প্রদীপদা তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে নিতে জানতেন, বললেন কৃষ্ণেন্দু রায়। —ফাইল চিত্র
আজ কত স্মৃতি যে চোখে ভিড় করে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রদীপদা-র কথা বলতে শুরু করলে শেষ করা যাবে না। আমার সঙ্গে প্রদীপদার সম্পর্কের শুরু একটু অন্যভাবে। ১৯৮১ সালে আমি তখন এরিয়ান্সে। লিগের মহমেডান স্পোর্টিং-এরিয়ান্স ম্যাচটা রিলে করছিলেন প্রদীপদা আর সঞ্জীব বসু। দু’জনেই আমার সম্পর্কে খুব প্রশংসা করেছিলেন। তখন রেডিয়োতেই খেলার ধারাবিবরণী হতো। খেলার শেষে আমি একটা শাটল ট্যাক্সিতে চড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সেই ট্যাক্সির অন্য যাত্রীরা আমাকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বাটানগরের স্বনামধন্য চিকিৎসক। ড্রাইভারের পাশের সিটে আমি বসেছিলাম। ওঁদের কথাগুলো শুনছিলাম। প্রদীপদা আর সঞ্জীবদার সেই ধারাভাষ্য আমাকে পরিচিত দিয়েছিল সে দিন।
প্রদীপদার সঙ্গে পরে দেখা জাতীয় দলের ক্যাম্পে। ১৯৮১ সালে মারডেকায় খেলতে যাবে জাতীয় দল। সিনিয়র ফুটবলররা বিদ্রোহ করে বসেছিলেন। আমাদের বেশ কয়েকজন জুনিয়র ফুটবলারকে ডাকা হয়েছিল জাতীয় দলের শিবিরে। আমাদের মতো জুনিয়রদের দেখে একদিন এক ফুটবলপ্রেমী প্রদীপদাকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘‘জাতীয় দলের হয়ে এঁরা খেলবে?’’
আমি তখন জুনিয়র প্লেয়ার। সামান্য দূরেই আমি দাঁড়িয়ে। সব কথা শুনছিলাম। প্রদীপদা তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে নিতে জানতেন। সেই ফুটবলপ্রেমীর প্রশ্নের জবাব দিতে একমুহূর্তও দেরি করেননি প্রদীপদা। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন, “ওদের ডেকেছি ক্যাম্প চালানোর জন্য। পরে বাদ দিয়ে দেবো।’’ প্রদীপদা আগেই দেখে নিয়েছিলেন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছি।
প্রদীপদার ওই কথা শুনে আমি একটুও হতাশ হইনি। বরং দাঁতে দাঁত চেপে মনোসংযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। পরে ব্যারাকপুরে একটা প্রস্তুতি ম্যাচ হয়েছিল। সেই ম্যাচে আমি দারুণ একটা গোল করেছিলাম। তার পরেই ফাইনাল ক্যাম্প হয়েছিল হায়দরাবাদে। একদিন রাত দেড়টা নাগাদ প্রদীপদা আমাদের সবাইকে ওঁর ঘরে ডাকলেন। আমরা তখন শুয়ে পড়েছিলাম। প্রদীপদা ডাকায় দুরুদুরু বুকে ছুটলাম ওঁর ঘরে। ঘরে গিয়ে শুনি মারডেকার জন্য ফাইনাল স্কোয়াড বলবেন প্রদীপদা। এক জন করে প্লেয়ারদের নাম ডাকছেন উনি। আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়েযাচ্ছে। নিজের নাম শুনে টেনশন কেটেছিল। সে বার জাতীয় দলের ফাইনাল লিস্টে আমি, সুদীপ (চট্টোপাধ্যায়), অতনু (ভট্টাচার্য) সুযোগ পেয়েছিলাম। সারা রাত আমরা আর চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
মারডেকার প্রথম ম্যাচে আমি খেলিনি। দ্বিতীয় ম্যাচটা আমাদের সঙ্গে ছিল ইন্দোনেশিয়ার। আমাকে প্রথম একাদশে রাখলেন প্রদীপদা। অরুণ ঘোষ সহকারী কোচ। মাঠে নামার আগে ড্রেসিং রুমে ওয়ার্ম আপ করছিলাম। সেই সময়ে আমি এত জোরে একটা শট মেরেছিলাম যে ড্রেসিং রুমের কাচ ভেঙে যায়। অরুণদা আমাকে খুব বকাঝকা শুরু করে দেন। আমি আর কী বলব! তখন আমি জুনিয়র। চুপ করেছিলাম। ম্যাচে আমি একটা বল ফলো করে দারুণ শটে গোল করেছিলাম। ওই এক গোলে জিতে আমরা সেমিফাইনালে পৌঁছেছিলাম। গোলটার পরে আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে ছুটতে শুরু করে দিই। ছুটতে ছুটতে প্রদীপদার মাথার উপর দিয়েই আনন্দে লাফ দিই। এখনও সেই দৃশ্য অনেকের মনে রয়েছে। প্রসূনদার (বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে দেখা হলে এখনও সেই আনন্দ প্রকাশের কথা বলেন।
