গৌতম গম্ভীর। ছবি: পিটিআই।
চাহিদার শেষ নেই। গৌতম গম্ভীরের একের পর এক চাহিদা মেটাতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে একাধিক বার প্রথা বদলাতে হয়েছে। বেশ কিছু পরিবর্তন দেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট। চার মাস যেতে না যেতেই আরও এক বদলের দাবি উঠেছে— গম্ভীর বদল। এ দেশের ক্রিকেটে এত তাড়াতাড়ি কোচ সরানোর দাবি আগে কখনও ওঠেনি।
গম্ভীরের চাহিদাগুলো দেখে মনে হয়েছিল, ব্যতিক্রমী চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় ক্রিকেট মেসি-রোনাল্ডোদের পেশাদার ফুটবলের পথে পা মেলাবে। বোর্ড কর্তা-নির্বাচকদের সরিয়ে অন্তত এক জন কেউ ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্তগুলো নিজে নেবেন। কিন্তু নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ়ে ভরাডুবির পর ভারতীয় ক্রিকেট আবার খুব শীঘ্রই ফিরবে বাবু সংস্কৃতিতে। ছাঁটা হচ্ছে গম্ভীরের ডানা। তাঁর একার হাতে আর ছাড়া হবে না রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিদের দায়িত্ব।
আর্জেন্টিনা কোন কোন ফুটবলারকে বিশ্বকাপের দলে রাখবে তা বেছে নেন কোচ লিয়োনেল স্কালোনি। বা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কোন কোন ফুটবলারকে বাছবে সেটা ঠিক করেন ম্যানেজার। এমনটাই ফুটবলের ক্ষেত্রে প্রথা। ক্রিকেটে সেটা হয় না। সেখানে দল নির্বাচনে কোচের থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু গম্ভীরের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের কোন দল যাবে তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নাক গলিয়েছেন গম্ভীর। না হলে কেকেআরের হর্ষিত রানার হয়তো এখনই দলে ঢোকা হত না।
কোচ হওয়ার আগে থেকেই গম্ভীর শর্ত চাপিয়েছিলেন। সেটা ছিল সাপোর্ট স্টাফ বা সহকারীদের নিয়ে। গম্ভীরের শর্ত ছিল, তাঁর পছন্দ মতো সহকারী কোচদের নিতে হবে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং কোচের ব্যাপারে কারও অনুরোধ বা সুপারিশ তিনি শুনবেন না। ভারতীয় বোর্ড বিদেশি কোচ নেওয়ার ব্যাপারে একেবারেই রাজি ছিল না। কিন্তু গম্ভীরের শর্ত মেনে তাঁর সহকারী হিসাবে নেওয়া হয় রায়ান টেন দুশখতেকে। বোলিং কোচ করা হয় মর্নি মর্কেলকে। বোর্ড জাহির খানকে বোলিং কোচ হিসাবে চেয়েছিল। কিন্তু গম্ভীর তা মানেননি। তিনি নিজের পছন্দের বোলিং কোচকেই দলে নেন। অনেক টালবাহানার পর বোর্ড তা মেনে নেয়। যে কারণে সহকারী হিসাবে বাকিদের নাম ঘোষণা করতে সময় লেগেছিল বোর্ডের। ফিল্ডিং কোচ হিসাবে গম্ভীরের পছন্দ ছিলেন জন্টি রোডস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বোর্ড টি দিলীপকেই রেখে দেয়। এই একটা ক্ষেত্রেই গম্ভীরের দাবি মেনে নেয়নি বোর্ড। বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “এক সময় গম্ভীর নিজেই ভারতীয় কোচ নেওয়ার কথা বলত। কিন্তু নিজে কোচ হওয়ার পর বিদেশিদের নিল সহকারী হিসাবে। ভারতের ক্রিকেট বিদেশিদের পক্ষে বোঝা কঠিন। ভারতীয় কোচই প্রয়োজন। মর্কেল বা দুশখতে ভারতীয় ক্রিকেটের কতটা উন্নতি করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ওদের এখনই সরিয়ে দেওয়া উচিত।”
গম্ভীরের সর্বশেষ আবদার ছিল, নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনটি টস্টে কী ধরনের পিচ হবে তা তিনি বেছে দেবেন। সেই দাবিও মানা হয়েছিল। ফল তিনটি টেস্টে গো-হারা হার। প্রথম বার ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জেতার নজির গড়ে কিউয়িরা। যারা অন্তত একটি টেস্ট যাতে ড্র করতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ভারত ১২ বছর পর ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হারে। ২৪ বছর পর টেস্টে চুনকাম হয়।
আর তাই প্রশ্নের মুখে গম্ভীর। কোচ বদলের দাবি।
কী কী ভুল করেছেন গম্ভীর
