(বাঁ দিকে) নীতীশ কুমার রেড্ডি। ছোট্ট নীতীশ বাবা মুতিয়ালা রেড্ডির সঙ্গে (ডান দিকে)। ছবি: এক্স (টুইটার)।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বুম হাতে এমসিজির গ্যালারিতে ছুটছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার থামলেন মুতিয়ালা রেড্ডির সামনে এসে। নীতীশ কুমার রেড্ডি শতরান করার পর তাঁর বাবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি গিলক্রিস্ট। কারণ ২২ গজে নীতীশের লড়াইয়ের নেপথ্যে রয়েছে আরও এক লড়াইয়ের কাহিনি। গত ১৫ বছর ধরে যে লড়াই লড়েছেন মুতিয়ালা। সঙ্গত করেছেন নীতীশ।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম তিনটি টেস্টে ভাল ব্যাট করলেও বড় রান পাননি নীতীশ। অর্ধশতরানের কাছাকাছি এসে আটকে যাচ্ছিলেন। মেলবোর্নের ২২ গজে সেই বাধা টপকে প্রথম টেস্ট শতরানও করে ফেললেন। নীতীশ বাধা টপকাতে পারবেন, এই বিশ্বাস ছিল ভারতীয় শিবিরের। কারণ, ভারতীয় দলের সাজঘর পর্যন্ত পৌঁছতে বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে নীতীশকে। যে লড়াইয়ের প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে ছিলেন তাঁর বাবা। ছোট থেকে নীতীশ চাইতেন বড় হয়ে অভিনেতা হতে। নায়কদের মতো জীবন। তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে হোক ক্রিকেটার। দেশের হয়ে খেলেও নায়কসুলভ জীবনযাপন করা যায় ছেলেকে বুঝিয়ে ছিলেন। বাবার দেখানো সেই পথে হেঁটেই ভারতীয় টেস্ট দলের প্রথম একাদশে নীতীশ।
ছ’বছর বয়সে ক্রিকেট শেখা শুরু ২১ বছরের অলরাউন্ডারের। মুতিয়ালা ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কুমার স্বামীর অ্যাকাডেমিতে। তাঁর প্রশিক্ষণেই ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন নীতীশ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত কুমারও মানছেন নীতীশের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান মুতিয়ালারই।
কুমার বলেছেন, ‘‘সকলে নিজের জীবনের নায়ক হতে চায়। কিন্তু নীতীশের জীবনের আসল নায়ক ওর বাবা। মুতিয়ালার কঠোর পরিশ্রমের ফসল আজকের নীতীশ। ওর সব উত্থান-পতনের সাক্ষী বাবা। শুরুর দিকে বাড়ির সকলে নীতীশের ক্রিকেট খেলার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, রোজগার না করে ছেলেকে নিয়ে সময় নষ্ট করছেন মুতিয়ালা। সে সময় একা লড়াই করেছিলেন মুতিয়ালা। হাল ছাড়েননি কখনও।’’
কুমারের এই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে নীতীশের মুখেও। একটা সময় পর্যন্ত ক্রিকেট তেমন পছন্দ ছিল না তাঁর। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তরুণ ক্রিকেটার বলেছেন, ‘‘সত্যি বলতে ছোটবেলায় ক্রিকেট খুব একটা ভাল লাগত না। তবু আমার ভবিষ্যতের জন্য বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার জন্য প্রচুর কষ্ট করেছেন বাবা। এক দিন দেখি বাবা কাঁদছেন। তখন আমাদের প্রবল আর্থিক সমস্যা। সে সময় সব কিছুই অনিশ্চিত মনে হত। কিন্তু কষ্টের মধ্যেও বাবা সব সময় আশা দেখতেন। তখন থেকে মন দিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। ভারতীয় দলের প্রথম জার্সিটা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে দিন বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।’’
গত অক্টোবরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় নীতীশের। বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির প্রথম টেস্টে পার্থে লাল বলের ক্রিকেটে অভিষেক। নীতীশ এখনও কোনও ম্যাচে গৌতম গম্ভীর-রোহিত শর্মাদের হতাশ করেননি। ব্যাট, বল বা ফিল্ডিংয়ে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সব সময়। প্রথম টেস্ট খেলার আগে বাবাকে ফোন করেছিলেন নীতীশ। মুতিয়ালা বলেছেন, ‘‘ওর মুখ থেকে যখন শুনলাম টেস্ট খেলবে, তখন কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আসলে আমি বা নীতীশ কেউই আশা করিনি, এত তাড়াতাড়ি টেস্ট খেলার সুযোগ আসবে। প্রায় ১০ মিনিট আমরা চুপ করেছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। নীতীশকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, সত্যি বলছে কি না।’’ নীতীশদের নিজেদের বাড়ি নেই। বিশাখাপত্তনমের কাছে মধুরাওয়াড়া এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। ক্রিকেট আর্থিক সমস্যা দূর করলেও শিকড় আঁকড়ে থাকতে চাইছে রেড্ডি পরিবার।
