গুরুদক্ষিণা: ওয়ান ডে সিরিজ জেতার পর শাস্ত্রীর সঙ্গে ঋষভ। ফাইল চিত্র।
‘বিগবেন’ স্টোকসের হুঙ্কারকে অশনি সঙ্কেত হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন রবি শাস্ত্রী। তবে প্রিয় বন্ধু ওয়াসিম আক্রমের সঙ্গে একমত নন তিনি। ক্রিকেটারদের ধকল কমাতে তিনি চান না পুরোপুরি ওয়ান ডে তুলে দেওয়া হোক। ‘‘না, না। ভুলে গেলে চলবে না পঞ্চাশ ওভারের ওয়ান ডে চ্যাম্পিয়নকেই কিন্তু এখনও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বলা হয়,’’ শুক্রবার ভারতীয় সময় দুপুরে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ফোনে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বলছিলেন শাস্ত্রী। ‘‘বিশ্বকাপ রাখতেই হবে। আর বিশ্বকাপ রাখতে গেলে পুরোপুরি ওয়ান ডে ফর্ম্যাট তুলে দেওয়া সম্ভব কী ভাবে!’’ প্রশ্ন তাঁর।
শাস্ত্রীয় ফর্মুলা তা হলে কী? দ্রুত জবাব এল, ‘‘বিশ্বকাপ রাখো। পঞ্চাশ ওভারের, টি-টোয়েন্টি দু’টো বিশ্বকাপই থাকুক। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় কমিয়ে দেওয়া হোক। আমি তো এ কথা সাত বছর ধরে বলে চলেছি।’’ তার পরেই যোগ করলেন, ‘‘দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে-তে কী হচ্ছে, সেই ফল কেউ মনে রাখে না। কিন্তু বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন কে, গড়গড় করে লোকে বলে দিতে পারবে।’’
কে বলছেন? না, যাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে দু’টো বিশ্বমানের ট্রফি রয়েছে। তিরাশিতে কপিল দেবের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। পঁচাশিতে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজ়েস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতা দলের স্তম্ভই শুধু নন, ঐতিহাসিক চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স এবং আউডি গাড়ি-জয়ী অলরাউন্ডার। শাস্ত্রীয় প্রেসক্রিপশন অবশ্য এখানেই শেষ হচ্ছে না। তাঁর আরও দাওয়াই, ‘‘দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় কমিয়ে আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ বাড়িয়ে দাও। দরকার হলে দু’টো আইপিএল করো। আরও অন্যান্য দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ বাড়তে দাও। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ কিন্তু লোকে ভীষণ ভাবেই দেখে। আইপিএলের সাফল্য সেটাই প্রমাণ করে।’’
ভারত বনাম ইংল্যান্ড সিরিজ়ের পরে শাস্ত্রী এখন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জস বাটলারদের ওয়ান ডে সিরিজ়ে স্কাই স্পোর্টসের হয়ে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। স্টোকসের বিদায়ী ওয়ান ডে ম্যাচে কমেন্ট্রি বক্সে ছিলেন। শুক্রবার দ্বিতীয় ম্যাচ বৃষ্টিতে বন্ধ ছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে সকাল থেকেই অবশ্য বৃষ্টি হচ্ছিল। শাস্ত্রী বলছিলেন, ‘‘যত বার এখানে আসি, সেই কথাটাই মনে পড়ে। ম্যাঞ্চেস্টার না রেনচেস্টার।’’ শুক্রবার শাস্ত্রীয় বচন শুনতে শুনতে যদিও মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট আকাশেও মেঘ দেখছেন রেনচেস্টার থেকে। স্টোকস ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরে গেলেন বলেই যেন মনে হচ্ছে। বলে ফেললেন, ‘‘স্টোকসের বিদায়ী বার্তা কিন্তু ওয়েক আপ কল। এর পরেও কর্তাদের ঘুম না ভাঙলে বিপদ আসন্ন।’’ নিজস্ব সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতেই এর পরে বিরাট কোহলিদের সংসারে সাত বছর কাটিয়ে যাওয়া প্রাক্তন কোচ সতর্ক করে দিচ্ছেন, ‘‘কথাটা কী বলেছে স্টোকস, তা এক বার ভেবে দেখুন। ক্রিকেটারেরা কোনও গাড়ি নয় যে, পেট্রল ভরে ছোটাতে থাকবে। কতটা ভিতর থেকে অনুভব করলে এমন করে গর্জে উঠতে পারে!’’ শাস্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘স্টোকসের বয়স কত? ৩১! কিছুই না। তবু ও-ই এমন কথা বলছে। তার মানে কর্তাদের বোঝার সময় হয়েছে, অতিরিক্ত ক্রিকেটের বোঝা কী ভাবে ফাঁস হয়ে চেপে বসছে ক্রিকেটারদের গলায়। এর থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজতেই হবে।’’
শাস্ত্রীকে অতীতে ক্রিকেটারদের সংস্থার মুখ হিসেবে দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৩ বিশ্বকাপের আগে যখন ভারতীয় বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ধুন্ধুমার বেধেছিল সচিন-সৌরভদের, তখন প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। টাইগার পটৌডি, অরুণ লালের সঙ্গে শাস্ত্রী সেই সংস্থার শীর্ষ কর্তা হয়েছিলেন। বোর্ডের মসনদে তখন জগমোহন ডালমিয়া। শাস্ত্রী টিভিতে ধারাভাষ্য দিতে দিতে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, ‘‘মিস্টার ডালমিয়া, ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখাই আপনাদের দায়িত্ব!’’ সন্দেহ নেই, পেট্রল ভরে গাড়ি ছোটানোর নতুন বিতর্কে তিনি স্টোকসের পক্ষ নেবেন।
তাঁর সওয়াল, ‘‘মানুষ কোনটা চাইছে, তা মাথায় রাখতে হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ লোকে উপভোগ করছে। আর দেখতে চায় বিশ্বকাপ। তাই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ়ের উপরে কাঁচি চালানো ছাড়া উপায় নেই।’’ এক নিঃশ্বাসে যোগ করছেন, ‘‘ক্রিকেটারদের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত করে দিয়ে কী হবে? এই যে স্টোকসের মতো এক জন তারকা চলে গেল। এর পরে আরও এমন তারকা যদি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়? তাতে তো ক্রিকেট খেলাটারই ক্ষতি।’’ মনে করিয়ে দিতে চান, ‘‘কোভিডের জন্য এখনও অনেক জায়গাতেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এখনও জৈব সুরক্ষা বলয়ে থাকতে হচ্ছে ক্রিকেটারদের। তার একটা মানসিক ধকল আছে। দিনের পর দিন এই ধকল নেওয়া সহজ নয়।’’ ফর্ম খুঁজতে থাকা কোহলিকেও এ জন্যই বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রাক্তন কোচ।
এই ম্যাঞ্চেস্টারেই ক’দিন আগে দুরন্ত সেঞ্চুরিতে দলকে জেতানোর পরে ম্যাচের সেরা ঋষভ পন্থের তাঁর হাতে ‘গুরুদক্ষিণা’ হিসেবে শ্যাম্পেন তুলে দেওয়ার ভিডিয়ো টুইটারে সুপারহিট। মঞ্চে পুরস্কার নেওয়ার সময় কোহলিরাও একই ভাবে শ্যাম্পেন উৎসর্গ করছিলেন তাঁর উদ্দেশে। তিনি কোচ থাকাকালীনই যে ভারতীয় দল ২-১ এগিয়ে ছিল টেস্ট সিরিজ়ে। ছেলেরা যে ভুলে যায়নি, তা দেখে কেমন লাগল? কী মনে হচ্ছিল, যখন ঋষভ ছুটতে ছুটতে এসে শ্যাম্পেনটা আপনার হাতে তুলে দিলেন? প্রাক্তন কোচ কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন? শাস্ত্রী মুহূর্তটাকে ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে রাখতে চান। তাই বিশদ প্রতিক্রিয়ায় গেলেন না। তৃপ্ত গুরুর সুরে অস্ফুটে শুধু বলে গেলেন, ‘‘ছাত্রদের দেওয়া স্বীকৃতিই তো সেরা স্বীকৃতি!’’
উদ্ধত ভারতীয় ক্রিকেটের এই প্রজন্ম গুরুজনকে সম্মান করতে জানে না, কে বলল!