তামিম ইকবাল। — ফাইল চিত্র
নিজেদের ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে এত দিন বড়াই করত বাংলাদেশ। সমর্থকদের এ নিয়ে ছিল গর্ব। কিন্তু সেই দেশের ক্রিকেটে গত ৭২ ঘণ্টায় যা দেখা গেল, তা নাটকের থেকে কোনও অংশে কম নয়। দেশের এক দিনের ক্রিকেট অধিনায়ক তামিম ইকবালের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য, একটি এক দিনের ম্যাচ খেলেই আচমকা চোখের জলে অবসর, তার ৩০ ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই অবসর ভেঙে বেরিয়ে আসা— নাটকের উত্তেজনা কোনও অংশে কম ছিল না। দিনের শেষে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। তিন মাসও বাকি নেই বিশ্বকাপের। তার আগে এ ধরনের ঘটনা দলের মানসিকতায় প্রভাব ফেলবে কি না, তা সময়ই বলবে।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত যে নাটকের পর নাটক চলল, তা ফিরে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন:
মঙ্গলবার
আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এক দিনের ম্যাচ ছিল বুধবার। তার আগে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন অধিনায়ক তামিম। সেখান থেকে বিতর্কের সূত্রপাত হবে, এটা অনেকেই ভাবেননি। মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ওই সাংবাদিক বৈঠকে তামিম বলেছিলেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তবে তা সত্ত্বেও তিনি খেলবেন। তামিম বলেছিলেন, “আমি অবশ্যই বুধবারের ম্যাচের জন্য তৈরি। শরীর আগের চেয়ে ভাল আছে। তবে এটা বলব না যে আমি পুরোপুরি ফিট। বুধবার ম্যাচ খেলার পর ভাল করে বুঝতে পারব যে কী অবস্থায় রয়েছি। তবে এখনও পর্যন্ত আমার যা অবস্থা তাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি খেলছি।” অর্থাৎ দলের অধিনায়ক নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি পুরোপুরি সুস্থ না হয়েও মাঠে নামছেন।
এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন, “এটা তো পাড়ার ম্যাচ নয়! আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এমন সিরিজ়ের আগের দিন অধিনায়ক বলছে সে ফিট নয়। কিন্তু খেলবে, খেলে নিজের ফিটনেস বোঝার চেষ্টা করবে। এটা তো কোনও পেশাদার ক্রিকেটারের আচরণ হতে পারে না!”
তামিমের এই ‘চোট নিয়েও খেলব’ বক্তব্য ভাল ভাবে নেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যানেজমেন্টও। বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমের খবর ছিল, অধিনায়কের উপর রেগে যান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহ। বুঝিয়ে দেন, এক জন ক্রিকেটার পুরো ফিট না হলে তাঁকে খেলতে নামানোর পক্ষপাতী তিনিও নন। তাঁর মতে, ছোট চোট নিয়ে খেলতে নামলে যে কোনও সময় তা বেড়ে যেতে পারে। তখন মাঠে সেই ক্রিকেটারের থেকে ১০০ শতাংশ পাওয়া যায় না। সেটা দলের কাছে সমস্যার কারণ হয়ে যেতে পারে। সেই কারণেই তিনি এমন খেলোয়াড়কে দলে রাখতে রাজি নন। কিন্তু তামিম অধিনায়ক বলে তাঁকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন হাথুরুসিংহ। সেই সঙ্গে তামিম নিজেও খেলতে নাছোড়বান্দা ছিলেন। মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণাও করে দেন যে, তিনি খেলবেন, চোট থাকলেও খেলবেন।
বুধবার
বুধবারই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের। তামিম যে বড় কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, তা সে দিনই বোঝা গিয়েছিল। কথামতোই প্রথম এক দিনের ম্যাচে খেলেছিলেন তামিম। ১৩ রান করেছিলেন। কিন্তু ম্যাচের পরেই বাংলাদেশের অধিনায়ক হঠাৎ জানিয়ে দেন, তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠক ডাকছেন। কী কারণে এই সাংবাদিক বৈঠক, তা জানতে বোর্ডের কর্তারা বুধবার তামিমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তামিম ফোন ধরেননি। তামিমের ভাই নাফিস ইকবালের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন পাপন। তাতেও তামিমের সাড়া পাননি তিনি। সাধারণত সিরিজ়ের মাঝে অধিনায়ক হুট করে এ ভাবে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন না। তাই তামিম সাংবাদিক বৈঠক ডাকায় অশনি সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছিল তখনই।
বৃহস্পতিবার সকাল
বৃহস্পতিবার সকালে বোর্ডের এক কর্তার ফোন ধরেছিলেন তামিম। সেই কর্তা তামিমকে অবসর না নেওয়ার কথা বলেছিলেন। নানা ভাবে তামিমকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। বিশ্বকাপ পর্যন্ত তাঁকে অধিনায়ক রাখা হবে বলে জানানোও হয়েছিল। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে চলতি সিরিজ়ে বিশ্রাম দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল তামিমকে। কিন্তু তামিমের মধ্যে এতটাই অভিমান জমে ছিল যে, কোনও কিছুতেই টলানো যায়নি তাঁকে।
