১৯৮৩: ২৫ জুন, লর্ডসের ব্যালকনি। বিশ্বকাপ ভারতের।
ভারতীয় ক্রিকেটের ওয়ান ডে হাজার দুয়ারিতে কার্যত বিস্মৃত সেই নামটা— বার্বিস। উপেক্ষিত, অনুচ্চারিত সেই শহরই কিন্তু কপিল দেবের দলের মধ্যে প্রথম বিশ্বাস এনে দিয়েছিল, তাঁরাও পারেন! ২৫ জুন, ১৯৮৩-র লর্ডস ঘটত না যদি না ২৯ মার্চ, ১৯৮৩-র বার্বিস পথ দেখাত!
কিন্তু বার্বিসটা কোথায়? পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গায়ানায় অবস্থিত বার্বিস এক সময় ডাচ প্রজাতন্ত্রের কলোনি ছিল। রোহন কানহাইয়ের জন্মস্থান। যাঁর ‘ফলিং সুইপ’ শট দেখে ইডেন সম্মোহিত হত। সেখানেই কপিলের অনামী ভারতীয় দল হারিয়ে দিয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সেই প্রথম দেশের মাঠে ওয়ান ডে হারল অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বার্বিসের সেই ম্যাচের জন্য সপরিবার কপিলদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হেলিকপ্টারে। আর সকলকে চমকে দিয়ে হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্থা হয়েছিল দর্শকভর্তি স্টেডিয়ামের ভিতরে। বার্বিসে ভারতীয় বংশোদ্ভূতের সংখ্যা খুব বেশি ছিল। তাঁদের খুশি করতেই এমন রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হয়েছিল ভারতীয় দলের জন্য। কে জানত, ভারতীয় জনতার জন্য সেরা পুরস্কার অপেক্ষা করে রয়েছে। কে জানত, লর্ডস ফাইনালের সেরা অঘটনের ড্রেস রিহার্সাল হতে চলেছে অনামী এই কেন্দ্রে।
সেই সময় ভারতীয় ওয়ান ডে দল মানে যার প্রধান পরিচয়, ১৯৭৫ বিশ্বকাপে সুনীল গাওস্করের ৬০ ওভার খেলে করা মন্থরতম ৩৬। আর উল্টো দিকে কি না ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্ব ক্রিকেটে যারা বর্গি আক্রমণ চালাচ্ছে। তার উপরে ভারতীয়দের নিজেদের সংসারেই অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে। সদ্য গাওস্করকে সরিয়ে অধিনায়ক হয়েছেন কপিল। সেই নেতৃত্ব বদল নিয়ে কত নাটক! গাওস্করের অধীনে ইমরান খানের পাকিস্তানের কাছে দুরমুশ হয়ে ফিরেছে দল। সফরের শেষ দিকে কপিল ভেবেছিলেন, উত্তর ভারতের কয়েক জনে মিলে ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে সড়কপথে দেশে ফিরবেন। কিন্তু অন্যতম নির্বাচক কপিলকে আলাদা ডেকে বললেন, ‘‘প্লেনে ওঠো, মুম্বই যাও।’’
কপিল সেই নির্দেশ মতো মুম্বই পৌঁছলেন। বোর্ডের কনফারেন্সে আসতে বলা হল। নির্দেশ মতো হাজির হয়ে গেলেন কিন্তু তখনও কিছুই জানেন না। এর পরেই ভূত দেখার পালা। কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং গাওস্কর। বলে উঠলেন, ‘‘হ্যালো! কনগ্র্যাট্স ক্যাপ্টেন!’’ ক্যাপ্টেন? গাওস্কর মুচকি হেসে অভিনন্দন জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বোর্ড নয়, বিদায়ী ক্যাপ্টেন সানিই প্রথম সুসংবাদ দেন কপিলকে। তত দিনে দু’জনের সম্পর্কে ঠান্ডা স্রোতও বইতে শুরু করেছে।
তবু নিজেদের মধ্যে তৈরি হতে থাকা দূরত্বকে দূরে সরিয়ে বার্বিসের সেই ম্যাচে দুই কিংবদন্তিই ছিলেন জয়ের নায়ক। প্রথমে ব্যাট করে ভারত তোলে ৪৭ ওভারে ২৮২ রান। প্রাক টি-টোয়েন্টি যুগে, সাদা পোশাক আর লাল বলের ওয়ান ডে ক্রিকেটে যা ছিল আজকের দিনের সাড়ে তিনশোর সমান স্কোর। প্রতিপক্ষ বোলারের তালিকায় কারা? না, হোল্ডিং, রবার্টস, মার্শাল, উইনস্টন ডেভিস। তখনকার দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তিনশো রানের কাছাকাছি তোলার কথা ভাবার দুঃসাহস স্পাইডারম্যানও ভাবত না।
