আট দিনের নাটক শেষ! মোহনবাগান কর্তারা যেটা চাইছিলেন, সেটাই করে দেখালেন। জয় হল তাঁদের গোঁয়ার্তুমির!
কলকাতা লিগের ডার্বি না খেলার সিদ্ধান্তেই শেষ পর্যন্ত অটল থাকল সবুজ-মেরুন। যার অর্থ আজ, বুধবার কল্যাণী স্টেডিয়ামে ম্যাচ না খেলেই তিন পয়েন্ট পাচ্ছে মোহনবাগানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল। কোনও বড় অঘটন না ঘটলে টানা সাত বার কলকাতা লিগ ঢুকতে চলেছে লাল-হলুদ তাঁবুতে। কলকাতা লিগে নিজেদের টানা ছয় বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড নিজেরাই ভেঙে দেবে ইস্টবেঙ্গল। ডার্বির তিন পয়েন্ট এবং পরের মহমেডান ম্যাচ থেকে এক পয়েন্ট পেলেই উৎসব শুরু করে দিতে পারবেন মেহতাব, ডং-রা।
মোহনবাগান ডার্বি থেকে সরে দাঁড়ানোয় ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছে, এটা যে তাদের অসংখ্য সদস্য-সমর্থকের মনে কী পরিমাণ জ্বালা ধরাবে, যন্ত্রণা দেবে কেউ-ই ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেবেন না হয়তো বুঝতে পেরেই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাগান সচিব অঞ্জন মিত্রের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, ‘‘আমরা পালিয়ে যাচ্ছি এটা যেন কেউ না ভাবে। ফুটবলাররা একদিনও যে মাঠে প্র্যাকটিস করেনি, সেখানে ওদের ম্যাচ খেলতে বলব কী করে? আইএফএ একদিন ম্যাচ পিছোলেই খেলতাম আমরা।’’
যা শুনে মজা পাচ্ছেন ইস্টবেঙ্গলের শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার। ‘‘ওরা ইউনাইটেড ম্যাচের রেফারির মতো কাউকে খুঁজছে। পেলে দেখতেন, কাল মাঠে নেমে পড়েছে।’’ আর মোহনবাগান বুধবারের ডার্বি খেলবে না চূড়ান্ত জানার পর আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এটা বাংলার ফুটবলের বড় ক্ষতি। পুলিশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে মোহনবাগান যে সব কথা বলছে, তা ঠিক নয়। পুলিশের অনুমতি ছাড়়া টিকিট বিক্রি করা যায় নাকি?’’
বাগান যে ডার্বি নিয়ে ঝামেলা পাকাবে, সেটার ইঙ্গিত মরসুমের শুরু থেকে ছিল। টিভিস্বত্বের টাকা না পেলে ডার্বি-সহ কোনও প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে না বলে হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন ক্লাব কর্তারা। কিন্তু সদস্য-সমর্থকদের কলকাতা লিগ নিয়ে উচ্ছ্বসিত মনোভাব দেখে চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত কর্তারা কল্যাণীতে খেলতে রাজি হয়ে যান। তবে তাঁরা সুযোগ খুঁজছিলেন, কোনও একটা অছিলায় ডার্বি বয়কট করার। ভেস্তে যাওয়া টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচের রিপ্লে চাওয়া, সেই ম্যাচের তারিখ নিয়ে ঝামেলা পাকানো, কল্যাণীর মাঠের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নমালা তৈরি করাটা সেই পথেই হাঁটার নামান্তর বাগানের। ক্লাবের চার শীর্ষকর্তা এ দিন একযোগে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, ‘‘যে মাঠে খেলা সেখানে অন্তত একদিন প্র্যাকটিস না করে ডার্বি খেলতে নামাটা আত্মহত্যার সামিল। সে জন্যই মোহনবাগান ৭ তারিখ খেলবে না।’’
তার পরেও কর্তারা হয়তো আশঙ্কায় ছিলেন, এই যুক্তি কী ভাবে নেবেন সদস্য-সমর্থকরা! সে কারণে এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে অপ্রত্যাশিত ভাবে ঢাল করা হয়েছিল ফুটবল সচিব এবং মোহনবাগানে টানা পনেরো বছর খেলা সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। তিনিও কর্তাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের মাঠের চেয়ে কল্যাণীর মাঠটা চওড়ায় অনেক বড়। ওখানে অন্তত দু’ দিন প্র্যাকটিস না করলে খেলা কঠিন।’’ সত্যজিৎ এটা বলতেই হাততালি দিয়ে ওঠেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট টুটু বসু। বলেন, ‘‘দেখেছেন, টেকনিক্যাল ম্যান কী বলছে? এর পর আর কী বলার আছে!’’
আসলে বাগান কর্তারা ডার্বি বয়কট নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দ্বিধায় ছিলেন। আইএফএ ৭ তারিখ ম্যাচ করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার পর তড়িঘড়ি টুটুবাবুর হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের বাড়িতে সভা করেন বাগানের চার শীর্ষকর্তা। সূত্রের খবর, সেখানে তীব্র মতভেদ হয় ডার্বি বয়কট নিয়ে। এক শীর্ষকর্তা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আমাদের সময় কখনও ডার্বি না খেলে পালিয়ে যাইনি। ম্যাচ বয়কট করলে আমাদের গায়েই কালি লাগবে।’’ বাকিরা পাল্টা বলেন, ‘‘একদিনও প্র্যাকটিস না করে খেলে কোনও বড় অঘটন ঘটলে তার দায় নেবে কে?’’ শেষ পর্যন্ত ক্লাব প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ঠিক হয়, বলা হবে—আমরা খেলতে চাই। তবে অন্তত এক দিন প্র্যাকটিসের জন্য দিতে হবে। রাতে তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়ের অনুরোধেও মোহনবাগান সিদ্ধান্ত বদল করেনি।
এক সবুজ-মেরুন কর্তা বলছিলেন, ‘‘এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। আমরা তো খেলতেই চাইছি, এটা যেমন সমর্থকদের বোঝানো যাবে তেমনই আইএফএ-র চক্রান্তও রোখা যাবে।’’ সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে এর আগে বাগান কোন মরসুমে কোন কলকাতা ডার্বি বয়কট করেছে তা ছাপিয়ে বিলি করা হয়।
তবে ডার্বি না খেললেও অবনমনের হাত থেকে বাঁচতে লিগের বাকি তিনটে ম্যাচ খেলবে মোহনবাগান। না হলে সব মিলিয়ে যা পয়েন্ট হারাবে বাগান তাতে তারা অবনমনে পড়ে যাবে। ৭ সেপ্টেম্বর ডার্বিতে ‘নামব না’-র চিঠি সরকারি ভাবে এ দিন রাত পর্যন্ত বাগানের তরফে আসেনি আইএফএ-তে। সময় মতো চিঠি না দিলে বাগান তিন পয়েন্ট তো হারাবেই, সেই সঙ্গে তাদের কাটা যাবে আরও দুই পয়েন্ট।
সোজা কথা, ইগোর লড়াইয়ে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে প্রায় রেকর্ড লিগ তুলে দেওয়ার পর বাগানে আপাতত অন্ধকার!