Afghanistan Cricket

আফগানদের জয় আর অঘটন নয়! গোলাগুলি, ভূমিকম্পের মাঝেও তালিবানের দেশ বেঁচে আছে ক্রিকেটেই

টেস্ট খেলিয়ে দেশের বিরুদ্ধে জয় তুলে নিয়ে রশিদেরা ইতিমধ্যেই ‘অঘটন’ ঘটিয়েছেন। যদিও এক কাজ বার বার করার পর আর আফগানিস্তানের জয়কে ‘অঘটন’ বলা উচিত হবে কি না সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তাঁরা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:০৪
Share:

বিশ্বকাপের মঞ্চে দাপট দেখাচ্ছেন রশিদ খানেরা। ছবি: পিটিআই।

দু’বছর আগে আফগানিস্তান নামটা শুনলেই উঠে আসত তালিবানের কথা। গোটা দেশের উপর শাসন কায়েম করতে তখন চারিদিকে গুলির আওয়াজ। তার মাঝে ব্যাট, বলের শব্দ শোনার কথাই ভাবা যেত না। কিন্তু ক্রিকেট বেঁচে ছিল আফগানিস্তানে। তা না হলে এখন বিশ্বকাপের মঞ্চে তারা গোটা বিশ্বকে তাদের ব্যাট, বলের শব্দ শোনাতে পারত না।

Advertisement

ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এ বারের বিশ্বকাপে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে আফগানিস্তান। এর আগে এক দিনের বিশ্বকাপে রশিদদের জয়ের সংখ্যা ছিল এক। তিনটি টেস্ট খেলিয়ে দেশকে ইতিমধ্যেই হারিয়ে দিয়েছে আফগানিস্তান। যে সব দেশে ঘরোয়া ক্রিকেট রয়েছে, নিয়মিত ক্রিকেট খেলার সুযোগ রয়েছে, সেই সব দেশের বিরুদ্ধে জয় তুলে নিয়ে রশিদেরা ইতিমধ্যেই ‘অঘটন’ ঘটিয়েছেন। যদিও এক কাজ বার বার করার পর আর আফগানিস্তানের জয়কে ‘অঘটন’ বলা উচিত হবে কি না সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের শান্ত হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না, এগুলো অঘটন। এ যেন হওয়ারই ছিল। আফগানরা জেতার জন্যই বুঝি নেমেছেন।

রশিদেরা নিজেদের দেশের মাটিতে খেলতে পারেন না। যে দেশে পরের দিনের সূর্য দেখতে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ক্রিকেট খেলা সত্যিই অবাস্তব। তাই রশিদেরা এখনও জানেন না ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সময় সমর্থকদের চিৎকার কেমন হয়। ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে এসে দিল্লির মাটিতে কিছুটা সমর্থন পেয়েছিলেন আফগানেরা। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে।

Advertisement

আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সদর দফতর তালিবদের দখলে। ছবি: পিটিআই।

আফগানিস্তান মানেই চোখের সামনে ভেসে আসে কালো, খয়েরি জোব্বা পরা কিছু মানুষ আর তাদের হাতে বন্দুক, মিসাইল। সাধারণ মানুষের চোখে ভয়। প্রিয়জন হারানোর কান্না। এর মাঝে ক্রিকেট? প্রাক্তন আফগান ক্রিকেটার করিম সাদিক এখনও একটি ম্যাচের কথা ভুলতে পারেননি। ক্রিকেট মাঠে বোমা ছোড়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমার দিকে বোমা ছুড়েছিল। চোখের সামনে দেখলাম দর্শকেরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। অনেক মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দরজা দিয়ে বার হওয়ার সময় দেখলাম একের পর এক বোমা ফাটছে। তার মধ্যেও অনেককে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলাম।”

শুধুই কি এ সব? রয়েছে প্রকৃতির রোষও। এ বারের বিশ্বকাপে যে দিন আফগানিস্তান প্রথম খেলতে নেমেছিল, তার পরের দিন আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি জোরালো ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানের ১২টি গ্রাম। এর চার দিন পর আরও একটি ভূমিকম্প হয়। মৃতের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারে পৌঁছে যায়।

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান। ছবি: পিটিআই।

কিন্তু এর মাঝেও আফগানিস্তানের মানুষ ক্রিকেট নিয়ে বাঁচেন। রশিদেরাই আনন্দ দেন তাঁদের। তালিবদের আক্রমণ হোক বা ভূমিকম্প, কোনও কিছুর পরেই ক্রিকেট দেখা থামাননি আফগান দর্শক। আর বিপুল আবেগের সম্মান রেখেছেন রশিদ, মহম্মদ নবি, রহমনুল্লা গুরবাজেরা। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো দলকে হারিয়ে দেওয়ার পর কাবুলের রাস্তায় বাজি পুড়েছে। রাস্তায় নেমে নেচেছেন আফগানিরা।

