দিল্লিতে বাংলাদেশের উইকেট পড়ার পর উল্লাস ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ছবি: সমাজমাধ্যম।
এই ভারতীয় দল গৌতম গম্ভীর, সূর্যকুমার যাদবের দল। এই দলের মনে ভয় বলে বোধহয় কিছু নেই। নইলে ব্যাট করতে নেমে পাওয়ার প্লে-র মধ্যে ৪১ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে কোনও দল ভাবতে পারে ২২১ রান করতে পারবে। এই দল পারে। কারণ, এই দলে রিঙ্কু সিংহ, হার্দিক পাণ্ড্যেরা রয়েছেন। দলে এসেছেন নীতীশ রেড্ডির মতো ক্রিকেটার। ম্যাচের যে কোনও পরিস্থিতিই হোক না কেন, খেলার ধরন তাঁরা বদলান না। দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে সেটাই দেখা গেল।
টি-টোয়েন্টিতে রান করার সবচেয়ে ভাল সময় পাওয়ার প্লে ও ডেথ ওভার। সেই ১০ ওভারে ভারত করল ১০১ রান। উইকেট পড়ল আটটি। মাঝের ১০ ওভারে ১২০ রান করল তারা। মাত্র এক উইকেট পড়ল। মাঝের এই ১০ ওভারেই ম্যাচ হেরে গেল বাংলাদেশ। গোয়ালিয়রের পরে দিল্লিতে ৮৬ রানে ম্যাচ জিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ও জিতে নিল ভারত। রবিবার হায়দরাবাদে সিরিজ় চুনকামের লক্ষ্যে নামবেন সূর্যেরা।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ের আগে হাতে একটি ট্যাটু করিয়েছেন রিঙ্কু। তাতে লেখা, ‘ঈশ্বরের পরিকল্পনা।’ সত্যিই তো তাই। তিনি ক্রিকেট খেলতে ভালবাসেন। মাঠে নামতে ভালবাসেন। যত ক্ষণ মাঠে থাকেন, ছটফট করেন। রিঙ্কু জানেন, তাঁর কাজ ভাল খেলা। বাকিটা ঈশ্বরের পরিকল্পনা। আর তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পেয়েও হতাশ হন না তিনি। হেসে বলেন, “আমার কাজ খেলা। দলে জায়গা পাওয়া তো আমার হাতে নেই। তবে রোহিত (শর্মা) ভাই বলেছে, ভবিষ্যতে অনেক বিশ্বকাপ আমি খেলব।” সত্যিই তিনি খেলবেন। তিনি হচ্ছেন এই দলের ক্রাইসিস ম্যান। যখন ১০ ওভারে ১০০ রান হবে, তিনি প্যাড পরে ডাগ আউটে বসে থাকবেন। হয়তো নামারই সুযোগ পাবেন না। কিন্তু যখন দলের রান ৩০ রানে ৩ উইকেট, রিঙ্কুর ডাক পড়বে। তিনি নামবেন। খেলবেন। দলকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বার করবেন। ম্যাচ জেতাবেন। আবার চুপচাপ নিজের সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে-পরে রিঙ্কুর সময়টা তেমন ভাল যায়নি। তেমন সুযোগ পাননি। দিল্লির এই ম্যাচ তাঁকে সেই সুযোগ করে দিল। আরও এক বার চার-ছক্কার ক্রিকেটে সকলে দেখল, ক্রিকেটের ব্যকরণ মেনে শট খেলেও ২০০-র স্ট্রাইক রেটে রান করা যায়। রিঙ্কু এই ম্যাচে সঙ্গে পেলেন নীতীশকে। সবে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। দেখে মনে হল না। আসলে আইপিএলের দৌলতে এখন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তৈরি হয়েই নামেন।
টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি রান হয় দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে। প্রথম ইনিংসে গড় রান ২৩৫। সেই উইকেটে কিন্তু শুরুটা ভাল হয়নি ভারতের। প্রথম ওভারে ১৫ রান হলেও পাওয়ার প্লে-তে পেসারদের বল খেলতে সমস্যা হল ব্যাটারদের। বেশ কিছু বল উইকেটে থেমে আসছিল। ভারতের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটার সঞ্জু স্যামসন, অভিষেক শর্মা ও অধিনায়ক সূর্য বলের গতি ভালবাসেন। কিন্তু সেটা পাচ্ছিলেন না তাঁরা। ফলে সঞ্জু ১০, অভিষেক ১৪ ও সূর্য ৮ রান করে ফিরলেন।
সেখান থেকে খেলা ধরলেন রিঙ্কু ও নীতীশ। শুরুতে একটু সাবধানে খেললেও কয়েক বল পর থেকেই বড় শট মারা শুরু করলেন তাঁরা। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্পিনারদের রেয়াত করেননি দুই ব্যাটার। মেহেদি হাসান মিরাজ ও রিয়াদ হোসেন অনেক রান দিলেন। বেশি আক্রমণাত্মক খেলছিলেন নীতীশ। অর্ধশতরান করার পরে প্রতিটি বলে বড় শট মারার চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞ মুস্তাফিজুর রহমানের বলে ৩৪ বলে ৭৪ রান করে আউট হন তিনি। রিঙ্কু ও নীতীশের মধ্যে ১০৮ রানের জুটি হয়।
জুটি ভাঙলেও রান তোলার গতি কমেনি ভারতের। রিঙ্কু ছক্কা মেরে অর্ধশতরান করেন। তার পরেই আবার ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হন তিনি। ২৯ বলে ৫৩ রান করেন কেকেআরের ব্যাটার। হার্দিক আগের ম্যাচের ছন্দেই খেলছিলেন। এই ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পান রিয়ান পরাগ। তিনিও শুরু থেকে হাত খোলেন। শেষ দিকে পর পর উইকেট পড়ে ভারতের। রিয়ান ১৫ ও হার্দিক ৩২ রান করেন। তাঁরা থাকলে আরও ২০ রান বেশি হত ভারতের। শেষ পর্যন্ত ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২২১ রান করে ভারত।
জবাবে বাংলাদেশের শুরুটা খারাপ হয়নি। প্রথম ওভারে আরশদীর সিংহের বলে ১৪ রান করেন পারভেজ হোসেন ইমন। দেখে মনে হচ্ছিল, লড়াই করবে বাংলাদেশ। কিন্তু ঠিক তখনই নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান আরশদীপ। নিজের দ্বিতীয় ওভারে ইমনকে বোল্ড করেন তিনি। প্রথম ম্যাচে ঠিক একই ভাবে বোল্ড হয়েছিলেন ইমন। লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত পেসারদের বল ভাল খেলছিলেন। তা দেখে পাওয়ার প্লে-র মধ্যেই স্পিনারদের হাতে বল তুলে দেন সূর্য। তাতেই খেলা ঘুরে যায়।
প্রথম ওভারে ১১ রানের মাথায় শান্তকে আউট করেন ওয়াশিংটন সুন্দর। পাওয়ার প্লে-র মধ্যে আরও একটি উইকেট হারায় বাংলাদেশ। লিটনকে ১৪ রানে আউট করেন বরুণ চক্রবর্তী। তৌহিদ হৃদয়ের উইকেট নেন অভিষেক শর্মা। বাংলাদেশের স্পিনারের মিলে যেখানে ৮ ওভারে ১১৬ রান দিয়েছেন সেখানেই ভারতের স্পিনারের ভাল বল করেন। ৯ ওভারে ৪৯ রান দিলেন। নিলেন ৫টি উইকেট। এই পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত, দু’দলের স্পিনারদের দক্ষতার কতটা তফাত।
১০ ওভারে ৭০ রান ছিল বাংলাদেশের। ক্রিজ়ে ছিলেন মাহমুদুল্লা ও মেহেদি। মাহমুদুল্লার এর পরে আর একটিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলবেন। ৩৮ বছর বয়স হয়েছে তাঁর। মেহেদি দলের সেরা অলরাউন্ডার হলেও এই পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা তাঁরও ছিল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল। পরাগ নিজের প্রথম ওভারেই ফেরালেন মেহেদিকে। পার্ট টাইম বোলারেরা উইকেট নিচ্ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, ম্যাচ ধীরে ধীরে বাংলাদেশের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এই ম্যাচেও সকলের নজর ছিল মায়াঙ্ক যাদবের উপর। ঘরের মাঠে খেলতে নেমেছিলেন তিনি। দশম ওভারে বল করতে আসেন তিনি। প্রথম ওভারে উইকেট না পেলেও বলের গতিতে নজর কাড়ছিলেন। দ্বিতীয় ওভারে জাকের আলি তাঁর বল সামলাতেই পারলেন না। ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন। বলের গতি দেখাল ১৪৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। মায়াঙ্কের বলের গতি থাকলেও আরও একটু নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। গতির কারণে যিনি ভারতীয় দলে ঢুকেছেন তাঁর উচিত জোরে বল করা। নিজের শেষ ওভারের প্রথম বল তিনি করলে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে। পরের বলটিই করার চেষ্টা করলেন ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার গতিতে। তার ফলে বলের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন মায়াঙ্ক। তা হলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবেন তিনি।
পর পর উইকেট পড়ায় একটা সময় বাংলাদেশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ২০ ওভার ব্যাট করা। হারের ব্যবধান যতটা সম্ভব কমানো। মাহমুদুল্লা মাঝেমধ্যে দু’একটি বড় শট মারছিলেন। তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি বাংলাদেশের। ব্যাট হাতে ৭৪ রান করার পাশাপাশি বল হাতে উইকেটও নেন নীতীশ। এই ম্যাচে সাত বোলারকে দিয়ে বল করান সূর্যকুমার। সকলেই উইকেট নেন। শেষ পর্যন্ত ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১৩৫ রানে শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস। ৮৬ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ় জেতে ভারত।