Diego Maradona

এক বিস্ময় প্রতিভা, চিরকালের বিতর্কিত

ছোটবেলা থেকেই তাঁর বিস্ময় প্রতিভা দেখাতে শুরু করেছিলেন মারাদোনা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৪৩
Share:

বিতর্কিত: ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার সেই বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’। ফাইল চিত্র

অসামান্য, কিংবদন্তি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই ফুটবলারের এক জন, বিরলতম প্রতিভা, সদা বিতর্কিত। ফুটবল আকাশে এমন চরিত্রের উদয় খুব কমই দেখা গিয়েছে। দিয়েগো মারাদোনাকে এ ভাবেই হয়তো ক্রীড়া দুনিয়া মনে রাখবে।

Advertisement

বুয়েনস আইরেসে ৬০ বছর আগে জন্ম। শৈশবের দারিদ্রের অভিশাপ কাটিয়ে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। তিনি চলে গেলেও থেকে যাবে সেই অনন্তকালের তর্ক— কে বড় ফুটবলার? পেলে না মারাদোনা? কেউ কেউ মনে করেন, মারাদোনাই বড়। ৪৯১ ম্যাচ খেলে ২৫৯ গোল করা আর্জেন্টিনীয় এক বার জনতার ভোটে হারিয়েও দিয়েছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তিকে। বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের ভোটাভুটিতে মারাদোনার কাছে হার মেনেছিলেন পেলেও। কিন্তু ফিফা দু’জনকেই সম্মানিত করে।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর বিস্ময় প্রতিভা দেখাতে শুরু করেছিলেন মারাদোনা। শৈশবের দল লস সেবোলিটাসকে টানা ১৩৮টি ম্যাচে অপরাজিত রেখেছিলেন। অবিশ্বাস্য! শব্দটা তখন থেকেই মারাদোনার নামের পাশে বসতে শুরু করে। আর থেকে যায় সারা ফুটবলজীবন জুড়েই। মাত্র ১৬ বছর ১২০ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে অভিষেক ঘটে তাঁর। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা হলেও শক্তিশালী শরীরের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে অবর্ণনীয় শিল্প মিশে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল বিশ্বের সব ডিফেন্ডারের সামনে। স্কিল, ড্রিবল, ক্ষিপ্রতা, অসাধারণ বল কন্ট্রোল, দুরন্ত পাসিং— কী ছিল না তাঁর! এত সব গুণের জন্য সহজেই ঢেকে দিতে পারতেন নিয়ন্ত্রণহীন জীবনের জেরে ওজন বাড়িয়ে ফেলার অভ্যাস। এই বেহিসেবি জীবনযাপনের জন্যই বিশ্বের সব তাবড় ডিফেন্ডারদের হারিয়েও বিতর্কের বলয় থেকে কখনও নিষ্কৃতি পাননি তিনি। শেষবেলাতেও সেই মাদক আসক্তিই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াল।

Advertisement

আরও পড়ুন: কলকাতা দেখে মারাদোনার মনে পড়েছিল নাপোলির রাত

আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল করেছেন মারাদোনা। কিন্তু নিছক সংখ্যার বিচারে তাঁর প্রভাব যাচাই করা যাবে না। ১৯৮৬-তে কার্যত একার কৃতিত্বে মেক্সিকোতে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন দেশকে। চার বছর পরে ফাইনালে তুলেও পারেননি ফের কাপ জিততে।

ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাঁর সেই ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ক্রীড়া দুনিয়ার অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে। এমনিতেই ম্যাচের আগে ফকল্যান্ড যুদ্ধ ঘিরে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ছিল। তার উপরে মারাদোনার বিতর্কিত গোল কাটা ঘায়ের উপর নুনের ছিটে দিয়ে যায়। ম্যাচের ৫১ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের মাথার উপরে লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতের ব্যবহারে গোল করে যান মারাদোনা। ম্যাচের পরে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘কিছুটা মারাদোনার মাথা আর কিছুটা ঈশ্বরের হাত মিশিয়ে গোলটা হয়েছিল।’’ তার পরেই নামকরণ হয়ে যায় ‘হ্যান্ড অব গড গোল’।

আরও পড়ুন: আমার হেড আর হ্যান্ড অব গডেই গোল, বলেছিলেন মারাদোনা

কিন্তু তিনি যে দিয়েগো মারাদোনা। ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে থিয়েটার শেষ হবে কী করে? চার মিনিট পরেই ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘বিস্ময় গোল’ উপহার দিলেন তিনি। নিজেদের অর্ধে বল ধরে স্বপ্নের দৌড়ে একের পর এক ইংরেজ ফুটবলারকে ধরাশায়ী করে শিলটনকে হারিয়ে গোল করেন তিনি। সেই সময়ে ধারাভাষ্যকার বলে ওঠেন, ‘‘নিজেদের চোখে অলৌকিক দেখলাম আমরা। এমন অবিশ্বাস্য গোলও হয়, কে ভাবতে পেরেছিল!’’

