বাহাত্তর ঘণ্টা পর ছাব্বিশে পা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। দিনকয়েকের মধ্যে ব্যাগি গ্রিন পরে ব্রিসবেন টেস্টে নামার কথাও হয়তো ছিল। তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আলো দেখছিল একটা গোটা ভূখণ্ড। বলছিল, টেস্ট দলে ছেলেটার জায়গা পাকা হয়নি তো কী, এখনও অনেক সময় আছে ওর হাতে। এত ক্রিকেট খেলছে ওর দেশ, ঘরোয়া ক্রিকেটে এত রান করে যাচ্ছে ছেলেটা, এখনও কত সময় আছে ওর হাতে।
পঁচিশ বছর তিনশো বাষট্টি দিন— নিয়তি যে তাঁর জন্য এটুকু সময়ই বরাদ্দ রেখেছিল, কে জানত।
শন অ্যাবটের বাউন্সারের মারণ আঘাত থেকে সেরে উঠতে পারলেন না ফিলিপ জোয়েল হিউজ। দু’দিন আগে ক্রিজে যে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, তার পর তা আর ফিরে পাননি। মঙ্গলবার ৬৩ রানে ব্যাট করছিলেন হিউজ। ওই স্কোরেই চিরকালের জন্য অপরাজিত থেকে গেলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে এক বিবৃতিতে তাঁর অকালমৃত্যু ঘোষণা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। টিম ডাক্তার পিটার ব্রুকনার বলেন, “মৃত্যুর আগে কোনও রকম যন্ত্রণা পায়নি হিউজ। ওর পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওর পাশে ছিল।” হিউজের টিমমেট, কোচ, বন্ধুবান্ধব দু’দিন ধরেই সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে যাওয়া-আসা করছিলেন। মাইকেল ক্লার্ক তাঁর খুব কাছের বন্ধু। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত হিউজের পাশে ছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরেই আবার হাসপাতালে চলে আসেন। তখনও বোধহয় জানতেন না, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই কোনও মতে কান্না চেপে তরুণ সতীর্থের মৃত্যুসংবাদ দিতে হবে গোটা বিশ্বকে।
তরুণ, প্রতিভাবান এই তারকার মৃত্যুতে থমকে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, ক্রিকেটবিশ্বও। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দেশের পতাকা অর্ধনমিত। লর্ডসের গেটের বাইরে ফুলের তোড়া। শারজার স্কোরবোর্ডে ‘বিদায় হিউজ’। ক্রিকেটবিশ্বের যদি কোনও পতাকা থাকত, নিঃসন্দেহে আজ সেটাও অর্ধেক নামিয়ে দেওয়া হত। পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড টেস্টে এ দিনের খেলা বাতিল করে দেওয়া হয়। শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ বুধবারই বাতিল হয়ে গিয়েছে। এ দিন তার সঙ্গে যোগ হল গ্রেড এবং ক্লাব ক্রিকেটের ম্যাচও। ভারতের প্র্যাকটিস ম্যাচ হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। এমনকী বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ওই টেস্ট টিমের চার সদস্য সিডনিতে হিউজ-দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মনে করা হচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যে একটা টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার মানসিক অবস্থায় থাকা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। প্রাক্তন অধিনায়ক অ্যালান বর্ডার মনে করেন, প্রথম টেস্ট নির্ধারিত সময়েই শুরু হোক। “কিন্তু যারা খেলতে চায় না, তারা যেন সেই বিকল্পটা পায়,” বলছেন তিনি। শোনা যাচ্ছে ম্যাচটা বাতিলও হয়ে যেতে পারে। অস্ট্রেলীয় গ্রীষ্মের ঠাসা সূচিতে ম্যাচ পিছনো অসম্ভব। সিরিজের সম্প্রসারণ স্বত্ব যাদের, সেই চ্যানেল নাইন ম্যাচ বাতিল করার পক্ষে নয়। কিন্তু এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে অস্ট্রেলীয় বোর্ড। ভারতীয় শিবিরেরও এই ব্যাপারে মতামত রাখার জায়গা নেই। টিম ম্যানেজমেন্টের এক সদস্য জানালেন, শোকের এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলীয় বোর্ডের পাশেই দাঁড়াবেন তাঁরা। এ দিন সন্ধে পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে হিউজ পরিবার তাঁর শেষকৃত্যের দিন ঠিক করার আগে প্রথম টেস্ট নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
দুঃসংবাদটা যখন বিরাট কোহলিরা পান, তখন টিম ইন্ডিয়া অ্যাডিলেড ওভালে প্র্যাকটিসে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ম আপ থামিয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন কোহলিরা। ছিলেন টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীও। অ্যাডিলেড ওভালের বিশাল স্কোরবোর্ডে তখন ভেসে উঠেছে ‘বিদায় ফিল হিউজ’। মাঠকর্মীরা অনেকেই কান্না চেপে রাখতে পারেননি। যে টিমের হয়ে খেলতে নেমে প্রাণ হারালেন হিউজ, সেই সাউথ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সংস্থার মুখ্যকর্তা কিথ ব্র্যাডশ দুপুরের দিকে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। হিউজের প্রতিভা, তাঁর জনপ্রিয়তা, তাঁর শান্তশিষ্ট স্বভাব নিয়ে বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনিও।
শন অ্যাবট? হিউজকে শেষ বারের মতো দেখে বেরনোর সময় তাঁর চোখও তো শুকনো ছিল না। ব্র্যাড হাডিন, স্টিভ স্মিথ, শেন ওয়াটসন, ডেভিড ওয়ার্নার, নাথান লিয়ঁ, মোয়েস এনরিকে, মিচেল স্টার্ক, রিকি পন্টিং, সাইমন কাটিচ, ব্রেট লি— সবাই ছিলেন হাসপাতালে। তরুণ সতীর্থকে শেষ বার দেখার জন্য অন্যান্য শহর থেকে উড়ে এসেছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ, ম্যাথু ওয়েড, পিটার সিডল, জর্জ বেইলি, এড কাওয়ান, জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ছিলেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সিইও জেমস সাদারল্যান্ড সহ অন্যান্য বোর্ড কর্তারা। ছিলেন অস্ট্রেলীয় কোচ ডারেন লেম্যান। যিনি ডান-হাতি ব্যাটসম্যান পছন্দ করেন বলে বাঁ-হাতি হিউজ টেস্ট টিমে ইদানীং সুযোগ পেতেন না।
তবু হাল ছাড়েননি হিউজ। “এখনকার মতো স্কোয়াডে থাকলেই চলবে। খেলি বা না খেলি, স্কোয়াডে থাকলেই আমি খুশি। দরকারে টিমমেটদের সাহায্য করতে পারি। এখানে কী হল না হল, সেটা নিয়ে কিছু যায়-আসে না। খুব দূরের কথা ভাবছিও না। আমি চাই ধারাবাহিক হতে। আর এক বার সুযোগ পেলে চেষ্টা করব যতটা সম্ভব ধারাবাহিক হওয়ার,” এ বছরের শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বলেছিলেন হিউজ। অস্ট্রেলিয়া ‘এ’-র হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তার পরপরই দুটো ডাবল সেঞ্চুরি। আমিরশাহিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্টে ক্রিস রজার্সের জায়গায় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে নির্বাচকদের মনে হয়, এখন থাক। রজার্স আর ক’বছরই বা খেলবে। ও বরং এটা খেলুক। হিউজের সামনে তো গোটা কেরিয়ারটাই পড়ে আছে। তার চেয়ে ওকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা হোক।
সত্যি, টেস্ট কেরিয়ারে আরও অনেক বছর বাকি ছিল হিউজের। তার আগেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, অবসরের পরের জীবনটা কেমন হবে। স্বপ্নটা সামান্য— সিডনি আর ব্রিসবেনের মাঝামাঝি অবস্থিত তাঁর জন্মভূমি ম্যাক্সভিলে ফেরা। ঘরে ফিরে বাবার সঙ্গে কাজ করা। ঘোড়া প্রতিপালন করা। ঘোড়া খুব ভালবাসতেন হিউজ।
একটু তাড়াতাড়িই ম্যাক্সভিল ফিরতে হচ্ছে হিউজকে। আগামী সপ্তাহের কোনও একটা দিন সেখানেই তাঁর শ্রাদ্ধবাসর।
ছবি: গেটি ইমেজেস
বোর্ড ঠিক করুক প্রথম টেস্ট হবে কি না: গাওস্কর
নিজস্ব প্রতিবেদন
ব্রিসবেনে সিরিজ শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে সিডনিতে হিউজ-ট্র্যাজেডি ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট হওয়া নিয়েই সংশয় তৈরি করছে সুনীল গাওস্করের মনে! কিংবদন্তি প্রাক্তন ভারতীয় ওপেনারের মনে এই মুহূর্তে খচখচানি— হিউজের মর্মান্তিক মৃত্যুতে অস্ট্রেলিয়া-ভারত, দু’দলের ক্রিকেটাররাই হয়তো টেস্ট খেলার মতো নিখুঁত মানসিকতায় থাকতে পারবে না। এই অবস্থায় গাওস্করের পরামর্শ— গাব্বায় ৪ ডিসেম্বর শুরু হতে চলা প্রথম টেস্ট নির্ধারিত সময়ে হবে, না কি ম্যাচটা বাতিল করা হবে সে ব্যাপারে এখন দু’দেশের ক্রিকেট বোর্ড যেন ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়।
“পরিস্থিতিটা সত্যিই কঠিন। প্রথম টেস্ট আর মাত্র সাত দিন দূরে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কেউ এখন খেলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই,” এ দিন এক সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলকে বলেছেন গাওস্কর। সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন, “দুর্ঘটনার দিন হিউজকে মাঠ থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেই নিউ সাউথ ওয়েলস-সাউথ অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই আমি মনে করি, হিউজের মর্মান্তিক মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ পরে ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট খেলা উচিত, না কি এটাও বাতিল করা ঠিক সে ব্যাপারে দু’দেশের বোর্ডই ভেবে ঠিক করুক।”