নীতীশকে ৬ কোটি টাকায় ধরে রেখেছে আইপিএল দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। আরও বেশি টাকা দিয়ে নীতীশকে হায়দরাবাদের কাছ থেকে কিনে নিতে চেয়েছিল আইপিএলের একাধিক দল। কিন্তু সেই সব প্রস্তাবে রাজি হননি মুতিয়ালা। তিনি বলেছেন, ‘‘আইপিএলের একাধিক দল নীতীশকে পেতে চেয়েছিল। ১৫ কোটির বেশি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আমাদের। নীতীশের মতামত চেয়েছিলাম। ও প্রশ্ন করেছিল, ‘এত দিন কারা আমাদের পাশে ছিল? কাদের হয়ে খেলে প্রচার পেয়েছি?’ হায়দরাবাদের কথা বলতেই নীতীশ আমাকে বলে, ‘তা হলে কেন দল ছাড়ব? বেশি টাকার জন্য দল বদলালে নিজেকে আবার প্রমাণ করতে হবে। ব্যর্থ হলে তারা বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হায়দরাবাদের হয়ে দুটো ম্যাচ খারাপ খেললেও দল পাশে থাকে। খেলার সুযোগ দেয়।’ নীতীশের ভাবনাটা খারাপ লাগেনি। তাই টাকার পিছনে না ছুটে নিলামের আগে হায়দরাবাদের সঙ্গে চুক্তি করে নেওয়ায় মত দিয়েছিলাম।’’
নীতীশের ক্রিকেটজীবন এ ভাবেই এগিয়েছে। বাবা-ছেলের বোঝাপড়ার মাঝে আসতে পারেননি কেউ। কখনও বাবার পরামর্শ মেনে নিয়েছেন নীতীশ। আবার কখনও ছেলে কথা শুনেছেন মুতিয়ালা। চাকরি ছেড়ে ছেলেকে ক্রিকেটার তৈরির স্বপ্নে বিভোর মুতিয়ালাকে কম বার হেনস্থা হতে হয়নি। পরিবারের সকলে তো বটেই, আত্মীয়-প্রতিবেশী-বন্ধুরাও কটূক্তি করতেন। সে সব অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়ে মুতিয়ালা ছেলেকে নিয়ে ছুটেছেন স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে। কটূক্তি, অপমান, আর্থিক সঙ্কট সব সামলেছেন একা। ধারদেনায় ডুবে গিয়েছেন। তবু ছেলের গায়ে আঁচ লাগতে দেননি। প্রভাব পড়েনি ছেলের খেলাতেও। স্কুল ছুটির পর ছেলেকে নিয়ে মুতিয়ালা যেতেন ক্রিকেট কোচিংয়ে।
কুমার বলেছেন, ‘‘প্রতি দিন স্কুল থেকে আমার কাছে আসত নীতীশ। দুপুর ৩টে নাগাদ ছেলেকে নিয়ে জ়িঙ্কের মাঠে চলে আসতেন মুতিয়ালা। যত গরমই থাকুক, নীতীশ আসতই। প্রথমে কিছু ক্ষণ বড়দের খেলা দেখত। তার পর অনুশীলন শুরু করত। তখনই ওর মধ্যে একটা একাগ্রতা ছিল। কিছু দিন পর বিশাখাপত্তনম ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাকাডেমির (ভিডিসিএ) একটা প্রশিক্ষণ শিবিরে নীতীশকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন লক্ষ্য করি ব্যাটিংয়ের সব কিছু দ্রুত শিখে নিচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রথম জেলা পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে নীতীশ, সে বার ভাল পারফর্ম করতে পারেনি। ওর বাবাকে ডেকে বলা হয়েছিল, নীতীশের ফিটনেস ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত নয়। খেলা ছাড়িয়ে ছেলেকে পড়াশোনা করানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর বাবা হাল ছাড়েননি।’’
ভিডিসিএ কর্তাদের জবাব দিতে নতুন পরিকল্পনা করেন মুতিয়ালা। ছেলেকে বিশাখাপত্তনমের মিউনিসিপ্যাল স্টেডিয়ামে ভিডিসিএ-র প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যেতে শুরু করেন তিনি। কোনও কোনও দিন নিয়ে যেতেন ভিডিসিএ-র আর একটা প্রশিক্ষণ শিবিরে। প্রতি দিন ৩০ কিলোমিটার যাতায়াত করতেন ছেলেকে নিয়ে। ভাল পিচে ভাল বোলারদের বিরুদ্ধে অনুশীলনের সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন ছেলেকে। সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন নীতীশও। ১৩ বছর বয়সে জেলার বয়সভিত্তিক দলে প্রথম সুযোগ পান। তাতেও তৈরি হয় বিপত্তি। প্রথম ম্যাচের চার দিন আগে চোট পান গোড়ালিতে। ফুলে যায় গোড়ালি। সে সময় নীতীশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কোচ কুমার। নির্বাচক এবং নীতীশের বাবা-মাকে বলেছিলেন, যে কোনও মূল্যে তিনি নীতীশকে দলে চান। বাদ দেওয়া যাবে না। তাঁর সেই সিদ্ধান্তও কম সমালোচিত হয়নি। কুমার বলেছেন, ‘‘নীতীশের উপর আস্থা ছিল আমার। বলতে পারেন বড় একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিলাম ওকে নিয়ে। নীতীশ কিন্তু আস্থার মর্যাদা দিয়েছিল। গোড়ালির চোট নিয়েই প্রথম ম্যাচে ৯৯ রানের ইনিংস খেলেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে করেছিল ১৪০ রান। বলতে পারেন নীতীশের ক্রিকেট যাত্রায় একটা গতি যোগ করেছিল সেই ম্যাচ দু’টি। অন্ধ্রপ্রদেশের অনূর্ধ্ব ১৪ দলে প্রথম বার সুযোগ পেয়েছিল।’’
