(বাঁ দিকে) বেন স্টোকস ও বিরাট কোহলি। —ফাইল চিত্র
বেন স্টোকস, জো রুটরা গত এক বছর ধরে টেস্টে যে ক্রিকেট খেলছেন সেটা কি খেলতে পারবেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মারা! ভারতীয় ক্রিকেটাররা কি ইংল্যান্ডের ‘বাজ়বল’ আয়ত্ত্ব করতে পারবেন! পর পর দু’বার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হারের পরে খেলার ধরনে কি বদল করার প্রয়োজন রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটে? এই প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঠিক কোন ক্রিকেটটা খেলছে ইংল্যান্ড? সেই ক্রিকেটের একটাই মন্ত্র, আক্রমণ। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে হবে। ব্যাট করতে নামলে যত দ্রুত সম্ভব রান করার চেষ্টা করতে হবে। টেস্টের ধ্রুপদী ব্যাটিং করলে চলবে না। আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে উইকেট পড়লেও কুছ পরোয়া নেই। আবার বল করার সময় উইকেটের জন্য ঝাঁপাতে হবে। যেখানে উইকেট থেকে বোলাররা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন না, সেখানে ফিল্ডিং পরিকল্পনায় বদল করে উইকেট তুলতে হবে। মোদ্দা কথা, ম্যাচ জিততেই হবে। হার বা ড্র করার কথা ভাবাই যাবে না।
ইংল্যান্ডের কোচ হিসাবে ব্রেন্ডন ম্যাকালাম ও অধিনায়ক হিসাবে স্টোকস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বদলে গিয়েছে তাদের ক্রিকেটের ধরন। টেস্টের সংজ্ঞাটাই বদলে দিতে চাইছেন তাঁরা। সুনীল গাওস্কর ঘরানা থেকে বীরেন্দ্র সহবাগ ঘরানায় চলে গিয়েছে ইংল্যান্ড। ব্যাট করতে নামুক বা বল, শুরু থেকে আক্রমণের পথে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। তার ফলও মিলেছে। নতুন জমানায় ১৪টি টেস্টের মধ্যে ১১টি জিতেছেন স্টোকসরা। এই ১৪টি টেস্টের ২৮টি ইনিংসে মাত্র এক বারই প্রতিপক্ষকে অলআউট করতে পারেনি ইংল্যান্ডের বোলাররা। সেটি বার্মিংহ্যামে মঙ্গলবারের ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেট থাকতে ম্যাচ জিতে গিয়েছে। যদি স্টুয়ার্ট ব্রডের বলে নেথান লায়নের ক্যাচ স্টোকস না ফস্কাতেন তা হলে সেই রেকর্ড বোধ হয় ভাঙত না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের ক্রিকেট কি ভারতীয় ক্রিকেটাররা খেলতে পারবেন?
২০২২ সালের শুরু থেকে ভারত মোট ১১টি টেস্ট খেলেছে। তার মধ্যে ছ’টি টেস্ট ভারত জিতেছে। চারটি হেরেছে। একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। এই ১১টি টেস্টের মধ্যে দেশের মাটিতে হয়েছে ছ’টি টেস্ট। তার মধ্যে চারটি টেস্টে জিতেছে ভারত। একটি হেরেছে। একটি ড্র হয়েছে। বিদেশে খেলা পাঁচটি টেস্টের মধ্যে ভারত হেরেছে তিনটি। জিতেছে দু’টি।
এ তো গেল, হার-জিতের পরিসংখ্যান। বাজ়বল আসলে খেলার ধরন। ভারতের ব্যাটিং লাইন আপে দ্রুত রান তোলার ক্রিকেটার নেই, তা নয়। বিশেষ করে আইপিএলে খেলায় শুভমন গিল, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা দ্রুত রান করতে পারেন। তবে শুধু দ্রুত রান করলেই হবে না, বদলাতে হবে মানসিকতাও। উইকেটের ভয় পেয়ে খেললে চলবে না। প্রতিপক্ষকে পিছনে ঠেলতে হবে। তার জন্য দরকার আগ্রাসন। আর এই আগ্রাসন শুধু একটি সেশনে নয়, গোটা ম্যাচ ধরে দেখাতে হবে।