বৃহস্পতিবার দুপুর
সাংবাদিক সম্মেলনে ১৬ বছরের কেরিয়ার থেকে আচমকা অবসরের কথা জানিয়েছিলেন তামিম। তিনি বলেছিলেন, “এটাই আমার শেষ। আমি নিজের সেরাটা দিয়েছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। আমার ১৬ বছরের যাত্রাপথে পাশে থাকার জন্য সতীর্থ, কোচ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও আমার পরিবারকে অনেক ধন্যবাদ।’’ তামিম আরও বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশের সমর্থকদেরও একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য। আশা করছি আগামী দিনেও আপনারা আমাকে ভালবাসবেন।’’
অবসরের কথা জানাতে গিয়ে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না তামিম। বার বার কেঁদে ফেলছিলেন। মাঝেমাঝে মাথা ঝুঁকিয়ে টুপির আড়ালে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। বলেছিলেন, ‘‘আমার অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন যে, কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই আমি। আশা করছি আপনারা বুঝতে পারছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া সহজ নয়।’’
তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট ছিল, খুব কষ্টে অবসর নিচ্ছেন। নইলে আগে থেকেই সেটা বলে দিতেন। এ ভাবে সিরিজ়ের মাঝপথে বলতেন না। সাংবাদিক বৈঠকে যে ভাবে তিনি কেঁদেছিলেন, তাতে বোঝা গিয়েছিল, নিজের সব থেকে প্রিয় জিনিসটা থেকে দূরে সরতে কতটা কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। নইলে তিনি কেন বলবেন, ‘‘আমি নিজের সেরাটা দিয়েছি। সত্যিই সেরা দিয়েছি। হতে পারে সেটা যথেষ্ট নয়। হতে পারে আমি ততটা ভাল নই। কিন্তু যখনই মাঠে নেমেছি নিজেকে ১০০ শতাংশ উজাড় করে দিয়েছি।’’
তাঁর অবসর নিয়ে যেন কোনও বিতর্ক না হয়, সেই অনুরোধও করেছিলেন বাংলাদেশের হয়ে এক দিনের ক্রিকেটে সর্বাধিক রানের মালিক। কারণ, তাঁর কাছে ব্যক্তির থেকে দেশ অনেক আগে। তামিম বলেন, ‘‘দয়া করে এই ঘটনা নিয়ে আর বিতর্ক বাড়াবেন না। এই বিষয়কে এখানেই শেষ করে দিন। আমি সব সময় বলেছি, দেশ অনেক আগে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পাশে থাকুন।’’
বৃহস্পতিবার সন্ধে
তামিমের অবসরের খবর মেনে নিতে পারেননি প্রাক্তন সতীর্থ মাশরফি মোর্তাজা। ফেসবুকে তিনি লেখেন, “তামিম, তোর সিদ্ধান্ত অবশ্যই একান্তই তোর। এটা কারও ভাল লাগলেও তোর, ভাল না লাগলেও তোর। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই হবে। তবে সবচেয়ে ভাল কোনটা, সেটা তুই ছাড়া কেউই ভাল বুঝবে না। তাই তোর এই সিদ্ধান্তকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে শতভাগ সম্মান জানাই। তবে কিছু কথা জানতে মন চায়, মাত্র ৩৪ বছর ১০৮ দিনেই বিদায় কেন! সত্যিই কি চালিয়ে যেতে পারছিস না? না কি কোনও চাপ তোকে বাধ্য করেছে? তোর অনেক ভক্ত হয়তো খুঁজবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর। আজ খুঁজবে, ভবিষ্যতও আরও অনেক দিন খুঁজবে।”
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত
তামিমের অবসর ঘোষণার পরেই সাংবাদিক বৈঠক করেন পাপন। তিনি জানান, বাংলাদেশের ওপেনার অবসরের সিদ্ধান্ত বদলাবেন, এমনটাই আশা করেন তিনি। দুম করে এ ভাবে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্যে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেন। তখনও বোঝা যায়নি শুক্রবার সকালে কী আসতে চলেছে।
শুক্রবার সকাল
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাপনের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তারই একটিতে তামিমের অবসরের ঘটনাটিকে ‘নাটক’ আখ্যা দেন পাপন। ‘প্রথম আলো’কে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যা নাটক শুরু হয়েছে, আর ভাল লাগে না। অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম।” তিনি আরও বলেন, “একটা সিরিজ় চলছে। ওর এ রকম কোনও পরিকল্পনা থাকলে আলোচনা করতে অসুবিধা কোথায়? আমার সঙ্গে রোজই কথা হয়। কাউকে না জানিয়ে এ রকম কাজ করব, এই মানসিকতা থেকে ওরা কবে বার হবে! এটা করে ওদের কী লাভ হয় বুঝি না। তবে নিশ্চয়ই কোনও লাভ হয়। নইলে এমন করবে কেন? তুমি যদি অধিনায়কত্ব না-ই করতে চাও, এক বার আলোচনায় অন্তত বসো। কথা বলতে অসুবিধা কী! ও যদি অধিনায়কত্ব না করতে চাইত, তা হলে কি জোর করে খেলাতে পারতাম!”
এর মধ্যেই পোস্ট করেন শাকিব আল হাসান। তিনি যখন লেখেন, তখন তামিম সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানাননি। তখনও তামিম প্রাক্তন ক্রিকেটার। সে সময় বন্ধুকে নিয়ে শাকিব ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘‘২০০৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলের হয়ে আমাদের একসঙ্গে পথ চলা শুরু। গত ২০ বছর ধরে আমরা নিজেদের স্বপ্ন এবং লক্ষ্যগুলোকে ভাগ করে নিয়েছি। একটা দৃঢ় বন্ধন এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি। আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। তোমার (তামিমকে উদ্দেশ্য করে) আবেগ এবং আগ্রাসন আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে।’’
শাকিব জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে জেতানোর জন্য তাঁরা পরস্পরের দক্ষতার প্রতি বিশ্বাস রাখেন। একে অন্যের উপর নির্ভর করেন। তামিমের রান এবং রেকর্ডগুলিই তাঁর দক্ষতার পরিচয় বলেও লেখেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। শাকিব লিখেছিলেন, ‘‘এক জন খেলোয়াড় হিসাবে তুমি যা কিছু অর্জন করেছ, তার জন্য আমরা সতীর্থেরা গর্বিত। তোমার সঙ্গে আর মাঠে থাকতে পারব না। এটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। আমরা এর পর যখন মাঠে নামব, তোমার আগুন আমাদের সকলের ভিতরে জ্বলবে।’’ দীর্ঘ দিনের সতীর্থকে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি শাকিব। লিখেছিলেন, ‘‘তোমার নতুন জীবনেও তুমি ছক্কা হাঁকাও। প্রিয় জনদের সঙ্গে নতুন মুহূর্তগুলি উপভোগ কর।’’
শুক্রবার বেলা
শুক্রবার আফগানিস্তান সিরিজ়ের জন্য লিটন দাসকে অধিনায়ক হিসাবে নির্বাচিত করে বাংলাদেশ বোর্ড। তবে পাকাপাকি ভাবে নয়। সিরিজ়ের বাকি দু’টি এক দিনের ম্যাচের দায়িত্ব লিটনকে দেওয়া হয়েছিল। তার মাঝেই জানা যায়, শেখ হাসিনা নিজের বাড়িতে তামিমকে ডেকেছেন। সেখানে বিশেষ বৈঠক করার কথা। অনেকেরই জল্পনা ছিল, তামিমকে নিরস্ত করতে পারেন হাসিনা। তিনি হয়তো অনুরোধ করতে পারেন অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের।
শুক্রবার দুপুর
যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল সেটাই হয়। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়েই তামিম ঘোষণা করেন তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করছেন। তামিম বলেন, “প্রধানমন্ত্রী দুপুরে তাঁর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ওঁর সঙ্গে আমার অনেক ক্ষণ আলোচনা হয়েছে। উনি আমাকে খেলায় ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি অবসর তুলে নিচ্ছি। সবাইকে না বললেও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে না বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’
অবসরের সিদ্ধান্ত বদলের নেপথ্যে হাসিনা ছাড়াও আরও দু’জন আছেন জানিয়ে তামিম বলেন, ‘‘আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফিরে আসার পিছনে বাংলাদেশের বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন এবং মাশরাফি মোর্তাজার (বাংলাদেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক) ভূমিকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে যখন যাই, তখন আমার সঙ্গে মাশরাফি ভাই এবং পাপন ভাই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেড় মাসের ছুটি দিয়েছেন। মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে বলেছেন।”