অনূর্ধ্ব ১৪ দলের পাশাপাশি অনূর্ধ্ব ১৬ দলের জন্যও নীতীশের নাম বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু বয়সের কথা ভেবে প্রথমে রাজি ছিলেন না নির্বাচকেরা। তখনও তাঁদের বুঝিয়েছিলেন কুমার। সে-ও এক কঠিন অভিজ্ঞতা। অনূর্ধ্ব ১৬ দলের হয়ে প্রথম ম্যাচে ওপেনার নীতীশকে ব্যাট করতে পাঠানো হয়েছিল ন’নম্বরে। তত দিনে নীতীশের লড়াইয়েও রক্ত ঢুকে গিয়েছিল। ৩৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। প্রতিপক্ষের ইনিংসের প্রথম ৭২ ওভার তাঁকে বল করতে দেওয়া হয়নি। কিছুটা উপায় না দেখেই তাঁর হাতে বল তুলে দেওয়া হয় ৭৩তম ওভারে। তিন উইকেট নেন তিনি।
কোচের প্রতি কৃতজ্ঞ মুতিয়ালা বলেছেন, ‘‘নীতীশ পারফর্ম করতে না পারলে কুমারের কথার দাম থাকত না। ওকে হয়তো অপমানিত হতে হত। কিন্তু নীতীশ সব সময় আমার এবং কোচের আস্থার মর্যাদা দিয়েছে। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, মাঠে নেমে পারফর্ম করে অনুকূলে নিয়ে এসেছে।’’ ১৬ বছর বয়সে বিজয় হজারে ট্রফিতে নীতীশ করেছিলেন ১২৩৭ রান। তখনই কুমার বুঝে যান, তাঁর ছাত্র তৈরি। তিনি নিজে একটি ব্যাটে নীতীশের সই নেন। সেই প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়া ক্রিকেটার নীতীশের।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলার সময় থেকে দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতেন নীতীশ। তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল দেশকে জেতানো এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল করা। জাতীয় দলে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন গত জ়িম্বাবোয়ে সফরের সময়। কিন্তু চোট পাওয়ায় দল থেকে ছিটকে যান। বিসিসিআই তাঁকে বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঠায় চিকিৎসার জন্য। সেখানে হার্দিক পাণ্ড্যর সঙ্গে দেখা হয় নীতীশের। বরোদার অলরাউন্ডার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পরামর্শ দেন অনুজকে। মুতিয়ালা বলেছেন, ‘‘আগে প্রচুর খেত আমার ছেলে। বাড়িতে মাছ, চিংড়ি, মাংস যাই রান্না হত, তাই অনেকটা করে খেত। এখনও প্রায় সব খাবারই খায়। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি নয়। প্রয়োজনে খাবার ওজন করে নেয়। যেমন দিনে ২০০ গ্রামের বেশি মুরগির মাংস খায় না। দু’দিন পর পর মুরগির মাংসও খায় না। দলের পুষ্টিবিদের নির্দেশ মেনে চলে।’’
গত চার-পাঁচ বছর ধরে নিজের বোলিংয়ের ধার বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন নীতীশ। ধারাবাহিক ভাবে ১৩৪-১৩৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে বল করতে পারেন। কখনও কখনও ১৪০-১৪২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতেও বল করেন। ভুবনেশ্বর কুমারের কাছ থেকে শিখেছেন ইন-সুইং এবং আউট-সুইং। অন্ধ্রপ্রদেশের সেই অনূর্ধ্ব ১৪ দলের কোচ বিজয় বর্মার কাছে আলাদা করে বোলিং অনুশীলন করছেন দু’বছর ধরে।
২০২১ সালে চেন্নাই সুপার কিংস নীতীশে নেট বোলার হিসাবে নিয়েছিল। সেই সুযোগ ক্রিকেট দর্শন বদলে দিয়েছে নীতীশের। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং — কোনও বিভাগেই পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। ২০২৩ সালের আইপিএল নিলামে নীতীশকে ২০ লাখ টাকায় দলে নিয়েছিল হায়দরাবাদ। তার পর থেকে ক্রমশ এগিয়েছেন নীতীশ। শনিবার সেই পথের আরও এক মাইলফলক স্পর্শ করলেন ২১ বছরের তরুণ। যে কীর্তির পরতে পরতে রয়েছে তাঁর বাবার নাছোড় লড়াই।