সৌরভ-কোহলী বিতর্ক। —ফাইল চিত্র
প্রশ্ন: টি২০ ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া, এক দিনের ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছাড়তে না চাওয়া নিয়ে কী বলবেন?
কোহলী: গোটাটাই অতীত। এখন এগুলো নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। সামনে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কঠিন সিরিজ। আমাদের সবার উচিত শুধু সে দিকে তাকানো।
প্রত্যাশিত এই প্রশ্নের এমন প্রত্যাশিত উত্তর দিতেই পারতেন। এড়িয়ে যেতে পারতেন যাবতীয় বিতর্ক। কিন্তু তিনি বিরাট কোহলী। মাঠের আগ্রাসন মাঠের বাইরে নিয়ে এসে পরিস্থিতি অভূতপূর্ব জটিল করে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে। খোদ বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে অসত্যবাদী প্রতিপন্ন করলেন।
বুধবারের ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকে কোহলীর একের পর এক জবাব দেওয়া দেখে প্রশ্ন উঠছে, তিনি কি তৈরি হয়েই এসেছিলেন? ঠিকই করে রেখেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার আগে প্রথামাফিক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথা ভেঙে সব উগরে দেবেন?
অন্তত দু’বার কোহলী প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বোর্ড সভাপতি অসত্য বলেছেন। প্রথমত, টি২০ ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছাড়া নিয়ে কোহলী বলেছেন, ‘‘বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছিল। বিসিসিআই-কে জানিয়েছিলাম টি২০ অধিনায়কত্ব ছাড়তে চাই। ওরা সেটা মেনে নেয়। সেখানে বোর্ডের তরফ থেকে কোনও আপত্তি ছিল না। বরং আমাকে বলা হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের কথা ভেবে এটা খুবই ইতিবাচক একটা পদক্ষেপ। সেই সময়েই জানিয়েছিলাম টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করব। আমার দিক থেকে আমি পরিষ্কার ছিলাম। কিন্তু বোর্ডের কর্তা এবং নির্বাচকরা বোধহয় তেমনটা ভাবেননি। তাঁরা মনে করেছেন এক দিনের ক্রিকেটে আমার অধিনায়কত্ব করার প্রয়োজন নেই। আমি সেটা মেনে নিয়েছি।’’
এই প্রসঙ্গে সৌরভ গত কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোহলীকে অনুরোধ করেছিলাম টি২০ অধিনায়কত্ব না ছাড়তে। কিন্তু ওর মনে হয়েছে ওর উপর চাপ পড়ছে। ঠিক আছে। ও একজন দারুণ ক্রিকেটার। নিজের খেলা নিয়ে খুবই আগ্রহী। দীর্ঘ সময় ধরে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমি নিজেও ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছি। ফলে এই চাপ কতটা, সেটা আমি জানি।’’
দ্বিতীয়ত, এক দিনের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব চলে যাওয়া নিয়ে কোহলী বলেন, ‘‘বিসিসিআই-এর সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। টেস্ট দল নির্বাচনের দেড় ঘণ্টা আগে আমাকে ফোন করেন নির্বাচকরা। ফোন ছাড়ার আগে পাঁচ নির্বাচক আমাকে জানান, আমি আর এক দিনের দলের অধিনায়ক থাকছি না। উত্তরে আমি বলি, ঠিক আছে।’’
যা নিয়ে গত কয়েক দিনে সৌরভের বক্তব্য ছিল, একদিনের ক্রিকেটে যে তাঁকে আর অধিনায়ক রাখা হবে না, সেটা তিনি নিজে কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কোহলীকে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। কোহলী তা মেনেও নিয়েছেন।
বুধবার দুপুরের পর পরিষ্কার, দু’জনের মধ্যে যে কোনও একজন সত্যি বলছেন।
একজন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ক। আর একজন বর্তমান। দু’জনেই ভারতীয় ক্রিকেটকে দেশে-বিদেশে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। দু’জনেই প্রায় সাড়ে চারশো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। একজনের আন্তর্জাতিক রান সাড়ে ১৮ হাজারের উপর। আর একজনের ২৩ হাজারের উপর। এ হেন দু’জনের কারওরই অসত্যবাদী প্রতিপন্ন হওয়া কাঙ্খিত নয়। কে সত্যি বলছেন, কে মিথ্যা বলছেন, কে সত্যি গোপন করছেন, এখন এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছে। যত তা করার চেষ্টা হবে, তত দু’জনের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সেই সঙ্গে নষ্ট হবে ভারতীয় ক্রিকেটের ভাবমূর্তিও। ম্যাচ গড়াপেটায় বিধ্বস্ত ভারতীয় ক্রিকেটের ভাবমূর্তি সৌরভের হাত ধরেই ফিরেছিল। সচিন তেন্ডুলকরের অবসরের পর ভারতীয় ক্রিকেট যখন সামনে রেখে এগনোর মতো একজনকে খুঁজছিল, তখনই কোহলীর আবির্ভাব। সেই সৌরভ-কোহলীর সমীকরণ নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সন্দেহ তৈরি হওয়াটা ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে বিপজ্জনক বিজ্ঞাপন।
ইতিমধ্যেই দু’জনের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। সৌরভ-বিরোধীরা বলছেন, তাঁর এবং ভারতীয় বোর্ডের উচিত ছিল, গোটা ব্যাপারটা আরও ভাল করে সামলানো। একটা বি়জ্ঞপ্তি জারি করলেই ব্যাপারটা মিটে যেত। যেমন সুনীল গাওস্কর মনে করছেন, সৌরভের উচিত এই ‘অস্বচ্ছতা’ দূর করে মুখ খোলা এবং সবার সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা।
আবার কোহলী-বিরোধীদের বক্তব্য, যেখানে বিতর্ক অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া যেত, সেখানে কোহলী যে ভাবে বক্তব্য শানিয়েছেন, তা পরিকল্পিত। তাঁরা বলছেন, এমনিতেই তাঁর অধিনায়কত্বের ধরন, সাজঘরে ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু ক্রিকেটারের আপত্তি রয়েছে। বোর্ডের দফতরে অভিযোগও জমা পড়েছে। নিজের যে মানসিকতার পরিচয় দিলেন কোহলী, তাতে সাজঘরের ঘটলাগুলিও আর নিছক গল্প থাকছে না।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ম্যাচ গড়াপেটা থেকে অতি কষ্টে নিষ্কৃতি পাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটে কি নতুন অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে গেল?