এক, রাহুল দ্রাবিড় কোচ থাকার সময় ঘরের মাঠে ঘূর্ণি পিচ বানানো বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত। কিন্তু পুণে এবং মুম্বইয়ে গম্ভীর ঘূর্ণি পিচ বানানোর নির্দেশ দেন। সূত্রের খবর, গম্ভীরের সেই সিদ্ধান্ত দলের অনেকেই মানতে পারেননি। বোর্ডের অনেক কর্তাই সেই সিদ্ধান্ত শুনে চমকে গিয়েছিলেন। কারণ ভারতীয় ব্যাটারদের স্পিন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে দুর্বলতা বার বার প্রকট হয়েছে। এ বার গম্ভীর এবং বাকি সাপোর্ট স্টাফদের প্রশ্ন করা হবে আগামী দিনে তারা কী ভাবে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।
কোচ গৌতম গম্ভীরের চোখ পুণের পিচে। ঝুঁকে খুঁটিয়ে দেখছেন রোহিত শর্মা। ছবি: পিটিআই।
দুই, প্রশ্ন উঠছে ব্যাটিং অর্ডার নিয়েও। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে শুভমন গিল খেলতে পারেননি। সেই ম্যাচে বিরাট কোহলিকে তিন নম্বরে নামিয়ে দেয় ভারত। কিন্তু তিনি সেই জায়গায় খেলতে অভ্যস্ত নন। লোকেশ রাহুলকে তিন নম্বরে পাঠিয়ে পরীক্ষা করা যেত। তিনি এর আগে টেস্টে ওপেন করেছেন। ফলে তিন নম্বরে খেলতে হলে খুব সমস্যায় পড়তে হত না তাঁকে। আবার মুম্বইয়ে সরফরাজ়কে নামানো হয় রবীন্দ্র জাডেজার পরে। এতটা নীচে তাঁকে কেন নামানো হল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তিন, শুধু দেশের মাটিতে ঘূর্ণি উইকেট বানিয়ে বিপদ ডেকে আনা বা ব্যাটিং অর্ডার পাল্টে দেওয়া নয়, বেঙ্গালুরুতে টস জিতে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত। সেই দায়ও এড়িয়ে যেতে পারবেন না কোচ গম্ভীর। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে পিচ বুঝতে ভুল করেছিল ভারত। বেঙ্গালুরুর মেঘলা আবহাওয়ায় টস জিতে রোহিত শর্মার ব্যাট করার সিদ্ধান্ত তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। পরে রোহিত স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে তিনি পিচ বুঝতে পারেননি। সেই দায় কোচেরও। কারণ অধিনায়ক যদি ভুল করেনও সেটা শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব তো কোচের। যে কোচ নিজের সহকারী বেছে নেওয়ার জন্য বোর্ডকে শর্ত দেন, দল নির্বাচনে নাক গলান, তিনি টস জিতে অধিনায়ক কী করবেন সেটা বলে দেবেন না? আগামী দিনে তাই বোর্ডের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতেই পারে গম্ভীরকে।
গম্ভীরের চাহিদা
কোচ হওয়ার পর বোর্ডকে পাঁচটি শর্ত দিয়েছিলেন গম্ভীর।
প্রথম শর্ত: ভারতীয় দলের ক্রিকেট সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় থাকবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। বিসিসিআই কর্তাদের কোনও হস্তক্ষেপ তিনি মানবেন না।
দ্বিতীয় শর্ত: নিজের পছন্দ মতো সহকারী কোচদের বেছে নিতে দিতে হবে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং কোচের ব্যাপারে কারও অনুরোধ বা সুপারিশ তিনি শুনবেন না।
তৃতীয় শর্ত: এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, রবীন্দ্র জাডেজা এবং মহম্মদ শামিকে। চার সিনিয়র ক্রিকেটারের জন্য ভারতীয় দলের দরজা তিনি ওই প্রতিযোগিতা পর্যন্ত খোলা রাখবেন। তাঁরা যদি ভারতীয় দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারেন, তা হলে বাদ পড়তে হবে।
বিরাট কোহলির সঙ্গে আলোচনা গৌতম গম্ভীরের। ছবি: পিটিআই।
চতুর্থ শর্ত: টেস্ট এবং সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য পৃথক দল চাই তাঁর। ক্রিকেটারদের চাপ এবং দক্ষতার কথা বিবেচনা করে দল নির্বাচন হবে।
পঞ্চম শর্ত: এখন থেকেই ২০২৭ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করতে দিতে হবে। দলকে বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করাই হবে তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
এই সব শর্তের অনেকগুলিই মেনে নেয় বোর্ড। যেমন টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট দলে সম্পূর্ণ আলাদা দল খেলানো হচ্ছে। সহকারীদের গম্ভীর নিজে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু ফল পাচ্ছে না ভারত। ঘরের মাঠে হারতে হচ্ছে। তাই ২০২৫ বা ২০২৭ সালে কী হবে তা এখনই বলা কঠিন। তত দিন গম্ভীর কোচ থাকবেন তো?
