প্রত্যয়ী: এশীয় ফুটবল মানচিত্রে ভারতীয় দলকে অন্যতম সেরা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছেন সুনীলদের নতুন কোচ ইগর স্তিমাচ। টুইটার
ফ্রান্সে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলে রক্ষণের স্তম্ভ ছিলেন তিনি। কোচ হিসেবে ২০১৪ বিশ্বকাপের মূল পর্বে তুলেছিলেন দেশকে। তাঁর কোচিংয়েই উত্থান লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিচিতের মতো মহাতারকার। সেই ইগর স্তিমাচ এখন ভারতীয় দলের দায়িত্বে। কিংস কাপ ও আন্তর্মহাদেশীয় কাপে ব্যর্থতা ভুলে তাঁর পাখির চোখ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে। আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন অতীতের কাহিনি ও ভবিষ্যতের নানা পরিকল্পনার কথা।
প্রশ্ন: ভারতীয় ফুটবল দলে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা এখনও পর্যন্ত কেমন?
ইগর স্তিমাচ: এখনও পর্যন্ত তো সব কিছুই ভাল হচ্ছে। আসলে আমাদের কাজটা সব দেশেই অল্প-বিস্তর একই রকম থাকে। গত কয়েক মাসে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এখানকার সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করছি। আমি ধন্যবাদ দেব সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের প্রত্যেককে। ওঁদের সাহায্যে আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তাই আমার মনে হয়, ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির লক্ষ্যে ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা।
প্র: কিংস কাপের পরে আন্তর্মহাদেশীয় কাপ। পরপর দু’টো প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার ব্যাখ্যা কী?
ইগর: আগেই বলেছি, শেষ পাঁচটা ম্যাচে আমার মূল লক্ষ্য ছিল তরুণ ফুটবলারদের খুঁজে বার করা। এই কারণেই ম্যাচে কী ফল হয়েছে, আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই দুই প্রতিযোগিতায় আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে খেলেছিলাম, তা সফল হয়েছে। তবে জেজে লালপেখলুয়া, আশিক কুরিয়ান ও হোলিচরণ নার্জারিকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ থেকেই গিয়েছে। ওরা তিন জনই এখন চোটের পরে রিহ্যাব করছে। আশা করছি, সামনে যে ম্যাচগুলো রয়েছে, তার আগেই ওরা তৈরি হয়ে যাবে।
প্র: আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া সত্ত্বেও ৩২ বছর বয়সি আনাস এথাদোডিকাকে আপনি জাতীয় দলে ফিরিয়ে এনেছেন। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা ও সফল গোলরক্ষক ৩২ বছর বয়সি সুব্রত পালকেও ফেরানোর কোনও পরিকল্পনা রয়েছে?
ইগর: ফুটবলার নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাকে সম্মান করি। এই সন্ধিক্ষণে ভারতীয় ফুটবলকে সাহায্য করতে পারে এ রকম কিছু ফুটবলারের নাম আমি সেই তালিকায় যোগ করেছি। আই লিগ ও আইএসএলে খেলা ভারতীয় পাসপোর্টধারী সব ফুটবলারদের পারফরম্যান্সের উপরেই নজর রয়েছে। আনাস ও সুব্রতর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করলে আমি বলব, উত্তরটা ওরাই দেবে। ওদের পারফরম্যান্সই বলে দেবে, আমরা কতটা ভরসা রাখতে পারি।
প্র: সামনেই বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচ। আপনার পরিকল্পনা কী?
ইগর: ভীষণ সতর্ক। আমাদের গ্রুপটা যে একেবারেই সহজ নয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত। সব দলকেই গুরুত্ব ও সম্মান দিচ্ছি। প্রথম দু’টো ম্যাচ আমাদের খেলতে হবে সব চেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে (ওমান ও কাতার)। মনে রাখতে হবে, ভারত কখনও এই দু’টো দলকে সরকারি ম্যাচে হারাতে পারেনি। ইতিহাসই বলছে, ওমান ও কাতার এই গ্রুপের ফেভারিট। ওমানের বিরুদ্ধে ম্যাচেই বোঝা যাবে, এই মুহূর্তে আমরা ঠিক কোন জায়গায় রয়েছি। কী কী করা দরকার। আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও কিন্তু আমাদের পারফরম্যান্স উল্লেখযোগ্য নয়। শেষ পাঁচ বারের সাক্ষাতে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দু’বার হেরেছি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শেষ পাঁচটি সাক্ষাতে একবারও জিততে পারিনি (চারটি ড্র, একটি হার)।
প্র: বাস্তবসম্মত ভাবে আসন্ন বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে ভারত ঠিক কোথায় শেষ করতে পারে বলে আপনার ধারণা? কারণ, আগের বার ভারতীয় দল মাত্র একটা ম্যাচই জিতেছিল। হার পাঁচটিতে।
ইগর: গত বারের চেয়ে ভাল ফল তো অবশ্যই করব। কথা দিলাম, গ্রুপ লিগে তৃতীয় স্থান (পাঁচ দলের মধ্যে) অর্জন করাই প্রধান লক্ষ্য। যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচগুলোয় আমাদের তরুণ ফুটবলারেরা আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। ভারত এই মুহূর্তে বিশ্বের তরুণতম দল। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ছেলেদের তৈরি হওয়া ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সময় দিতে হবে। তা হলেই ওরা এশিয়ার অন্যতম শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
প্র: আপনার কোচিং-দর্শন কী?
ইগর: শৃঙ্খলা, পরিশ্রম, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া। আমার লক্ষ্য ফুটবলারদের দক্ষতা, মানসিকতা, সংস্কৃতি অনুযায়ী দ্রুত মানিয়ে নেওয়া।
প্র: দশ বছর পরে ভারতীয় ফুটবল দলকে কোথায় দেখতে চান?
ইগর: ক্লাব ও জাতীয় দলে কোচিং করানোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রয়োজন মতো সাত-আট জন বিদেশি ফুটবলারকে ক্লাবে সই করাতে পারেন কোচেরা। এবং, নিয়মিত কোচিং অনুশীলন করানোর সুযোগ থাকে। জাতীয় দলে তা সম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় ফুটবল দল নিয়মিত ভাবে এএফসি এশিয়ান কাপে খেলবে। ২০২৬ বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলারও অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠবে।
প্র: জ়িনেদিন জ়িদান, য়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান, ডেনিস বার্গক্যাম্প, থিয়েরি অঁরির মতো কিংবদন্তিদের বিরুদ্ধে খেলেছেন। আপনার মতে সেরার সেরা কে?
ইগর: যখন খেলতাম, সেই সময় ইউরোপে একঝাঁক সেরা ফুটবলার ছিল। তবে সেরার সেরা এক জনই— দিয়েগো মারাদোনা। সবার উপরে রাখব ওঁকে। তার পরে থাকবে বাকিরা। মারাদানোর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। রত্ন। ধরাছোঁয়ার বাইরে। জ়িদানও দুর্দান্ত। ওর জাতটাই আলাদা।
প্র: ফুটবলার হিসেবে আপনার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা কি ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ?
ইগর: অনেকগুলোই আছে। অনেকেই জানেন না, বা বলতে চান না, কী ভাবে আমাদের ইংল্যান্ডে ১৯৯৬ সালের ইউরো কাপ থেকে ছিটকে দেওয়া হয়েছিল।
প্র: মানে?
ইগর: ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। আমি এখনও মনে করি, সেই ম্যাচের রেফারিং ছিল ভয়াবহ। জার্মানি যাতে ম্যাচটা জিততে পারে, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না রেফারির। আমরা বিশ্বাস করতাম, ফাইনালে উঠব এবং ইউরোপ সেরা হব। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছিলেন রেফারি। দু’বছর পরে আমরা সেই হারের বদলা নিয়েছিলাম।
প্র: কী ভাবে?
ইগর: ফ্রান্সে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেই জার্মানিকে আমরা ৩-০ উড়িয়ে দিয়েছিলাম। এর পরেই রাখব সেই বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল করে দাভর সুকের আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দু’টো ভুলেই গোল করে ম্যাচের রং বদলে দিয়েছিল ফ্রান্সের লিলিয়াম থুরাম। আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর কখনও জোড়া গোল করতে পারেনি থুঁর। আমার তৃতীয় স্মরণীয় মুহূর্ত, ওই বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান নির্ধারণের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে হারানো। সেই বিশ্বকাপের সেরা দল ছিল ওরাই। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে হেরে যায়। ফলে ওদের বিরুদ্ধে জয়ের তাৎপর্যই আলাদা। নেদারল্যান্ডসের মতো দলকে খালি হাতে দেশে ফেরত পাঠানোর আনন্দই আলাদা ছিল। আমরা বেশি খুশি হয়েছিলাম, ক্রোয়েশিয়ার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে। দেশের মানুষের সংগ্রাম ও চোখের জলের মূল্য দিতে পেরে গর্বিত হয়েছিলাম আমরা।