ফাইল চিত্র।
চাইলে কিছু না করে, পায়ের উপর পা তুলে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো মনসুর আলি খান পটৌডির সারা জীবন কাটতে পারত পায়ের উপর পা তুলে। কিন্তু টাইগার (এই নামেও পরিচিত ছিলেন পটৌডি) সে বান্দা নন। বাবার মতো তিনিও ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন। নিজের লক্ষ্যে এতটাই স্থির ছিলেন যে দুর্ঘটনায় একটি চোখ হারালেও তাঁর ক্রিকেটার হওয়া আটকানো যায়নি।
পটৌডির যখন ১১ বছর বয়স সেই সময় মারা যান তাঁর বাবা ইফতিখার আলি খান। তিনিও ছিলেন ক্রিকেটার। ইংল্যান্ড এবং ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। ভারতকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন নবাব। তাঁর মৃত্যুর পর নবাবের আসনে বসেন মনসুর। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজা। শোনা যায় সেই হাবভাব ছিল তাঁর চলনেও। কিন্তু তাই বলে ক্রিকেটকে অবহেলা করেননি কখনও। উইনচেস্টারে স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় ভেঙে দিয়েছিলেন ডগলাস জারডিনের রেকর্ড। এক মরসুমে করেছিলেন ১০৬৮ রান। তার আগেই অভিষেক ঘটে গিয়েছে কাউন্টি ক্রিকেটে। সাসেক্সের হয়ে ব্যাট করতে নেমেছেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। বাবার দল অক্সফোর্ডের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। পটৌডি ছিলেন অক্সফোর্ডের প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক।
বিদেশের মাটিতে ক্রিকেট খেলে বড় হওয়া পটৌডির ভারতীয় দলে ডাক পাওয়া যখন সময়ের অপেক্ষা সেই সময়েই ঘটে অঘটন। ১৯৬১ সালের ১ জুলাই ইংল্যান্ডে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পটৌডির চোখে কাঁচ ঢুকে যায়। চিকিৎসক ডেভিড রবার্ট বাঁ চোখ বাঁচাতে পারলেও, ডান চোখটি নষ্ট হয়ে যায় নবাবের। অন্য কেউ হলে হয়তো ক্রিকেট কেরিয়ারের ওখানেই ইতি ঘটে যেত। কিন্তু তিনি তো ‘টাইগার’। খোঁচা বাঘ তো হিংস্র হবেই। মাঠে নেমে পড়লেন পটৌডি। টুপিটা ডান চোখের উপর টেনে নিলেন। শিখে গেলেন এক চোখ নিয়ে কী ভাবে খেলতে হবে।
সময় লাগল মাত্র ছ’মাস। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জার্সি পরলেন নবাব। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিল্লির মাঠে অভিষেক ঘটল পটৌডির। সেই ম্যাচে মাত্র ১৩ রান করলেন তিনি। ম্যাচ ড্র করল ভারত। পরের ম্যাচ কলকাতায়। ইডেনের মাঠে দ্বিতীয় ম্যাচ। এল অর্ধশতরান। প্রথম ইনিংসে ৬৪ রান পরের ইনিংসে ৩২। সিরিজে ১-০ এগিয়ে গেল ভারত। শেষ ম্যাচ চেন্নাইতে। এল প্রথম টেস্ট শতরান। ১০৩ রানের ইনিংস খেললেন পটৌডি। প্রথম বার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জিতল ভারত।
পরের সিরিজেই সহ-অধিনায়ক ঘোষণা করে দেওয়া হল পটৌডিকে। সেই সময় ভারতের অধিনায়ক নারি কন্ট্রাক্টর। কিন্তু অনুশীলন ম্যাচ খেলতে গিয়ে চোট পান তিনি। নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ চলে আসে পটৌডির সামনে। সেই সিরিজের তিনটি ম্যাচেই নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রথম ম্যাচে টসে নামার সময় বয়স মাত্র ২১ বছর ৭৭ দিন। বিশ্বের কনিষ্ঠতম অধিনায়ক হওয়ার রেকর্ড গড়লেন তিনি। পরবর্তী সময় যে রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন জিম্বাবোয়ের টাটেন্ডা টাইবু। ভারতের কনিষ্ঠতম অধিনায়ক এখনও তিনিই। জীবনে ৪৬টি টেস্ট খেলেছেন পটৌডি। তার মধ্যে ৪০টি টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
মাঠের ভিতরে পটৌডির আগ্রসন, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যখন তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, মাঠের বাইরে তাঁর মহিলা ভক্তের সংখ্যা সেই অনুপাতেই বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। এখনকার সময় ক্রিকেট এবং বলিউড যে ভাবে মিশে গিয়েছে তা শুরু হয়েছিল পটৌডির হাত ধরেই। অভিনেত্রী সিমি গরেওয়ালের প্রেমে হাবুডাবু খাচ্ছেন নবাব। তাঁর খেলা দেখতে মাঠে পৌঁছে যাচ্ছেন সিমি। এমন সময় নবাবের সঙ্গে হঠাৎ দেখা বঙ্গতনয়া শর্মিলা ঠাকুরের। প্রথম দেখাতেই প্রেম। সেই প্রেম এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে সিমির সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতেও পিছ পা হলেন না। খানিক টালবাহানার পর শর্মিলা সায় দিতেই সটান হাজির হয়ে গেলেন সিমির বাড়িতে। জানিয়ে দিলেন তিনি শর্মিলার প্রেমে পড়েছেন। এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে নেই।
প্রেম পরিণত হল বিয়েতে। একে একে জন্ম নিলেন সইফ আলি খান, সাবা আলি খান এবং সোহা আলি খান। তাঁরা বাবার মতো ক্রিকেট নয়, মায়ের মতো বলিউডকেই বেছে নিয়েছেন নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে। শর্মিলার সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল চিরজীবনের। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলেন তাঁরা। ২০১১ সালে শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন নবাব। সেই বছর ২২ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর।
এক সাক্ষাৎকারে পটৌডি বলেন, “আমাকে কেন টাইগার বলা হত জানি না। ছোটবেলায় চার পায়ে হাঁটার চেষ্টা করতাম বলে হয়তো। আর কোনও কারণ ছিল না।” তিনি না জানলেও সত্যিই টাইগার ছিলেন তিনি। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।