ইংল্যান্ডকে অমন বিতর্কিত পারফরম্যান্সে হারানোর পরেও থেমে থাকেননি। বলেছিলেন, ‘‘শুধু ম্যাচ জিতেছি, তা-ই নয়। ইংরেজদের পর্যুদস্ত করার উৎসব ছিল আমাদের।’’ মেসি, রোনাল্ডো বা নেমারদের রেকর্ড অর্থে সইসাবুদের মধ্যে ভুলে যাওয়া যাবে না যে, দু’বার মারাদোনা ফুটবল বিশ্বের ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙেছিলেন। ১৯৮২-তে বোকা জুনিয়র্স ছেড়ে যখন তিনি বার্সেলোনায় যান আর দু’বছর পরে ইটালির ক্লাব নাপোলিতে সই করেন।

আরও পড়ুন: একই ম্যাচে নিন্দিত ও প্রশংসিত, ফুটবলার হিসাবে যতটা সফল কোচিংয়ে ততটাই ব্যর্থ রাজপুত্র

নাপোলিতে যে দিন তিনি হেলিকপ্টারে করে পৌঁছলেন, আশি হাজার ভক্ত হাজির ছিল স্বাগত জানাতে। পেলের যেমন ছিল কসমস, তেমনই মারাদোনার নাপোলি। ইটালিতেই তিনি ক্লাব জীবনের সেরা ফুটবল খেলেন। ১৯৮৭ এবং ১৯৯০-তে তিনি ইটালি লিগে চ্যাম্পিয়ন করেন নাপোলিকে। ১৯৮৯-তে জেতেন উয়েফা কাপ। প্রথম বার ইটালীয় লিগ জয়ের উৎসব নাপোলিতে চলেছিল পাঁচ দিন ধরে। বাঁধনহারা ভালবাসা সব সময় অপেক্ষা করে থেকেছে ইটালির শহরে তাঁর জন্য। এক বার বলেও ফেলেছিলেন, ‘‘নাপোলি শহরটা দারুণ। কিন্তু অন্যদের মতো আমিও খোলা মনে ঘুরে বেড়াতে চাই।’’

নাপোলি-উত্তর জীবনেই মাদক আসক্তি এবং অসংযমী জীবনযাপনও ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে। একটি ক্রাইম সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়, কোকেন বিতর্ক এসে পড়ে এবং পিতৃত্ব নিয়ে আইনি পদক্ষেপের মুখে পড়েন। ১৯৯০-তে ইটালি বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে ০-১ হার। পরের বছরে ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিত হলেন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে আমেরিকায় ফিরে ক্যামেরার সামনে এসে সেই আগ্রাসী উৎসব। কিন্তু মাঝপথেই বহিষ্কৃত হন এফিড্রিন নামক নিষিদ্ধ দ্রব্য নেওয়ার কারণে। ডোপ পরীক্ষায় তৃতীয় বার ‘পজিটিভ’ হওয়ার পরে ৩৭তম জন্মদিনে অবসর নেন মারাদোনা। কিন্তু থেমে থাকেনি বিতর্ক। সাংবাদিককে লক্ষ্য করে এয়ার রাইফেল দিয়ে গুলি করা। বার বার কোকেন এবং মদ্যপানের আসক্তির জন্য খবরের শিরোনামে আসা। ২০০৪-এ হৃদরোগেও আক্রান্ত হন। এর পরেও ২০০৮ সালে তিনি লিয়োনেল মেসিদের আর্জেন্টিনা দলের ম্যানেজার হন। ফিদেল কাস্ত্রোর বিশেষ বন্ধু। পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ। দিয়েগো মারাদোনা মানে সব সময়ই দু’টো চরিত্র মিলেমিশে একাকার। এক জন ফুটবল মাঠে সেরা বিনোদন উপহার দেবে। অন্য জন সদা বিতর্কিত!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement