ছবি: ইসিবি
তিনি না থাকলে অ্যাশেজ হারে ইংল্যান্ড। তিনি না থাকলে বিশ্বকাপটাই জেতা হত না ইংল্যান্ডের। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিন বিভাগে তিনিই ইংল্যান্ডের প্রধান ভরসা। বৃহস্পতিবার থেকে যোগ হল নেতৃত্ব। ইংল্যান্ডের ‘চতুর্দিকে’ শুধুই বেন স্টোকস। সমস্যায় পড়লেই ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের ত্রাতা তিনি।
২০১৭ সালে এক পানশালায় মারপিট করার অভিযোগ ওঠে ইংরেজ অলরাউন্ডারের বিরুদ্ধে। অ্যাশেজ থেকেই বাদ পড়তে হয়। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেই সিরিজে ব্রিটিশ সিংহকে নাস্তানাবুদ করে ক্যাঙারুর দেশ। ০-৪ ব্যবধানে হেরে যায় ইংল্যান্ড।
তাঁকে কতটা প্রয়োজন ছিল, বোঝা যায় পরের অ্যাশেজেই। ২০১৯ সালের অ্যাশেজে প্রথম ম্যাচে স্টোকস করেন ৫০। পরের দু’টি টেস্টে শতরান করেন তিনি। এর মধ্যে তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে স্টোকসের শতরান ইংল্যান্ডকে জেতায় এবং সিরিজে সমতা ফিরিয়ে আনে। লিডসে সেই শতরান করে প্রথা মেনে হেলমেট খুলতে বা ব্যাট তুলতে দেখা যায়নি তাঁকে। স্টোকসের তখন লক্ষ্য ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জেতানো। ১৩৫ রানে অপরাজিত থেকে টেলএন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে তবেই হুঙ্কার ছাড়েন স্টোকস। আকাশের দিকে মুখ, চোখ বন্ধ, মুখে জয়ের হুঙ্কার।
ইংল্যান্ডের ‘চতুর্দিকে’ শুধুই বেন স্টোকস। ছবি: ইসিবি
স্টোকসের এই একই ভঙ্গি দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালে। তবে মাঠে নয়, ছিলেন ব্রিস্টল আদালতে। আর মুখে হুঙ্কার নয়, ছিল স্বস্তি। আদালত রায় দেয় স্টোকস দোষী নন। এক সমকামী যুগলকে বাঁচানোর জন্যই পানশালায় মারমুখী হয়েছিলেন। মুক্তি পান তিনি। অপবাদ মুছে ক্রিকেট মাঠে ইংল্যান্ডকে জয়ের রাস্তা দেখান স্টোকস। স্বস্তি পায় ব্রিটিশ সিংহ।
২০১৭ সালের আগেও বিতর্কে জড়িয়েছে স্টোকসের নাম। সাল ২০১৩। স্টোকসের তখনও ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে অভিষেক ঘটেনি। অস্ট্রেলিয়াকে অ্যাশেজে হারিয়ে স্টুয়ার্ট ব্রড, কেভিন পিটারসন এবং জেমস অ্যান্ডারসন ওভালের পিচে প্রস্রাব করেন। সেটা না কি ছিল চিরশত্রুকে হারানোর উৎসব। ইংল্যান্ড বোর্ড সেই ঘটনার জন্য ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ড অ্যাশেজ জেতার পর সেই ঘটনাকেই টেনে আনেন স্টোকস। তাঁর টুইট, ‘মূত্রত্যাগ করব, কি না?’ সেই বিতর্কিত ঘটনাকে ফিরিয়ে আনায় নিন্দিত হন ইংরেজ অলরাউন্ডার। পরে সেই টুইট মুছে দেন।
বিতর্ক পিছু না ছাড়লেও ইংল্যান্ডের ভরসা স্টোকসই। তিনি না থাকলে হয়তো ২০১৯ সালে এক দিনের বিশ্বকাপটাই জেতা হত না। ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৪১ রান তাড়া করতে নেমে স্টোকসকে না পেলে ইংল্যান্ডের জেতা সম্ভব হত না। ৯৮ বলে ৮৪ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। ইংল্যান্ড শেষ করে ২৪১ রানেই। সুপার ওভার শেষেও দুই দলের রান সমান ছিল। বেশি বাউন্ডারি মারায় বিশ্বকাপ জেতে ইংল্যান্ড। সেখানেও কৃতিত্ব স্টোকসের ব্যাটের। কারণ নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপ্টিলের শেষ ওভারে ছোড়া বল স্টোকসের ব্যাটে লেগে চলে গিয়েছিল বাউন্ডারিতে। সেই চার না হলে বিশ্বকাপ জেতা হত না।
বার বার ইংল্যান্ডের ত্রাতা হয়ে ওঠা স্টোকস একটা সময় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। গত বছর ক্রিকেট থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। স্টোকসকে নিয়ে যে তথ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে সেখানে ইংরেজ অলরাউন্ডারকে বলতে শোনা যায়, “কখনও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি ক্রিকেট থেকে সরে যাব। আমার অস্বস্তি সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে।” তাঁর মনে হয়েছিল গোটা পৃথিবীতে তিনি একা হয়ে গিয়েছেন। আকস্মিক সিদ্ধান্তে তাঁর সতীর্থরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। স্টোকসের মতো একজন ক্রিকেটার দলে নেই ভাবতেই পারছিলেন না জো রুট, স্টুয়ার্ট ব্রডরা। প্রাক্তন অধিনায়ক রুট বলেন, “আমি ভাগ্যবান যে ওর মতো একজন ক্রিকেটারকে দলে পেয়েছি।”
কেরিয়ারের শুরুতে ‘দৈত্য’ বলে পরিচিত ছিলেন স্টোকস। কোনও কিছুতে হার মানতে রাজি ছিলেন না। জেদি, একরোখা এমন এক ক্রিকেটারকেই ইংল্যান্ড তাদের সেরা বিজ্ঞাপন মনে করে। ব্যাটে, বলে স্টোকস কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা নির্দয় হয়ে উঠতে পারেন তা ক্রিকেট মাঠে বার বার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। ৭৯ টেস্টে ১১টি শতরান-সহ ৫০৬১ রান করে ফেলা একজন ক্রিকেটারকে ব্যাটার বলা যায়। আবার লাল বলে তাঁর উইকেটের সংখ্যা ১৭৪, যা প্রমাণ করে বোলার হিসেবেও তিনি কতটা ভয়ঙ্কর।
সাল ২০২২। অ্যাশেজে হার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে হার। নেতৃত্ব ছেড়ে দেন জো রুট। বিপর্যস্ত ইংল্যান্ড ক্রিকেট। ত্রাতা, সেই বেন স্টোকস। নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁর হাতে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে নামার আগে স্টোকস বলেন, “এই টেস্ট দলের জন্য আমি সামনে ফাঁকা ক্যানভাস দেখছি। সবাই নতুন ভাবে শুরু করছি।”
বিপর্যস্ত ব্রিটিশ সিংহ, তাকে বাঁচাতে ফের আবির্ভূত স্টোকস।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।