঁর জার্সি আমাকে দিচ্ছেন, এ তো স্বপ্নেরও অতীত।’’ কিন্তু মেসি তো নিজের হাতে তুলে দিলেন না তাঁর জার্সি। হতাশ গলায় অ্যালেক্স বললেন, ‘‘হ্যাঁ, মেসির হাত থেকে জার্সিটা নিতে পারলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু কী আর করা যাবে। সব স্বপ্ন তো পূরণ হয় না।’’
মেসির এই জার্সি পরে কী বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখতে যাবেন? নাকি বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলবেন? প্রশ্ন শুনে রীতিমতো বিস্মিত অ্যালেক্স। বললেন, ‘‘কোনও প্রশ্নই নেই। এই জার্সি আমি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখব। কাউকে দেব না। এই জার্সি আমার কাছে অমূ্ল্য।’’
অ্যালেক্স যে একটুও বাড়িয়ে বলেননি, কিছুক্ষণের মধ্যেও প্রমাণ হয়ে গেল। সহকর্মীদের অনেকেই জার্সি চাইছিলেন একবার পরে ছবি তুলবেন বলে। কিন্তু অ্যালেক্স কাউকে দেননি। বুকে জড়িয়ে রেখে বলছিলেন, ‘‘এই জার্সি আমি কাউকে দিতে পারব না।’’ মেসিকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ অ্যালেক্সের কিছুটা দূর হল প্রিয় নায়কের জার্সি উপহার পেয়ে।