১৯৮২-র এশিয়ান গেমসের ফাইনাল ট্রায়াল থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। দলে জায়গা না পাওয়ার হতাশায় আমি প্রদীপদাকে বলেছিলাম, ‘‘আপনি আমাকে এ বার বাদ দিলেন। চার বছর পরের এশিয়ান গেমসে আমাকে আর বাদ দিতে পারবেন না।’’
১৯৮৬ সালের এশিয়ান গেমসে আমাকে সত্যিই আর বাদ দিতে পারেননি প্রদীপদা। তার মাঝে অবশ্য অনেক ম্যাচ আমি খেলে ফেলেছি। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের সাফ গেমসে প্রদীপদা আবার জাতীয় দলের কোচ। সে বারের ফাইনালে আমাদের হারাতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। পারলে লোক নেমে চলে আসে মাঠে। টাইব্রেকারে খেলা গড়িয়েছিল। প্রদীপদা বললেন, টাইব্রেকারে প্রথম শটটা মারবে কৃষ্ণেন্দু। আমি গোল করলাম। সে বার সোনা জিতেছিলাম। পেনাল্টি-টাইব্রেকার হলেই প্রদীপদা সবার আগে আমার নাম ডাকবেন এটা একদম নিশ্চিত ছিল। ১৯৯০ সালেও আমার পেনাল্টি থেকে করা গোলে মোহনবাগান কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দেখতে দেখতে এশিয়ান গেমস চলে এল (১৯৮৬)। আমাকে বাদ দিতে পারেননি প্রদীপদা।
১৯৮৭ সালের ডুরান্ড কাপে মোহনবাগান হেরে গিয়েছিল জেসিটি-র কাছে। তখন আমি মোহনবাগানে। কলকাতা বিমানবন্দরে আমাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। মান্নাদা আমাকে পাঠাতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গেই আমি যাই।প্রদীপদা সেবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ। একটা কথা আজ খুব মনে পড়ছে। আর্জেন্তিনার বিশ্বকাপার জুলিয়েন ক্যামিনো সেই বছর এসেছে ইস্টবেঙ্গলে। প্রদীপদাকে একদিন রিপোর্টাররা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ক্যামিনো তো রাইট ব্যাক। কৃষ্ণেন্দু কোথায় খেলবে?’’ প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘‘কৃষ্ণেন্দু ওর নিজের জায়গাতেই খেলবে।’’ প্রদীপদার আমার উপরে অগাধ আস্থা ছিল। আর কোনও ফুটবলার যদি বুঝতে পারেনতাঁর উপরে কোচের আস্থা রয়েছে, তা হলে সেই প্লেয়ার কোচের জন্য নিজের সেরাটাই সব সময় দেয়। প্রদীপদা জানতেন কার থেকে কীভাবে ভাল খেলা আদায় করে নিতে হয়। ডুরান্ড কাপে পরের রাউন্ডে আগেই চলে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের খেলা। সে বার এয়ার ইন্ডিয়া দলে রয়েছে গডফ্রে পেরিরার মতো দ্রুতগামী লেফট উইংগার। আর আমি রাইট ব্যাক। ফলে গডফ্রেকে থামাতেই হতো। ম্যাচের আগেরদিন আমি প্রদীপদার ঘরে গিয়ে বলি, ‘‘আমি কালকের ম্যাচে খেলব না।’’
প্রদীপদা আমাকে বললেন, ‘‘আমি জানি বান্টু বাবু, তুমি কাল খেলবে না। কারণ উল্টোদিকে তো আছে ভারতের সব চেয়ে দ্রুতগামী উইংগার।’’ প্রদীপদার ওই কথা শুনে আমি ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিলাম। আমি প্রদীপদাকে বলি, “আমার নাম লিখে নিন। আমি কাল খেলব।’’
সেই ম্যাচটায় আমরা এয়ার ইন্ডিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ঠোঁট ফেটে গিয়ছিল। সন্ধেবেলা প্রদীপদা নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন আমাকে। আমার হাতে হুইস্কির গ্লাস তুলে দিয়ে বললেন, ‘‘বান্টু বাবু, তুমি এখানে বসে সিপ দিয়ে দিয়ে এটা খাও।’’ ঠোঁটের যে জায়গাটা আমার ফেটে গিয়েছিল, সিপ দিয়ে খেলে তা জুড়ে যাবে। সেই কারণেই প্রদীপদা আমার হাতে হুইস্কির গ্লাস তুলে দিয়েছিলেন। আমি তো লজ্জায় মরে যাচ্ছি তখন।
আমাদের আগলে রাখতেন প্রদীপদা। সবার থেকে সেরাটা বের করে নিতে জানতেন। প্রদীপদা সঙ্গে থাকলে খেলার ভীতিটাই আর থাকত না। হারতে জানতেন না। সেই কারণে শেষ বয়সেও লড়ে গেলেন। প্রদীপদা সঙ্গে আছেন মানেই খেলার অর্ধেক জেতা হয়ে গিয়েছে। প্রদীপদা ফুটবলের একজন প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান আজ আর নেই ভাবতেই পারছি না।