যুগলবন্দি: অধিনায়ক ধোনি সব সময় পেয়েছেন সচিনের সমর্থন। ফাইল চিত্র
অধিনায়ক হিসেবে এম এস ডি-র নাম তিনিই সুপারিশ করেছিলেন বোর্ড, নির্বাচকদের কাছে। কী কারণ ছিল? প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? সদ্য অবসর নেওয়া মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে মঙ্গলবার একান্ত আলাপচারিতায় সচিন তেন্ডুলকর। ব্যাটসম্যান মাহি থেকে অধিনায়ক ধোনি, তাঁর অধীনে বিশ্বকাপ জয়। সব কিছু নিয়ে খোলামেলা বিশ্লেষণে মাস্টার-ব্লাস্টার।
প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা
২০০৪-এ আমরা বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। আমি ধোনিকে নেটে দেখছিলাম। তার পরে ওই ওয়ান ডে সিরিজেই কিছুক্ষণ ক্রিজে কাটাতে দেখলাম। সেটাই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওকে দেখা। খুব বেশি রান করতে পারেনি। ড্রেসিংরুমে আমি সৌরভের পাশে বসেছিলাম। অন্যরাও ছিল। ধোনির ব্যাটিং দেখে আমাদের আলোচনাটাই চলছিল, ছেলেটা কত জোরে বল মারতে পারে! শুনলাম, ঘরোয়া ক্রিকেটে এ ভাবেই জোরে বল মারার জন্য ওর পরিচিতিও হয়েছে। আমি যদিও তার আগে ওর ব্যাটিং দেখিনি।
সেই ম্যাচে বিশেষ কোনও শট
একটা শট খেলেছিল, যত দূর মনে করতে পারছি লং-অফে। ব্যাট বলকে আঘাত করার যে শব্দটা শুনেছিলাম, সেটাই বলে দিয়েছিল, ছেলেটার মধ্যে বিশেষ ধরনের শক্তি রয়েছে। আমি সৌরভকে বলেছিলাম, ইস লড়কে কা ব্যাট সুইং মে আলগ সা কুছ ফিলিং আ রহা হ্যায়। (এই ছেলেটার ব্যাট সুইং দেখে খুব বিশেষ ধরনের মনে হচ্ছে)। আরও বলেছিলাম, এন্ড মে ইমপ্যাক্ট কা টাইম এক ঝটকা হ্যায়। (শটের শেষে একটা ঝটকা দেয়)। ওই ঝটকা থেকে অনেকটা শক্তি আমদানি করছে শটে। বলেছিলাম, ইস লড়কে কে ব্যাট সুইং মে জান হ্যায় (এই ছেলেটা যে ভাবে ব্যাট ঘোরায়, তার মধ্যে অন্য রকম প্রাণ রয়েছে)। সৌরভের সঙ্গে সে দিনের কথোপকথনটা পরিষ্কার মনে আছে। প্রথম দর্শনেই বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল।
বিশাখাপত্তনমের মাহি-ঝড়
যখন কোনও খেলোয়াড় তার জীবনে প্রথম বার মাঠে গিয়ে এ রকম বিশেষ কিছু ঘটায়, সেটা এক ধরনের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হয়ে থাকে। ধোনির জীবনে বিশাখাপত্তনম সে রকমই একটা স্টেশন (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিন নম্বরে নেমে ১২৩ বলে ১৪৮ করেন ধোনি)। নতুন সতীর্থের ব্যাটে এ রকম ইনিংস দেখে দলের সকলে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম। ম্যাচের শেষে আমরা খুব উৎসব করেছিলাম। ধোনির ইনিংস এবং আমাদের পাকিস্তানকে হারানো, দু’টো সেলিব্রেশনই হয়েছিল। নতুন একটা ছেলেকে আমরা পেলাম, যে কি না হেলায় বাউন্ডারির ওপারে বল পাঠিয়ে দিতে পারে। সারা জীবন ওটাই ছিল ধোনির বিশেষ দক্ষতা।
আরও পড়ুন: ওয়াংখেড়ের বিশেষ আসন ধোনির নামে করার দাবি
বোর্ডের কাছে ধোনির নাম অধিনায়ক হিসেবে সুপারিশ করা
এটা ঠিক যে, আমি অধিনায়ক হিসেবে ধোনির নাম বলেছিলাম। অনেক ক্ষেত্রেই আমি প্রথম স্লিপে দাঁড়াতাম, ধোনি উইকেটকিপার। বল হওয়ার মাঝে, ওভারের ফাঁকে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হত। লক্ষ্য করেছিলাম, সারাক্ষণ ওর মস্তিষ্ক চলছে। কোন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, বলে দিত। মনে হয়েছিল, খুব সজাগ মন ওর। চিন্তাশীল মন। গেম রিডিং ছিল অসাধারণ। এবং, কোনও পরিস্থিতিতেই ওর স্থিরতা নষ্ট হয় না। এ সব দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওর মধ্যে ভাল অধিনায়ক হয়ে ওঠার মশলা রয়েছে।
অধিনায়ক ধোনি কোথায় থাকবেন
আমি যাদের অধীনে খেলেছি, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা। এমন এক নেতা যার ছিল বরফশীতল মস্তিষ্ক, কখনও নিয়ন্ত্রণ হারাত না। চিন্তাভাবনায় ভীষণ ক্ষিপ্র। খুব ভাল দলটাকে সামলেছেও। টিম হিসেবে সেই সময়ে আমরা দারুণ সব ফল পেয়েছি। টিমগেমে অনেকে ক্যাপ্টেনকে পরামর্শ দিতে পারে, সাহায্য করতে পারে। কিন্তু দিনের শেষে ক্যাপ্টেনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ধোনি সিদ্ধান্ত নিতে পারত।
বিশ্বকাপের সেই রাত
২ এপ্রিল, ২০১১। ওই রাতটা ছিল সব চেয়ে স্পেশ্যাল। ম্যাচের পরেও অনেকক্ষণ আমরা বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব করেছিলাম। আমার মনে হয়, সারা দেশই উৎসব করছিল। হোটেলে এমন কোনও ঘর ছিল না, যার দরজা বন্ধ ছিল। পুরো হোটেল জুড়ে সব ঘরে বিজয়োৎসব চলছিল। প্রত্যেকে গান গাইছে, নাচ করছে। এ রকম রাত জীবনে বার-বার আসে না। ক্রিকেটীয় দিক থেকে আমার জীবনের সেরা দিন।
ফিনিশার ধোনি
অনবদ্য! যে ভাবে একটার পর একটা ধাপে নিজের ব্যাটিংকে সাজিয়েছে, দেখার মতো। ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর ভূমিকা পাল্টাতে থেকেছে। এম এস দারুণ ভাবে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। কী ভাবে শুরু করেছিল আর কোন ভূমিকায় শেষ করল! এটা দেখলেই বোঝা যায়, ক্রিকেটার হিসেবে কী দুর্দান্ত বিবর্তন ঘটেছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির!