ঋষভ পন্থ। ছবি: পিটিআই।
নিজের কয়েক সেকেন্ডের ভুলে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ঋষভ পন্থের জীবন। ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর ক্রিকেট ভবিষ্যৎ। ২০২২ এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে টেস্ট সিরিজ় খেলে দেশে ফেরার চার দিন পরের সেই দুর্ঘটনার অভিঘাতে দুমরে যাওয়া স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেয়নি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। পন্থকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চেষ্টার কসুর করেননি জয় শাহেরা। তরুণ উইকেটরক্ষক-ব্যাটারও হাল ছাড়েননি। ৬৩২ দিন পর টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে চেন্নাইয়ের কঠিন পিচে শতরান করে পন্থ বুঝিয়ে দিলেন জলে যায়নি বোর্ডের চেষ্টা।
মিরপুরে খেলা শেষ টেস্টে ৭ রানের জন্য শতরান হাতছাড়া হয়েছিল। চেন্নাইয়ে সেই নাজমুল হোসেন শান্ত, শাকিব আল হাসানদের বিরুদ্ধেই ১০৯ রানের ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়লেন রুরকির তরুণ। ভারতীয় উইকেটরক্ষকদের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সবচেয়ে বেশি ছ’টি শতরানের নজির ছুঁয়ে ফেললেন পন্থ। বুঝিয়ে দিলেন ভারতীয় দলে উইকেটরক্ষকের জায়গার হক তাঁরই। ১২৮ বলের ইনিংসে ১৩টি চার, ৪টি ছক্কা। স্ট্রাইক রেট ৮৫.১৫। কয়েক মাস আগে বেন স্টোকসেরা ভারতে টেস্ট খেলতে এসে ‘বাজ়বল’ নিয়ে নানা কথা বলেছিলেন। রোহিত শর্মা উত্তরে শুধু বলেছিলেন, ‘‘ওরা বোধহয় ঋষভ পন্থ নামে এক জনের খেলা দেখেনি।’’ রোহিতের উত্তর যে অতিরঞ্জিত ছিল না, প্রথম সুযোগেই বুঝিয়ে দিলেন পন্থ। রাহুল দ্রাবিড়ের দলে ‘বাজ়বল’ তত্ত্ব ছিল না। গৌতম গম্ভীরের দলেও নেই। তাঁদের দলে পন্থ ছিলেন। আছেন। লাল বলের ক্রিকেটে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী উজিয়ে এসে কারও পরামর্শ দেওয়ার দরকার হয় না।
দুর্ঘটনায় ডান হাঁটুর প্রতিটি লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় তিনি নিজেও ভেবেছিলেন, হয়তো বাঁচবেন না। সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসক এবং বিসিসিআইকে পন্থ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় জীবন দেওয়ার জন্য। মনের জোরে বিদায় জানিয়েছেন সঙ্গী হয়ে যাওয়া হুইলচেয়ার, ক্রাচকে। মাটিতে পা ফেলেছেন যন্ত্রণা উপেক্ষা করে। এক পা এক পা করে হাঁটার চেষ্টা করেছেন। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ধাপে ধাপে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে। অনিশ্চিত ক্রিকেট ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করেছেন। চিকিৎসকদের কৃতিত্ব অস্বীকার করার জায়গা নেই। কৃতিত্ব কম নয় ২৭ বছরের তরুণেরও। মনে করা হয়েছিল, তাঁর মাঠে ফিরতে অন্তত ১৮ মাস সময় লাগবে। পন্থ সেটা তিন মাসে করে দেখিয়ে ছিলেন!
হাসপাতালের বিছানা থেকে ২২ গজে ফিরে আসার সেই অধ্যায়টা সহজ ছিল না। কঠিন ছিল বললেও কম বলা হয়। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে গাড়ি চালিয়ে রুরকির বাড়ি ফেরার সময় ক্লান্ত পন্থ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মার্সিডিজ় ধাক্কা মেরেছিল ডিভাইডারে। আগুন ধরে যাওয়া গাড়ির কাচ ভেঙে স্থানীয়েরা উদ্ধার করেছিলেন তাঁকে। প্রথমে স্থানীয় এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে বিসিসিআইয়ের উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মুম্বইয়ের অত্যাধুনিক হাসপাতালে। গুরুতর আহত পন্থকে দেখে প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকেরা বলতে পারেননি, তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। দুর্ঘটনায় মাথায়, পিঠে, হাঁটুতে চোট তো ছিলই। শরীরে কিছু অংশ ঝলসেও গিয়েছিল। আড়াই মাসের বেশি হাসপাতালে কাটাতে হয় পন্থকে। একাধিক বার অস্ত্রোপচার, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ২৮০টি সেলাই! সংশয় তৈরি হয়েছিল, পাড়ার মাঠেও কি ক্রিকেট খেলতে পারবেন পন্থ? অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। সেই অবিশ্বাসকে পন্থ পরাস্ত করেছেন মনের জোরে।
আইপিএলের সময় ৪৫৪ দিন পর মাঠে ফিরেছিলেন পন্থ। আইপিএলের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। আইপিএলে একাধিক ম্যাচে চেনা ফর্মে ব্যাট করেছিলেন। স্বচ্ছন্দে উইকেট রক্ষা করেছিলেন। প্রথম দিকে উইকেট রক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা ছিল। দ্রুত সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রতি ম্যাচে ভরসা দিয়েছিলেন রোহিত-দ্রাবিড়দের। তার পর টেস্ট ক্রিকেটেও এ ভাবে ফিরে আসা। পন্থ নিজেকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিচ্ছেন সব ধরনের ক্রিকেটে। এমন প্রত্যাবর্তন বোধহয় রূপকথাতেই সম্ভব। পন্থের লড়াই কিন্তু রূপকথা নয়। বাস্তব। কঠিন বাস্তব। চেন্নাইয়ের পিচের মতোই কঠিন বাস্তব। জীবনযুদ্ধের কাহিনি।
পন্থ ধ্রুপদী ক্রিকেটে ফিরলেন। বিরতির আগের ফর্মেই ফিরলেন। মৃত্যুর মুখ থেকে যিনি জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পারেন, তাঁর কাছে চিপকের ২২ গজ এমন কী কঠিন প্রতিপক্ষ! ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এটাও ৬৩২ দিন! চ্যাম্পিয়নেরা বোধহয় এ ভাবে অঙ্ক মেলান।