অপ্রতিরোধ্য: যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এগোচ্ছেন দীপা। ফাইল চিত্র
এক দিন আগেই তাঁর নাম ঘোষণা হয়েছে ‘খেলরত্ন’ হিসেবে। হরিয়ানা থেকে উঠে এসে রিয়োর প্যারালিম্পিক্সে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে পদক জয়। হুইলচেয়ারে বসেও কী ভাবে জীবনযুদ্ধে জেতা যায়, আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তারই রুদ্ধশ্বাস এবং অজানা এক কাহিনি রবিবার নয়াদিল্লির বাড়ি থেকে ফোনে শোনাচ্ছিলেন দীপা মালিক।
প্রশ্ন: রাজীব গাঁধী খেলরত্ন পুরস্কারের জন্য অভিনন্দন। এই পুরস্কার আপনার জীবনে কী বার্তা নিয়ে এসেছে?
দীপা: আমার এই পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে নতুন ভারতের এক ছবি। এই পুরস্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্যারা স্পোর্টস (বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য ক্রীড়া) আর কোনও চ্যারিটি স্পোর্টস নয়। প্যারা স্পোর্টসে সফল হতে গেলে কতটা লড়াই, কতটা পরিশ্রম, কতটা আত্মত্যাগ করতে হয়, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। আর সেই লড়াইয়ের মর্যাদাও দিচ্ছে। আমি বিচারকদের কাছে, দেশের ক্রীড়ামহলের কাছে কৃতজ্ঞ প্যারা স্পোর্টসকে আর বিশেষ ভাবে সক্ষম অ্যাথলিটদের গুরুত্ব দেওয়ার জন্য।
প্র: আপনার এই পুরস্কার জয় কি বাকিদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে?
দীপা: আমার তো মনে হয়, এই সাফল্য দেশের বহু মেয়েকে, বহু বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষকে বড় স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করবে। আমার চোদ্দো বছরের এই লড়াই থেকে একটা শিক্ষাই পাওয়ার আছে যে, এই মেয়ে কোনও দিন হারতে শেখেনি। যার শরীরের এক-তৃতীয়াংশ শুধু সক্রিয়, সে যদি ৪৯ বছর বয়সে এসে দেশের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান পেতে পারে, তা হলে বাকিরা কেন পারবে না? অসম্ভব বলে যে সত্যি কিছু হয় না, তা আমি দেখিয়ে দিয়েছি। নিজের কাজের প্রতি সততা থাকলে সব স্বপ্নই পূরণ করা যায়।
প্র: আপনার এই লড়াইয়ে সব চেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
দীপা: দুটো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে আমাকে পড়তে হয়েছিল। প্রথমটা ছিল, হুইলচেয়ারে বসে ট্রেনিং করার সুযোগ-সুবিধের অভাব। যা একটা সময় আমাকে বারবার সমস্যায় ফেলেছে।
প্র: আর দ্বিতীয়টা?
দীপা: শরীরের উপরে, ব্লাডারের উপরে আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই আমি ডায়াপার পরে ট্রেনিং করতে যেতাম। কিন্তু অনেক সময়ই শরীরের উপরে অতিরিক্ত চাপ ফেলতে হত। বিশেষ করে যখন ভারোত্তোলন করতাম বা শটপাটের জন্য ট্রেনিং করতাম। তখন শরীরে ঝাঁকুনি দিতে হত। আর সেটা করতে গিয়ে আমার অনেক সময়ই মলত্যাগ হয়ে যেত।
প্র: আপনি কি এ সব লেখার জন্য বলছেন?
দীপা: অবশ্যই। আপনি লিখবেন। আমি খোলাখুলি বলছি। মানুষের জানা উচিত, আমি নোংরা ডায়াপার পরে দিনের পর দিন কী ভাবে অনুশীলন করেছি। ডায়াপার বদলাতেও যাইনি কারণ তাতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেত। আমার সাফল্যের পিছনে অনেক কষ্ট, অনেক আত্মত্যাগও লুকিয়ে আছে। আর সময়টাও কম নয়। চোদ্দো বছর। আমার দুটি বাচ্চা মেয়ে এখন পূর্ণবয়স্ক হয়ে গিয়েছে। আর আমি খেলে চলেছি।
প্র: চোদ্দো বছরের এই লড়াই থেকে আপনি কী পেয়েছেন?
দীপা: আমি অনেক কিছুই পেয়েছি, যা ভারতীয় প্যারা অ্যাথলিট হিসেবে আগে কেউ পায়নি। প্রথম এশিয়ান গেমস পদক, প্রথম গ্রঁ প্রি পদক, প্রথম এশীয় রেকর্ডের মালিক, প্রথম প্যারালিম্পিক্স পদক আর প্রথম খেলরত্ন। আর আমি এখনও খেলে যাচ্ছি। কিন্তু এই সব পেতে আমাকে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, অনেক লড়াই লড়তে হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমার সামনে তো এমন কেউ ছিল না যার পায়ের ছাপ ধরে এগোতে পারব। আর বুঝতে তো পারছেন, যার পায়ের কোনও ক্ষমতা নেই, তার পক্ষে কাজটা কতটা কঠিন (একটু বিষণ্ণ হেসে)।
প্র: আপনি জীবনে অনেক সাফল্যের শিখরে উঠেছেন। সর্বোচ্চ মঞ্চে পদক জিতেছেন, সর্বোচ্চ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। এদের মধ্যে থেকে সব চেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি?
দীপা: অবশ্যই রিয়ো প্যারালিম্পিক্স পদক। ভারতে আমিই প্রথম মেয়ে খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছিলাম (শটপাটে রুপো)। আর সেটা শুধু বিশেষ কোনও খেলায় নয়। সব রকম খেলা ধরেই। ওই পদকটা শুধু প্যারা স্পোর্টসকেই সামনে নিয়ে আসেনি, বিশ্বকেও বার্তা দিয়েছিল যে, আমরাও পারি। বুঝিয়ে দিয়েছিল, মেয়েরা এবং বিশেষ ভাবে সক্ষম আ্যাথলিটরা আর পিছনে পড়ে থাকবে না। সেই নীতি সামনে রেখেই আমরা এগিয়ে চলেছি। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজির কাছে ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ এই নীতিকে কার্যকর করার জন্য। পাশাপাশি ধন্যবাদ দেব ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেণ রিজিজুকেও।
প্র: এই কঠিন যাত্রাপথে আপনার প্রেরণা কে বা কারা ছিলেন? কারও নাম করা যাবে?
দীপা: আমার বাবা-মার কথা বলতেই হবে। ওঁরা আমাকে যে ভাবে বড় করে তুলেছেন, তা আমার যাত্রাপথের বড় একটা রসদ। আমার মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মে দিতে পেরেছিলেন ওঁরা। দেখুন, অনেক প্রেরণামূলক বই আছে যেখানে বহু উদ্ধৃতি আছে। কিন্তু সেই উদ্ধৃতিগুলো নিজের জীবনে কাজে লাগানোটাই আসল ব্যাপার। আমার বাবা-মা আমাকে সেই কাজটা করতেই শিখিয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও দু’জনের কথা বলতে চাই।
প্র: তাঁরা কারা?
দীপা: আমার দুই মেয়ে। আমি ভাগ্যবান, এমন দু’জন মেয়ে পেয়েছি যারা আমার এই লড়াইয়ে সব সময় পাশে থেকেছে। তা ছাড়া আমি ধন্যবাদ দেব আমার বন্ধুদের, যারা সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্যারালিম্পিক্স কমিটিও আমার সামনে একটা মঞ্চ দিয়েছিল। না হলে আমরা তো কোনও প্রতিযোগিতায় নামতেই পারতাম না।
প্র: এই লড়াই লড়তে লড়তে কোনও সময় কি মনে হয়েছে, আর পারছি না। এ বার সরে দাঁড়াই?
দীপা: (একটু ভেবে) একটা সময় অবশ্যই মনে হয়েছিল। ওই সময়টা ছিল ২০১২ থেকে ২০১৪। লন্ডন প্যারালিম্পিক্সে আমি সুযোগ পাইনি। আর আমাকে ওপেক্স প্রকল্প (অপারেশন এক্সেলেন্স ফর লন্ডন অলিম্পিক্স) থেকে দুম করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমি নিজের রেস্তরাঁ ব্যবসা বন্ধ করে দিল্লি চলে এসেছিলাম ট্রেনিংয়ের জন্য। এক মেয়েকে দিল্লি নিয়ে এসেছিলাম, অন্য মেয়েকে জয়পুরের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছিলাম। আমার খরচ ক্রমে বেড়েই যাচ্ছিল। আমাদের ফেডারেশনকেও ওই সময় বাতিল করে দেয় আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক্স সংস্থা। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড কঠিন সময় ছিল ওই দু’-আড়াই বছর।
প্র: কী ভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন ওই পরিস্থিতি থেকে?
দীপা: তখন নতুন একটা জিনিস শিখি। মোটিভেশনাল স্পিকিং। কী ভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে হয়, তা-ই নিয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করি। অনেক বন্ধু এগিয়ে এসেছিল। কয়েক জনের পরামর্শে আমি বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থায় গিয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করি। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইও শুরু হয় ওখান থেকে। সবাইকে যেটা আমি বলতাম, সেটাই মন্ত্র হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে: যখন মনে হয়, সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তখনও কিন্তু সমস্যার সমাধান ঠিক পাওয়া যায়। আমি নিজেই পেয়েছিলাম।
প্র: দেশের মেয়েদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
দীপা: আমি সবাইকে বলতে চাই, তোমরা একা নও। তোমাদের যে রকম লড়াই করতে হচ্ছে, সে রকম অনেককেই করতে হচ্ছে। নিজেদের প্রতি বিশ্বাস রাখো। প্রতিটি মেয়েই কিন্তু জন্মগত ভাবে বহুমুখী কাজ করার ক্ষমতা রাখে। তাই স্বপ্নকে মেরে ফেলো না। নিজের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাও। এমন কিছু করো, যাতে দেশের, সমাজের, তোমার পরিবারের মুখ উজ্জ্বল হয়। দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই মেয়ে। তাই মেয়েদেরও এগিয়ে আসতে হবে দেশ গঠনে। এ ছাড়া আমি নিজেও এখন কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই দেশকে। সেই উদ্দেশে লড়াই করে চলেছি। আমার মেয়ের সঙ্গে একটি সংগঠনও চালাচ্ছি।
প্র: শেষ প্রশ্ন। আপনি কী ভাবে দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় থেকে যেতে চান?
দীপা: আমি চাই, সবাই আমাকে মনে রাখুক সেই মেয়ে হিসেবে যে কোনও দিন লড়াই ছাড়েনি। আমি চাই আমাকে মনে রাখা হোক, আমার ক্ষমতার জন্য, অক্ষমতার জন্য নয়।