গম্ভীরকে নিয়ে ভয় ১৬ বছর আগে
গম্ভীর ভারতের কোচ হওয়ার পর ভয় পেয়েছিলেন প্যাডি আপটন। ১৬ বছর আগে ভারতীয় দলে গম্ভীরের সঙ্গে মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচ হিসাবে কাজ করেছেন আপটন। তিনি খুব ভাল ভাবেই চেনেন ভারতীয় দলের বর্তমান কোচকে। নিজের বইয়ে আপটন লিখেছেন, “গম্ভীরের জন্য আমি নিজের সেরাটা দিয়েছিলাম। কিন্তু এত খারাপ রেজাল্ট কখনও পাইনি। ২০০৯ সালে আইসিসি-র বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের পুরস্কার পাওয়া সেই লোকটাকে নিয়েই সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে মানসিক ভাবে সবচেয়ে নেতিবাচক এবং নৈরাশ্যবাদী লোকটার নাম গৌতম গম্ভীর।”
কেন এমন মনে হয়েছিল, পঞ্চাশোর্ধ্ব ভদ্রলোক তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘‘নিরাপত্তাহীনতা, সন্দেহ— এগুলো সারা ক্ষণ ওর মধ্যে চেপে বসে থাকত। সব সময় একটা নড়বড়ে ভাব। এত নেতিবাচক লোক আমি আর দেখিনি। ও যাতে একটু পজিটিভ, একটু আশাবাদী হয়, তার জন্য নিজের যাবতীয় বিদ্যাবুদ্ধি প্রয়োগ করে সব রকম চেষ্টা করেছিলাম। এক বছরে টিম বাসে ওকে নিয়ে অন্তত ১৫ বার বসেছি। কোনও লাভ হয়নি। গম্ভীরকে বদলাতে পারিনি।’’
গম্ভীর কখনও তারকা নন
খেলোয়াড় জীবনে গম্ভীর কখনও তারকা হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর সিনিয়র হিসাবে দলে ছিলেন সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরা। ক্রিকেটার হিসাবে গম্ভীর কখনও তাঁদের ছাপিয়ে যেতে পারেননি। আবার তাঁর সমসাময়িক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির থেকেও তারকা তকমা ছিনিয়ে নিতে পারেননি। বরং ২০০৭ বা ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর ধোনিকে নিয়ে যখন দেশ লাফাচ্ছে, তখন গম্ভীর বার বার তাঁর নিজের কৃতিত্বের কথা ফলাও করেছেন। ধোনির ম্যাচ জেতানো ছক্কা সম্পর্কে গম্ভীর বলেছিলেন, “একটা ছয় ম্যাচ জেতায়নি।” অবশ্যই জেতায়নি, কিন্তু তাই বলে ধোনির কৃতিত্ব ছোট করে দেখানোর প্রয়োজন ছিল কি?