এ বারের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় নেই। দু’বারের বিশ্বকাপজয়ীরা জায়গা না পেলেও আফগানিস্তান আছে। ক্যারিবিয়ান দৈত্যদের ক্রিকেটীয় সভ্যতা ভেঙে পড়ছে। অন্য দিকে, আফগানিরা গড়ছেন ক্রিকেট শিল্প। এর পিছনে রয়েছে ঘরোয়া ক্রিকেট। আফগানিস্তানে ঘরোয়া ক্রিকেট আছে। হয়তো সব জায়গার মানুষের পক্ষে খেলা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণে বিদেশি ক্রিকেটারদের পক্ষে আফগানিস্তানে গিয়ে ক্রিকেট খেলা বা কোনও রকম সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তা-ও ঘরোয়া ক্রিকেট আফগানিস্তানে আছে। আফগান ক্রিকেট বোর্ড তরুণ প্রতিভা তুলে আনার জন্য প্রতি বছর স্পাগিজা ক্রিকেট লিগের আয়োজন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সেখান থেকেই উঠে আসেন মুজিব উর রহমান, নবীন উল হকের মতো ক্রিকেটারেরা। যদিও খুব দূরের স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয় না আফগানিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে। যুদ্ধ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে পাকিস্তানের থেকে আসা উদ্বাস্তু। সেই সব উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ক্রিকেট খেলা হয়। সেখান থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে খেলা বেশ কঠিন। ৩৫ বছর বয়সি আব্দুল ওয়াহিদ ছিলেন কুনার প্রদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। তিনি বলেন, “আমরা ক্রিকেট খেলা শিখেছি এখানেই। এই ক্রিকেটটাই তো আছে আমাদের। আর আমাদের সেই দেশ এখন বিশ্বমঞ্চে খেলছে। গোটা বিশ্ব সেটা দেখছে।”

আফগানিস্তানের রাস্তায় ক্রিকেট। ছবি: পিটিআই।

তবে বিশ্ব ক্রিকেটে আফগানিস্তানেই এই উত্থানের পিছনে রয়েছে ভারতের অবদানও। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আফগান ক্রিকেটের পাশে না দাঁড়ালে রশিদ খান, মহম্মদ নবিদের হয়তো ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিতি পেতে আরও সময় লেগে যেত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই করার জন্য যে ধরনের অনুশীলন, সুযোগ-সুবিধা, প্রয়োজন আফগান বোর্ড রশিদদের সে সব দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সেটা যথেষ্ট নয়। তাঁদের আবেদনে ২০১৭ সালে সাড়া দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কর্তারা। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। দেশে আন্তর্জাতিক সিরিজ় আয়োজনের সুযোগ ছিল না আফগানিস্তানের। রশিদেরা হোম সিরিজ়গুলি খেলতেন ভারতে। আয়ারল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা সিরিজ় খেলেছেন ভারতের মাটিতে। লখনউ, দেহরাদূন, গ্রেটার নয়ডার স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল ম্যাচগুলি। আফগানদের খেলার সুবিধা করে দিতে, এই স্টেডিয়ামগুলিতে সে সময় ভারতীয় দলের খেলা খুব একটা দেওয়া হত না।

প্রায় সারা বছর আফগানিস্তানের জাতীয় দল থাকত এ দেশে। ভারতীয় ক্রিকেটের পরিকাঠামো ব্যবহার করে অনুশীলন করতেন ক্রিকেটারেরা। ভারতীয় কোচেরা তাঁদের সাহায্য করতেন। ভুল শুধরে দিতেন। স্থানীয় দলগুলির সঙ্গে নিয়মিত প্রস্তুতি ম্যাচও খেলত আফগানিস্তান। কয়েক বছরের চেষ্টায় ধীরে ধীরে উন্নতি করে তারা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসতে শুরু করে সাফল্য। সেই সাফল্যের সুবাদে আইসিসির কাছ থেকে টেস্ট খেলার ছাড়পত্রও পায় আফগানিস্তান। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিলেও বিসিসিআই কর্তারা আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে সে সময় মুনাফা করার কথা ভাবেননি। নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হত সারা বছর পরিকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ।

বিশ্বকাপে ভাল খেলার জন্য তো শুধু প্রতিভা বা পরিকাঠামো থাকলে হয় না, প্রয়োজন পরিকল্পনারও। সেটার জন্য রশিদেরা ধন্যবাদ জানাতে পারেন ইংরেজকে। যে ইংরেজদের এ বারের বিশ্বকাপে ৬৯ রানে হারিয়েছেন রশিদেরা, সেই দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার জনাথন ট্রট আফগানিস্তানের এই ক্রিকেট দলের মগজ। সোমবার শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর যিনি আনন্দ চেপে রাখতে পারেননি। হাতে সাত উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে দাপটের সঙ্গে হারানোর পিছনে ছিল তাঁর পরিকল্পিত মস্তিষ্ক। কোচ ট্রটের সামনে ছিল একটা সাদা বোর্ড। সেখানে লেখা ১০ ওভারে ৫০ রান, ২০ ওভারে ১০০ রান, ৩০ ওভারে ১৫০ রান, ৪০ ওভারে ২০০ রান। এই ভাবেই এগিয়ে গিয়েছিলেন গুরবাজেরা। যদিও প্রথম ১০ ওভারে ৫০ রানের গণ্ডি পার করলেও ২০ ওভারে ৮৯ রান ছিল তাঁদের। ৩০ ওভারে তাঁরা থেমে গিয়েছিলেন ১৩৯ রানে। কিন্তু ৪০ ওভারে পৌঁছে যান ২০১ রানে। জয় আসে ৪৫.২ ওভারে।