অনেকের মতে, ভারতে এখন যে ধরনের পিচ হচ্ছে তাতে বাজ়বল খেলা এক কথায় অসম্ভব। শেষ কয়েক বছরে ভারতের মাটিতে ক’টি টেস্ট শেষ দিন পর্যন্ত গড়িয়েছে, তা হাতে গোনা যাবে। তার কারণ, ঘূর্ণি উইকেট। দেশের মাটিতে এখন যে উইকেট তৈরি হয় তাতে প্রথম দিনের প্রথম সেশন থেকে বল ঘোরে। কেউ কেউ মনে করেন, এই ধরনের পিচে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলা কার্যত অসম্ভব। আগে বিদেশি ব্যাটাররা ভারতে ব্যাট করতে সমস্যায় পড়তেন। কিন্তু এখন ভারতীয় ক্রিকেটাররাও সেই সমস্যায় পড়েন। অস্ট্রেলিয়ার মতো পেসার নির্ভর দলও ভারতে মাত্র এক পেসার নিয়ে খেলতে নামে। প্রতিটি টেস্টের পরে পিচ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। ইংল্যান্ড কিন্তু বাজ়বল ক্রিকেট শুরু করার পর থেকে সে দেশের পিচের চরিত্রে কিছুটা বদল করেছে। এখন আর সারা দিন ধরে সুইং হয় না। ব্যাটিংয়ের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠেছে পিচ। তাই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা যাচ্ছে। ভারতের ঘূর্ণি উইকেটে সেটা কী ভাবে হবে?
কোন দল কী পরিকল্পনায় ক্রিকেট খেলবে সেটা নির্ভর করে সেই দলের কোচ ও অধিনায়কের উপর। স্টোকস ও ম্যাকালামের পরিকল্পনাতেই বাজ়বল খেলছে ইংল্যান্ড। ভারতের বর্তমান কোচ রাহুল দ্রাবিড় অনেক বেশি রক্ষণাত্মক মানসিকতার। খেলোয়াড় জীবনেও খুব একটা আগ্রাসী ক্রিকেট তিনি খেলতেন না। ধৈর্য ধরে বল দেখে খেলতেন। দলকে সেই পরিকল্পনাতেই চালাতে চান তিনি। অধিনায়ক রোহিতও সেই পরিকল্পনায় বিশেষ বদল চান বলে মনে হয় না। কারণ, বাজ়বল খেলতে গেলে গোটা দলকে একই ছন্দে খেলতে হয়। দলের এক জনের মানসিকতা যদি অন্য রকম হয় তা হলে হবে না। সেই কারণেই জো রুটও নিজের খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন। কিন্তু ভারতীয় দলের সব ক্রিকেটার একই ছন্দে খেলেন না। সবার খেলার ধরন আলাদা। তাই এই দলের বাজ়বল খেলা সহজ নয়।
ভারতীয় ক্রিকেটে বাজ়বল আমদানি করা যাবে না বলেই মনে করেন গত মরসুমে রঞ্জিতে বাংলার অধিনায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, ‘‘এখানে বাজ়বল খেলা যাবে না। কারণ, বাজ়বল খেলার তেমন ক্রিকেটার নেই। একমাত্র সূর্যকুমার যাদবের খেলার ধরন কিছুটা ও রকম। কিন্তু ভারতে ঘরোয়া স্তর থেকে ক্রিকেট অন্য ভাবে শেখানো হয়। মানসিকতা আলাদা থাকে। তাই ভারত কখনও বাজ়বল খেলবে না।’’
একই কথা বলেছেন বাংলার আর এক ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘বাজ়বলের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। ভারতের ঘূর্ণি উইকেটে কী ভাবে ওই ক্রিকেট খেলা যাবে? তা হলে তো এক দিনেই খেলা শেষ হয়ে যাবে। ইংল্যান্ড এখন ব্যাটিং সহায়ক উইকেট হচ্ছে। তাই ওরা খেলতে পারছে।’’ এ ছাড়া বাজ়বলের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনুষ্টুপ। তিনি বলেছেন, ‘‘ইংল্যান্ড সবে এক বছর ধরে বাজ়বল খেলছে। কিন্তু টেস্ট যুগের পর যুগ ধরে চলছে। প্রত্যেকটা খেলার একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। কেউ আলাদা কিছু করার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু ফল না পেলেই আবার নিজেদের পরিকল্পনা বদলে ফেলতে বাধ্য হবে ইংল্যান্ড। বাজ়বল কত দিন চলবে সেটা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে।’’