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সঙ্গে গৌতম গম্ভীর। —ফাইল চিত্র।
গম্ভীর অবসর নিয়েছেন ২০১৬ সালে। তত দিনে ভারতীয় দলে তারকার সম্মান পেয়ে গিয়েছেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মারা। গম্ভীর ক্রিকেট জীবনে দেশের অন্যতম সফল ওপেনার হিসাবেই রয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজের ওপেনিং পার্টনার বীরেন্দ্র সহবাগকেও কখনও ছাপিয়ে যেতে পারেননি। আর নিজে তারকা হয়ে উঠতে না পারলে তারকাদের সামলানো কিছুটা কঠিন হয়। প্রাক্তন কোচ দ্রাবিড় যে মাপের ব্যাটার ছিলেন, গম্ভীর সেটা নন। যে কারণে তাঁর পক্ষে বিরাট, রোহিতদের ব্যাটিং সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া কতটা সহজ তা বলা কঠিন। আবার রবি শাস্ত্রীর মতো গম্ভীর দীর্ঘ দিন ধারাভাষ্যও দেননি। ধারাভাষ্যকার হিসাবে শাস্ত্রী ক্রিকেটের সঙ্গে যে ভাবে জড়িয়ে ছিলেন গম্ভীর ততটা ছিলেন না। তিনি বিজেপির সাংসদ ছিলেন। ক্রিকেটে ফেরার আগে রাজনীতি ছেড়ে আসেন।
সমস্যা হয়েছিল গ্রেগ চ্যাপেলের
ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম আলোচিত পর্ব হচ্ছে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের জমানা। তাঁর আমলেই সরানো হয়েছিল অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। প্রথমে নেতৃত্ব থেকে পরে দল থেকেও সরানো হয়েছিল তাঁকে। দল নির্বাচনে সেই সময় নাক গলাতে দেখা যেত কোচ চ্যাপেলকে। তাঁর ইচ্ছাতেই অধিনায়ক হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল ভিভিএস লক্ষ্মণকে। তরুণ ক্রিকেটারদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল সৌরভ, লক্ষ্মণদের সরিয়ে। পরে যদিও সৌরভকে ফেরানো হয়েছিল। তাঁকে ২০০৭ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের দলেও রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভারত সেই বিশ্বকাপে মুখ থুবড়ে পড়ে। সরানো হয় কোচ চ্যাপেলকে। যে ঘটনার পর শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, “ক্রিকেটে যে দেবতারা বিচরণ করেন, তাঁদের মাটিতে নামিয়ে আনার জন্য ক্রিকেটের ঈশ্বর গ্রেগ চ্যাপেলকে পাঠিয়েছিলেন, তিনিও ব্যর্থ হলেন।”
সরতে হয়েছিল অনিল কুম্বলেকেও
ভারতের হয়ে টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখনও অনিল কুম্বলের দখলে। কিন্তু তিনি কোচ হওয়ার পর অধিনায়ক বিরাট কোহলির সঙ্গে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। কুম্বলে জমানায় ভারত একের পর এক টেস্ট সিরিজ় জিতলেও অধিনায়কের সঙ্গে বনিবনা হয়নি তাঁর। ভারতীয় দলের একাধিক ক্রিকেটার নাকি সেই সময় বোর্ডের কাছে কুম্বলের কড়া শাসনের বিরুদ্ধে চিঠি লিখেছিলেন। এক বছরের জন্য কোচ করা হয়েছিল কুম্বলেকে। কিন্তু পুরো এক বছর থাকতে পারেননি তিনি। ২০১৬ সালের ২৪ জুন দায়িত্ব নিয়েছিলেন কুম্বলে। পরের বছর ২০ জুন দায়িত্ব ছাড়েন। অর্থাৎ, এক বছর পূর্ণ হওয়ার চার দিন আগেই সরে যান কুম্বলে। দায়িত্ব ছাড়ার সময় কুম্বলে সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “গত কালই প্রথম বার জানতে পেরেছি, আমার প্রশিক্ষণের ধরন পছন্দ নয় অধিনায়কের। শুনে আমি অবাক হয়েছি। কারণ কোচ এবং অধিনায়কের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক থাকা উচিত, আমি তা মেনে চলার চেষ্টা করেছি সব সময়। অধিনায়কের সঙ্গে আমার সম্পর্কের উন্নতি করার চেষ্টা বোর্ড করেছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার মনে হয় সরে যাওয়াই উচিত। কোনও সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পেশাদারিত্ব, সততা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। কোচ হিসাবে আমার উচিত দলের ভুলগুলো সামনে নিয়ে আসা। তাতে দলের উন্নতি হয়। কারও যদি এটা মেনে নিতে সমস্যা হয়, তা হলে বোর্ড এমন কাউকে দায়িত্ব দিক, যার সঙ্গে সমস্যা হবে না।” চ্যাপেল পেরেছিলেন অধিনায়ককে সরিয়ে দিতে, কুম্বলে নিজেই সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই কোচের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
অধিনায়ক বিরাট কোহলির সঙ্গে সমস্যা হয়েছিল কোচ অনিল কুম্বলের। —ফাইল চিত্র।
গম্ভীর জমানার সূচনা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পর রাহুল দ্রাবিড় আর ভারতীয় দলের কোচ থাকতে রাজি হননি। তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয় গৌতম গম্ভীরকে। ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার আগে তিনি আইপিএলে দু’টি দলের মেন্টর ছিলেন। দু’টি ক্ষেত্রেই আলাদা কোচ ছিল। ফলে কোচ হিসাবে আইপিএলে গম্ভীরের কতটা পরীক্ষা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টর হয়ে আইপিএল জেতেন। তার পরেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ। ক্রিকেটার হিসাবে সফল হলেও কোচ হিসাবে গম্ভীর কেমন তা আগে থেকে বোর্ডের পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৭ বছর পর এক দিনের সিরিজ় হারতে হয় ভারতকে। টি-টোয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কাকে যদিও হারায় তাঁর দল। এর পর দেশের মাটিতে বাংলাদেশের উপর দাপট দেখায়। কিন্তু নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে নাস্তানাবুদ হতে হয়। প্রথম বার ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জেতে কিউয়িরা। ভারত ১২ বছর পর ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হারে। ২৪ বছর পর টেস্টে চুনকাম হয়। একের পর এক লজ্জার মুখে পড়তে হয় গম্ভীর জমানায়।
কোচ গম্ভীরের অনভিজ্ঞতা
ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার আগে কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টর ছিলেন গৌতম গম্ভীর। —ফাইল চিত্র।
দ্রাবিড় ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার আগে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান ছিলেন। অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন। ভারত এ দলের কোচ ছিলেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন কোচ দ্রাবিড়। তার পর ভারতের সিনিয়র দলের দায়িত্ব পান তিনি। সেই সঙ্গে সহকারী হিসাবে তিনি যাঁদের পান, তাঁরাও জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ছিলেন। কোচিংয়ের পাঠ নিয়েছিলেন সেখানেই। গম্ভীরের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। তিনি নিজেই বেছে নিয়েছেন সহকারীদের। বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী বললেন, “ভারতীয় দলে সুযোগ পেতে হলে ক্রিকেটারদের বয়সভিত্তিক স্তর থেকে শুরু করতে হয়। রঞ্জি খেলতে হয়। সেখানে রান করলে তবে ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যায়। কোচদের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। দ্রাবিড় যেমন ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ছিলেন। তিনি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে কোচিং করিয়েছেন। তার পর ভারতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এটাই প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। হঠাৎ করে কেউ কোচ হয়ে গেলে তাঁর পক্ষে দল সামলানো মুশকিল হয়। মেন্টর আর কোচ তো এক নয়।”
আইপিএল থেকে আন্তর্জাতিক
গম্ভীর ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে লখনউ সুপার জায়ান্টস এবং কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টর ছিলেন। আইপিএল জিতেছিলেন কলকাতার মেন্টর হিসাবে। খেলোয়াড় জীবনে টি-টোয়েন্টি এবং এক দিনের বিশ্বকাপ জিতেছিলেন। আইপিএল জিতেছিলেন। তাঁকেই ভারতীয় দলের কোচ করা হয়। আইপিএল জয়ের পর টেস্ট দলের দায়িত্ব পান গম্ভীর। বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল বললেন, “আইপিএল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সম্পূর্ণ আলাদা। টি দিলীপ বাদে ভারতীয় দলের সাপোর্ট স্টাফেরা এর আগে আইপিএল দলে কোচিং করিয়েছেন। অভিষেক নায়ার এবং রায়ান টেন দুশখতে ছিলেন কেকেআরে। মর্নি মর্কেল ছিলেন লখনউয়ে। তাঁদের দেওয়া হয় ভারতীয় দলের দায়িত্ব। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই সাপোর্ট স্টাফেরা কতটা সফল হবেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”