৬০ ওভারে ৩৬ নটআউটের জন্য আজীবন সমালোচিত গাওস্করের ১১৭ বলে ৯০ রানের ইনিংস ওয়ান ডে ওপেনিংয়ের টেমপ্লেট তৈরি করে দিয়ে যায়। আর চার নম্বরে নামা কপিলের ব্যাটে ৩৮ বলে ৭২ রানের হরিয়ানা হারিকেন আছড়ে পড়েছিল। সাতটি চার, তিনটি ছয় আর ১৯০-এর কাছাকাছি স্ট্রাইক রেট। বার্বিস তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল টানব্রিজ ওয়েলসের ১৭৫ নট আউটের মন্ত্র। গ্রিনিজ, হেনসরা থেমে যান ২৫৫-৯ স্কোরে। ভিভ রিচার্ডস ওই ম্যাচেও মদন লালের শিকার। কপিল পরে বলেছিলেন, তিরাশি অভিযানের শিরদাঁড়া তৈরি করে দিয়েছিল বার্বিস। সে দিন আবার ছিল হোলি। রঙের উৎসবের দিনেই ভিভ, লয়েডদের হারিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের রামধনু প্রথম বার ফুটে ওঠে ওয়ান ডে আকাশে।
এর পরে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে সবে লন্ডনের হোটেলে চেক-ইন করছে দল। এক স্থানীয় ভারতীয় এসে বলতে থাকেন, ‘‘ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের বাজির দর রাখছি ৬৬-১।’’ বলে চলেন, ‘‘খুব শীঘ্রই আপনাদের অভিযান শেষ হয়ে যাবে। সকলের পরিবার রয়েছে। আমাদের আবার দেখা হবে, অনেক ঘোরাঘুরির প্ল্যানও করা যাবে। দারুণ পিকনিক হবে।’’ কপিল আর চুপ থাকেননি। পাল্টা শুনিয়ে দেন, ‘‘কী রকম ভারতীয় আপনি? শুনুন, আমরা হারতে নয়, জিততে এসেছি।’’ বিশ্বকাপে একটাও বল হওয়ার আগে শোনা গিয়েছিল অধিনায়কের প্রত্যয়ী গলা। ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম ম্যাচে ফের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে শুরু হবে বিশ্বকাপ জয়যাত্রা। এর পরে টানব্রিজ় ওয়েলস এবং ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা রূপকথা। শোনা যায়, সে দিন স্কোরবোর্ডে ভারত যখন ৯ রানে চার উইকেট আর কপিল ব্যাট করতে যাচ্ছেন, মদন লালের স্ত্রী অনুর সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন কপিলের স্ত্রী রোমি দেব। তাঁদের দেখে মদন লাল বলে ওঠেন, ‘‘তোমরা কী করতে এসেছ? চলেই যাও। কী আর হবে এসে!’’
মানে ড্রেসিংরুমও আর আশা দেখছিল না। কপিল ক্রিজ়ে গিয়ে ঠিক করে নেন, নিরাপদে পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করতে হবে। প্যাভিলয়নে তখন অবিশ্বাস্য সব কাণ্ডকারখানা ঘটছে। গাওস্কর বার-কাউন্টারে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে নড়ছেন না। বলছেন, ‘‘এ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কপিলও ক্রিজ়ে আছে। থাকি না।’’ যশপাল শর্মা পা ভাঁজ করে বসেছিলেন। ব্যথা হয়ে যাচ্ছে পা, তবু নড়ছেন না। ভারতীয় দলের বাস ড্রাইভার পর্যন্ত একটা চেয়ারে এক পা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন কপিল ব্যাট করার সময়। আর পা নামাননি। ওদি্কে, রোমি দেব মদন লালের স্ত্রী অনুকে বললেন, ‘‘যত ক্ষণ না টিম বিপদ থেকে বেরোচ্ছে, আমরা লাঞ্চ করব না। আজ প্রার্থনার দিন।’’ ঘন অন্ধকারেও একাত্মতার আলো ছড়িয়ে পড়ার অসাধারণ, টুকরো-টুকরো সব ছবি!
লাঞ্চে ড্রেসিংরুমে ফেরা কপিলের সামনে মুখ দেখানোর জন্য সে দিন উপস্থিত হতে পারেননি কোনও সতীর্থ। কেউ এসে শুধু এক গ্লাস জল রেখে দিয়ে চলে গিয়েছিল। বোঝানোর চেষ্টা, আমাদের উপর বেশি রাগ না করে মাথা ঠান্ডা করো এই জলে। অধিনায়ক অবশ্য শুধুই অরেঞ্জ জুস পান করে মাঠে ফিরে গিয়ে যা রাগ, পুরোটাই জ়িম্বাবোয়ের বোলারদের উপর মেটান। লাঞ্চের পরে দুর্ধর্ষ প্রতিআক্রমণে লেখেন ১৭৫ নটআউটের মহাকাব্য।
টানব্রিজ ওয়েলস না থাকলে ২৫ জুনের লর্ডস হত না। তার আগে বার্বিস না ঘটলে কি আদৌ তৈরি হত লর্ডসের ইতিহাস? হাজার দুয়ারির প্রধান ফটকটাই হয়তো খুলতে দেরি হত!