উইকেট নেওয়ার পর আফগান ক্রিকেটারদের উল্লাস। ছবি: পিটিআই।

ট্রট বলেন, “আমাদের পক্ষে এই ম্যাচ ৩৫-৪০ ওভারে জেতা সম্ভব ছিল না। পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করার লক্ষ্য রাখতে হত আমাদের। সেই কারণে ১০ ওভারের হিসাবে ম্যাচটাকে ভেঙে নিয়েছিলাম।”

এ বারের বিশ্বকাপের আগে এক দিনের ক্রিকেটে মাত্র সাত বার রান তাড়া করেছিলেন রশিদেরা। এর মধ্যে জিতেছিলেন মাত্র দু’বার। দলের বড় সমস্যা ছিল রান তাড়া করা। এ বারের বিশ্বকাপেও নিউ জ়িল্যান্ডের বিরদ্ধে রান তাড়া করতে গিয়ে ১৩৯ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল রশিদদের ইনিংস। দলের অধিনায়ক হসমতুল্লা শাহিদি, তিন নম্বরে নামা রহমত শাহদের স্ট্রাইক রেট ছিল দলের অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ। ২০১০ সাল থেকে ১৮০০ রানের বেশি করা আফগান ক্রিকেটারদের মধ্যে এই দুই জনের স্ট্রাইক রেট ছিল ৭০-এর নীচে। ২০২২ সালের পর আফগানিস্তানের মিডল অর্ডারের ব্যাটারদের মিলিত গড় ছিল ২৬.৪৬। যা এ বারের বিশ্বকাপের ১০টি দলের মধ্যে সব থেকে কম।

বাংলাদেশ এবং ভারতের বিরুদ্ধে হারের পরে বদলে যেতে শুরু করেছে আফগানিস্তান। ব্যাটারেরা ভাল শুরু করছেন। ওপেনারেরা যে রানের ভিত গড়ছেন, তার উপর দাঁড়িয়ে ইমারত তৈরি করছেন মিডল অর্ডারের ব্যাটারেরা। শেষ দিকে রশিদেরা রয়েছেন দ্রুত রান তোলার জন্য। আফগানিস্তানের স্পিন বোলিং নিয়ে চিন্তা ছিল না রশিদ, নবি এবং মুজিব থাকায়। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছেন নুর আহমেদ। পেসারদের মধ্যে নবীন উল হক, ফজল হক ফারুকিরা চেষ্টা করছেন দলকে ভরসা দেওয়ার। সঙ্গে মিডিয়াম পেসার আজমতুল্লা ওমারজাই রয়েছেন, যিনি ব্যাট হাতেও দলের মিডল অর্ডারের ভরসা।

ট্রট বলেন, “আমরা ক্রিকেটটা ভাবি ব্যাটিং দিয়ে। জানি সেটা উচিত নয়। আদ্যিকালের ভাবনা এটা। কিন্তু আমাদের ব্যাটিং দিয়েই ভাবতে হয়। সেই সঙ্গে যদিও আমরা কাজ ভাগ করে নিই। যা দলের সকলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ম্যাচের দিন আমরা সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি এমন নয়। আমরা নিজেদের বলি, আমি ফর্মে আছি, খেলার জন্য তৈরি এবং রান করবই। ক্রিকেটে সফল হতে গেলে সব থেকে বেশি প্রয়োজন ইতিবাচক মানসিকতা। আমি বাকি কোচদের সঙ্গে নিয়ে সেটাই তৈরি করার চেষ্টা করি। অনুশীলনের সময় আমরা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করি ক্রিকেটারদের জন্য। ম্যাচের যেমন পরিস্থিতি হতে পারে, সেটা মনে মনে তৈরি করে নিতে হয়। অনুশীলনে আমরা সে ভাবেই খেলা অভ্যেস করি। এর ফলে দলের ক্রিকেটারেরা চাপ নিতে শিখছে।”

আফগান ক্রিকেট তৈরি হচ্ছে। ইংল্যান্ডকে হারানো অঘটন ছিল। কিন্তু এর পর পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দেওয়ার পর আফগানিস্তানের জয়কে আর অঘটন বল যাবে না। রশিদেরা এখন এটাই অভ্যেস করে ফেলছেন। বিশ্বকাপে আরও তিনটি ম্যাচ বাকি তাদের। সেমিফাইনালে ওঠার আশাও রয়েছে। তাই এ বারের বিশ্বকাপে রশিদেরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, শুধু যুদ্ধ নয়, আফগানিস্তান এখন ক্রিকেটেরও দেশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement